ফাগুন জাগুক প্রাণ-প্রকৃতি আর মানুষের ভালোবাসায়
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০০:৩৩
ঠিক একবছর আগে এই একটিমাত্র দিন আমরা নিশ্চিন্ত মনে পালন করেছিলাম। সূর্যের চাকা ঘুরে ঘুরে যে সেবারই ১৪ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস একসঙ্গে পড়ে যায়। এর আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন আর ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস উদযাপিত হত। ফাল্গুনের প্রথম দিন লাল আর হলুদে বসন্তবরণ করে পরদিন পরতাম লাল-নীল পোশাক। কিন্তু গতবছর একইদিনে দুই উৎসব পালিত হওয়ায় একইদিনে হরেক রঙে সাজে প্রাণ-প্রকৃতি ও মানুষ।
সার্বজনীন উৎসবের মধ্যে পহেলা বৈশাখের পর পহেলা ফাল্গুনই বাঙালির অন্যতম বড় উৎসব। এদিন আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মেতে উঠি রঙের উৎসবে। গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগী ধরা পড়ার পর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা প্রবেশ করি ‘নিউ নরমাল’ যুগে। ফলে ৮ মার্চের পর যতগুলো উৎসব এসেছে তা পালিত হয়েছে সীমিত পরিসরে। পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে রোজা ও কুরবানির ঈদের মতো উৎসবও পালিত হয় ঘরে বসে। তারপর অবশ্য পূজার সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে জীবনযাত্রা। সীমিত পরিসরে উদযাপিত হয় দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কালী পূজা।
বছর ঘুরে আবারও এল ১৪ ফেব্রুয়ারি। আমরা আবারও একসঙ্গে পালন করব পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস। ইতোমধ্যেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করা জীবনে নতুন রঙ নিয়ে এসেছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন। কয়েক লাখ মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছেন। নেওয়ার অপেক্ষায় আরও কোটি মানুষ। আর ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হওয়ায় স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে জনমনে। এবার হয়তো অর্জিত হবে কাঙ্ক্ষিত হার্ড ইমিউনিটি, শূন্যের কোটায় নামবে কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়ার হার।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আসার স্বস্তির মধ্যেই ফাল্গুনি ভালোবাসা নিয়ে আসছে বসন্ত। আর বসন্তকে বরণ করে নিতে আমের বোল, কোকিলের গান, গাঁদা, শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ায় সেজে উঠেছে প্রকৃতি। গাছের ডালে ডালে কচি পাতার সমারোহ। শীতের আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে প্রকৃতি। বাতাসে বইছে ভালোবাসার সুর। বাঙালির জীবনে বসন্তের সঙ্গে ভালোবাসার চূড়ান্ত যোগ। যুগে যুগে গান, গল্প, কবিতায় উঠে এসেছে তা।
বাউল আবদুল করিম গেয়েছেন—
‘বন্ধুর বাড়ির ফুল বাগানে
নানান বর্ণের ফুল
ফুলের গন্ধে মনানন্দে
ভ্রমর হয় আকুল
সই গো, বসন্ত বাতাসে’
ফুলের সঙ্গে ফাল্গুনের যেমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, তেমনি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায় ফুলের ছোঁয়া না পেলে। ভ্রমর যেমন ফুলের টানে ছুটে ছুটে আসে তেমনি ভালোবাসার সৌরভে মাতাল হয় প্রেমিক মন। ভালোবেসে একে অন্যকে ফুল উপহার দেই আমরা। ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’ গানের টানে প্রিয়জনের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ি।
আজকের যে বসন্ত উৎসব তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দোলযাত্রার ইতিহাস। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাঁধা-কৃষ্ণের একে অন্যকে আবিরের রঙে রাঙানোর মধ্য দিয়েই এর সূচনা বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে কিছু কিছু এলাকায় এই ফাল্গুনি পূর্ণিমায় উদযাপিত হয় রাস উৎসব। রাসের অন্যতম আকর্ষণ কীর্তন গান ও নাচ। আর কীর্তনগানে উঠে আসে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের স্বরূপ। তাই ফাল্গুনের আগমন বাঙালি জীবনে ভালোবাসার নতুন উৎস সঞ্চার করে।
এদিকে আধুনিক ভ্যালেন্টাইনস ডে উৎসবকে বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। অনেকেই ভাবেন এ বুঝি শুধুই প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা। আসলে তা নয়। ভালোবাসার নানা রূপ আর বৈচিত্র্যই ভালোবাসা দিবসকে করেছে এতটা আকর্ষণীয়। এই দিনে আমরা প্রতিটি সম্পর্কে উদযাপন করি। প্রিয়জনকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে আর উপহার দিয়ে নতুন করে উপলব্ধি করি ভালোবাসার অনুভব।
বিভিন্ন দিবসের মতো ভালোবাসা দিবসও আসলে ব্যবসায়ীক প্রয়োজনেই সৃষ্টি। ফাল্গুনে যেমন আমরা রঙিন পোশাক আর নাচে-গানে উদযাপন করি ভালোবাসা দিবস কিন্তু শুধুই পোশাকের নয়। এদিন লাল-কালো-নীল পোশাক পরার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রিয়জনকে নিয়ে ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া ও উপহার বিনিময় করি। বিভিন্ন পোশাকের দোকান ও হোটেল-রেস্টুরেন্টে থাকে বিশেষ ছাড়। তবে উচ্চমূল্য থাকে ফুলের। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ যে মূল্যহীন তাই আমরা একটি মাত্র গোলাপ দিয়ে হলেও প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলি না।
প্রকৃতির নিজস্ব গতিতে প্রতিবছর আসে পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস। কোভিড-১৯-জনিত রোগশোকে জর্জরিত বিশ্ববাসীকে নতুন প্রাণের আশা জাগাতে প্রকৃতিতে আবারও আসছে বসন্ত। আর একে অন্যকে সঙ্গে করে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা জাগাতে আসছে ভালোবাসা দিবস। আসুন আমরা এই নতুন ফাল্গুনে প্রাণ আর প্রকৃতিকে ভালোবাসি।
সারাবাংলা/আরএফ/