Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সঠিক খাদ্যাভ্যাস স্বাভাবিক রাখবে কোলেস্টেরল ও হিমোগ্লোবিন


২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:১৮

উচ্চ শিক্ষিত ও সফল ব্যবসায়ী মিসেস আনোয়ারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বয়স ৬৬ বছর। প্রায় সাত বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। কিন্তু প্রায় ছয়মাস হলো ওনার রক্তচাপ ১০০/৬০ এমএমএইচজি (mmHg) থেকে ১১০/৬৯ এমএমএইচজি এর মাঝে ওঠানামা করে। কখনও কখনও আবার কোন মানসিক চাপ পড়লে ১৩৫/৯৫ এমএমএইচজি ও আসে মাপলে। এবং পালস্ রেট ৮৫ থেকে ৯০ বি/এম এর মধ্যে ওঠানামা করে সবসময়। সামান্য কাজ করলেই হাপিয়ে যান। বুক ধড়ফড় করে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। প্রায়ই বসা বা শোয়া থেকে উঠলে মাথা ঘুরায়, চোখ অন্ধকার হয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। কয়েকবার পড়েও গেছেন। খুব ক্লান্ত লাগে। কখনও কখনও তীব্র মাথা ব্যথা হয়। খাবারও হজম হয় না ঠিকমত। পেট ভার হয়ে থাকে। কোন কোন দিন সারাদিন ক্ষুধা লাগে না। কখনো তিন চারদিন পায়খানা হয় না আবার কখনো ডায়রিয়া চলতে থাকে। কিছুদিন হল ডান হাতের আঙুলগুলো মুঠো করতে পারছেন না ঠিকমতো, ব্যথা করে। বিশেষ করে সকালে মুঠো করতে খুব কষ্ট হয়। এখন আর কোন ধরনের অফিসিয়াল কাজ করতে পারছেন না। ঘরেই থাকছেন, কোথাও বেরুতে পারেন না। এভাবেই মিসেস আনোয়ারা তার সমস্যাগুলো তুলে ধরেন।

বিজ্ঞাপন

মিসেস আনোয়ারাকে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, ওনার মুখ বেশ ফ্যাকাশে। উনি ফর্সা মানুষ হলেও ওনার ত্বক হলদে ফ্যাকাশে বর্ণের হয়ে গেছে। চোখ রক্তশূন্য। চোখের নীচ এবং মুখ ফোলা ফোলা। চামড়া খসখসে, রুক্ষ। রোগা পাতলা গড়নের মানুষ। ওজন মেপে দেখলাম ওজন ৪১ কেজি। উচ্চতা ৫ ফুট অনুযায়ী তিনি আন্ডারওয়েট। উনি বিভিন্ন সময়ে শারীরিক অসুস্থতার জন্য ডাক্তার দেখিয়েছেন। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ওষুধও খেয়েছেন। ওনার সাথে থাকা গত দুই বছরের পুরনো ল্যাব রিপোর্টগুলো দেখি। Blood Picture এবং Urine Culture স্বাভাবিক নয় কোন রিপোর্টেই। ওনাকে নতুন করে কিছু ল্যাব টেস্ট করতে দেই।

বিজ্ঞাপন

এবারের ল্যাব টেস্টের রিপোর্টে ওনার হিমোগ্লোবিন এসেছে ৯.৪ জি/ডিএল (g/dl)। এদিকে Serum Cholesterol (Total) 212 mg/dl। হার্টের ইসিজি নরমাল এসেছে। রিপোর্টগুলো ওনার সামনে তুলে ধরে ওনার সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে সেটা ওনাকে বুঝিয়ে বলি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর রক্তের হিমোগ্লোবিন থাকার কথা ১২-১৩.৫ জি/ডিএল। ওনার রক্তের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের থেকে কম রয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের Blood ESR  ০-২০ mm এর মধ্যে থাকার কথা। এদিকে ওনার Blood ESR ও বেশি। মানে শরীরে ইনফেকশন বা ইনফ্লামেশন রয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের  Serum Cholesterol (Total) 200 mg/dl এর কম থাকা দরকার কিন্তু মিসেস আনোয়ারার ২১২ mg/dl রয়েছে। অর্থ্যাৎ ওনার রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা বেশি। মিসেস আনোয়ারার পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই অস্বাভাবিক হয়ে রয়েছে। একদিকে হিমোগ্লোবিন কম, অ্যানিমিয়ায় ভুগছেন উনি। অন্যদিকে রক্তে কোলেস্টরেল বেশি। ব্লাড প্রেসার ওঠানামা করছে। আবার ওজনও কম। ইন্টারনাল ইনফেকশনও রয়েছে। হিমোগ্লোবিন কম থাকার কারনেই পালস্ রেট বেশি থাকছে এবং শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুক ধড়ফড় করে, মাথা ঘুরছে, পড়ে যাচ্ছেন। ভিটামিন সি এর ঘাটতি রয়েছে। মেটাবলিজম সমস্যার কারণে হাতের জয়েন্টে ব্যথা হচ্ছে।

মিসেস আনোয়ারার খাবার অভ্যাস জানতে চাইলে উনি বললেন যে, উনি দিনে দুবার খান। সকাল ১১ টায় একবার আর সন্ধ্যা ৬ টায় আরেকবার। উনি প্রশ্ন করলেন, কেন ওনার কোলেস্টরেল বেশি থাকে রক্তে! উনি ল্যাব রিপোর্টে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় বুঝলাম। আমার কাছে আসার আগে ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসা সম্পর্কে বেশ পড়াশোনা করেছেন। পরিচিত কারও কারও কাছ থেকে শুনেছেনও এর সম্পর্কে। মিসেস আনোয়ারা ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থতা চাইছেন। ওনার সঙ্গে বেশ অনেকক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করে ওনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করলাম ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসায় অংশগ্রহনের জন্য। এবার মিসেস আনোয়ারাকে ওনার আগামী তিন দিনের সারাদিনের খাবার তালিকা, ঘুমের সময়, সারাদিনের কাজের বিবরণ করে তা নিয়ে দেখা করতে বললাম।

মিসেস আনোয়ারার করা খাদ্য তালিকায় দেখা গেলো উনি ভাত এবং রুটি প্রায় খানই না, খেলেও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রতিদিন স্যুপ খান বাটার দিয়ে। মুরগীর মাংস দিয়ে তৈরি কোন না কোন মেন্যু খান। মাছ খেলেও বড় বড় মাছের তৈলাক্ত অংশগুলো খেতে পছন্দ করেন। নিয়মিত বাটার, পনির, বিভিন্ন বাদাম খেতে পছন্দ করেন। নিয়মিত রান্না হয় যেসব খাবার সেগুলো উনি খেতে পারেন না। উনি প্রতি বেলায় নিজের মতো করে নতুন নতুন আইটেম রান্না করিয়ে খান। পানি খাওয়া কখনো কখনো পরিমাণ মত হয়, আবার কোন কোন দিন প্রয়োজনের তুলনায় কম খান। ওনার খাদ্য তালিকায় কোন শাক এবং ফল নেই। সবজি বলতে আলু। ঘুমান রাত একটা বা দুইটায়, কখনো কখনো তিনটায়। ওঠেন সকাল আটটায়। ঘরে থাকলেও খুব অস্থির সময় কাটান। মিসেস আনোয়ারার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি ওনার খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি ব্যক্তি জীবন এবং পারিবারিক জীবন খুব অস্থির এবং সুস্থতার জন্য সহায়ক নয়। উনি বার বার আমাকে বলছিলেন, ‘আমি যতদিন বাঁচবো সুস্থভাবে বাঁচতে চাই। মরে গেলে হঠাৎ যেন মরি। অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কারও ওপর বোঝা হয়ে বাঁচতে চাই না। ন্যাচারোপ্যাথিতে আছে এমন কিছু করুন যাতে যতদিন বাঁচি সুস্থভাবে বাঁচতে পারি।’ সুস্থতার এই আকুতি শুধু মিসেস আনোয়ারার নয় আমার নিজেরও।

দুইমাসের ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসা পরিকল্পনার আওতায় পুষ্টিবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে খাবার খেয়ে আর কিছু সহজ থেরাপি অনুশীলন করে মিসেস আনোয়ারার কোলেস্টেরল স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসে এবং আগের তুলনায় রক্তের হিমোগ্লোবিনও বাড়ে।

ফুড থেরাপি

– মিসেস আনোয়ারার স্বাস্থ্য সমস্যার আলোকে ওনার সঙ্গে খাদ্য এবং পুষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনা করে বুঝিয়ে বলি যে, ওনার খাদ্যাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন না আনলে উনি সুস্থ হবেন না। উনি পরিবর্তন আনতে সম্মত হন এবং ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসা শুরু করেন। মিসেস আনোয়ারাকে আমি এক মাসের জন্য একটি দৈনন্দিন রুটিন করে দেই। সেই রুটিনে সারাদিনের খাদ্যাভ্যাসসহ চার বেলার খাবার মেন্যু এবং সময় উল্লেখ করে লিখে দেই। কখন কি খাবেন, কোন খাবার কি পরিমাণ খাবেন তা সুস্পষ্টভাবে লিখে দেই। এবং ডায়েরিতে প্রতিদিন ঘুমের সময়, ঘুম থেকে ওঠার সময়, কখন কি খাচ্ছেন তা লিখে রাখতে বলি। পানিসহ তরল খাবার কত গ্লাস খাবেন তাও লিখে রাখবেন।

– একমাসের কোর্স শেষে ফলোআপ করে দ্বিতীয় মাসে নতুন আরেকটি খাদ্যতালিকা করে দেই। সেখানে কিছু পরিবর্তন এনে খাবার সময় এবং খাবার মেন্যু ঠিক করে দেই।

মেডিটেশন
প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় মেডিটেশন করাই দুইমাস।

আকুপ্রেসার
হজম শক্তি বাড়ায়, পায়খানার সমস্যা দূর করে, রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য এবং জয়েন্টের ব্যথা দূর করে এমন পয়েন্টগুলোতে আকুপ্রেসার করাই বিকেলে ত্রিশ মিনিট ।

ইয়োগা
যেহেতু মিসেস আনোয়ারা এনিমিয়ায় ভুগছেন তাই ভিগোরাস ইয়োগা এক্সারসাইজ ওনার জন্য ক্ষতির কারণ হবে। তাই ওনার জন্য সহনশীল এবং উপকারি এমন কিছু ইয়োগা এক্সারসাইজ ওনাকে শিখিয়ে দেই যেগুলো উনি ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে বসে ত্রিশ মিনিট করবেন।

মাসাজ
ডান হাতের আঙুলের জয়েন্টে মাসাজের জন্য একটি হারবাল অয়েল বানিয়ে দেই। আর একটি জিনজার প্যাক করে দেই যেটা মাসাজের পর দশ মিনিট লাগিয়ে রাখবেন। এই দুটো হারবাল লাগাবেন ব্যথা যতদিন না সারবে ততদিন পর্যন্ত।

দুইমাস শেষ হলে ওনার Blood Lipid Profile এবং CBC টেস্ট করাই। এবার কোলেস্টরেল কমে Serum Cholesterol (Toatl) ১৮০ mg/dl এসেছে আর হিমোগ্লোবিন বেড়ে হয়েছে ১০.৮ g/dl. ওজন বেড়েছে দুই কেজি। দিনে চারবেলা খেতে পারছেন। হজম শক্তি বেড়েছে। ডায়রিয়া হয়নি দুইমাসে একবারও। পায়খানা হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা কাজ করতে পারছেন। আর হাতের আঙ্গুলের জয়েন্টের ব্যথা নেই। এখন স্বচ্ছন্দে ডান হাতের আঙ্গুলগুলো মুঠো করতে পারেন। মিসেস আনোয়ারাকে রিপোর্টের পরিবর্তনগুলো দেখিয়ে ওনার ধৈর্য্য শক্তি আর লেগে থেকে নিয়ম মেনে চলার জন্য ধন্যবাদ জানাই। উনি হাসি দিয়ে ওনার পরিবারের সদস্যদের সামনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন আর বলেন ”ঐন্দ্রিলা আপনার প্রচেস্টা আর পরিশ্রমেই আজ আমরা স্বাভাবিক জীবন কি বুঝতে পেরেছি”। মিসেস আনোয়ারাকে পরবর্তী মাসের খাদ্যাভ্যাস এবং থেরাপি রুটিন করে দেই এবং ওনার কেয়ার টেকারকে বুঝিয়ে দেই কখন কি খাওয়াবে আর কোন থেরাপি কখন করাবে। প্রতিমাসে একবার ফলোআপ করার জন্য তারিখ ঠিক করে দেই। মিসেস আনোয়ারা এখন সবাইকে সঠিক খাবারের গুরুত্বের কথা বলেন। শুধু ওনার নয় পরিবারের যে কারো যে কোন স্বাস্থ্য সমস্যায় আমাকে ফোন করেন পরামর্শের জন্য।

সৃষ্টিকর্তার বড় নেয়ামত সুস্থতা। সুস্থ থাকা একটি শিল্প, এর চর্চা করতে হয়। প্রকৃতির খাদ্য সম্ভারেই রয়েছে সুস্থতার সূত্র। আসুন সুস্থতার সূত্র জানি, সুস্থ থাকি।

কোলেস্টেরল টপ নিউজ ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার ন্যাচারোপ্যাথি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর