Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাই হিলের কথা- হাই হিলের ব্যথা


২২ মার্চ ২০১৮ ১৩:০৮

জান্নাতুল মাওয়া।।

হাই হিলের আদি গপ্পো

ফ্যাশন সচেতন মেয়েদের পছন্দ হাই হিল। আর যারা মনে করেন তাদের উচ্চতা কম তারাতো হাই হিল ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যেতেই চাননা! আজকাল পুরুষদের জুতোয় হিল নেই বললেই চলে। হাতেগোনা কিছু পুরুষ নিজের উচ্চতা বাড়ানোর জন্যে কিছুটা হিলের সাহায্য নেন, তবে সেটিকে কিছুতেই হাই হিল বলা যায়না। তবে মজার ব্যাপার হল, হাই হিলের ইতিহাস খুঁড়লে দেখা যায় একসময় এটা  পুরুষরাই পরতো।

দশ শতকের শুরুতে ঘোড়ার রেকাবে পা আটকে রাখার সুবিধার জন্যে ঘোড়সওয়ার পুরুষেরা জুতোয় হিল লাগানো শুরু করে। এইজন্যে এখনো কাউবয় বুটগুলোতে হিল দেখা যায়। পারস্যের ঘোড়সওয়ার যোদ্ধারা হিল জুতো পরতেন। যুদ্ধের সময় মাঝে মাঝেই ঘোড়ার রেকাবে পা রেখে দাঁড়িয়ে যেতে হত, সে সময় হিল জুতো পা দুটোকে আটকে রাখতে সাহায্য করতো। সেই চলটি ধীরে ধীরে ইওরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।

যেহেতু ঘোড়ার মালিক সাধারণত ধনী আর সমাজে উচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্তরাই হতেন তাই সে সময় হাই হিলকে উঁচু শ্রেণির লোকদের জুতো বলেই মনে করা হতো। এরও অনেক আগে প্রাচীন গ্রীসে নাট্যমঞ্চের অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাদের জুতোর নিচে হিল ব্যবহার করতেন। তবে সেটি শুধুমাত্র মঞ্চেই ব্যবহৃত হত এবং নাটকের চরিত্রের সামাজিক শ্রেনিতে অবস্থান ভেদে হিলের উচ্চতা পরিবর্তিত হত। আর প্রাচীন মিশরের চিত্রলিপি থেকে দেখা যায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুরোহিতেরা তাদের জুতায় হিল পরতেন।

তবে নিয়মিত পরার জুতোতে যে হিল থাকতে পারে সেই ধারণাটি দশ শতকের পরে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক কোন সময় থেকে নারীরাও হিল জুতো পরা শুরু করে সেই খবরটি পাওয়া না গেলেও জানা যায় সতেরো শতকের দিকে উঁচু শ্রেণির এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইওরোপিয়ান নারীরা হাই হিল পরতো । তবে তখন হাই হিল ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। অভিজাত নারী পুরুষ অনেকেই হাই হিল পরতেন।

বিজ্ঞাপন

ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই এর একটি চিত্রকর্মে দেখা যায় তিনি খুব গর্বের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন পরনে ঝকমকে অভিজাত রাজপোশাক এবং পায়ে হিল জুতো। উচ্চতায় খাটো হওয়ায় এই রাজা প্রায় চার ইঞ্চি উঁচু হিল পরে রাজসভা পরিচালনা করতেন।

 

 

১৭৮৯ এ ফ্রেঞ্ছ রেভোলিউশনের পর অনেকদিন পর্যন্ত হিলের জনপ্রিয়তা ভাটার দিকে চলে যায়। সেসময় আভিজাত্যের প্রতি মানুষের একটা উন্নাসিকতা তৈরি হয়েছিল। আর তাই আভিজাত্যের প্রতীক বলে পরিচিত হিল জুতোকেও মানুষ অবজ্ঞাভরে দূরে সরিয়ে দেয় তখন।

হিল জুতো তার স্বমহিমায় ফিরে আসে আবার ভিক্টোরিয়ান যুগে। তবে এসময় থেকে পুরুষেরা পুরোপুরিভাবে হিল জুতো পরা ছেড়ে দেয় আর অভিজাত নারীদের জুতোর তাকে শোভা পেতে থাকে হিল জুতো। এসময় ক্যামেরা আবিষ্কার হয় এবং অভিজাত নারীরা ছবি তুলতে গিয়ে লক্ষ্য করেন হিল জুতো পরা ছবিগুলোতে তাদের ভঙ্গিমা আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এরপর যৌন উদ্দীপক ফটোগ্রাফির মডেলরা হিল জুতো পরাটাকে ট্রেন্ডে পরিণত করে ফেলেন। এসময় থেকে পিন-আপ ফটোগ্রাফির সব মডেলদেরকেই হিল জুতো পরতে দেখা যায়। হিল জুতো হয়ে পড়ে যৌনতার প্রতীক। সময়ের সাথে সাথে সেই হিলে আসে নানান পরিবর্তন।

হিলে জোরজবরদস্তি

এখনকার বিখ্যাত আর জনপ্রিয় স্টিলেটো হিল প্রথম বাজারে আসে ১৯৫৪ সালে। ক্রিশ্চান ডি’ওরের ডিজাইনার রজার ভিভিয়ের এই জুতো ডিজাইন করেছিলেন। এখন তো অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে শোবিজের তারকারা সবাই এই স্টিলেটো হিলই পরবেন।

 

 

২০১৫ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে তো নিয়মই করে দেয়া হল যে হাই হিল না পরে কোন নারী তারকা রেড কার্পেটে উঠতে পারবেন না। এই নিয়মটি অনেক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং পরের বছর এই নিয়মের প্রতিবাদে জুলিয়া রবার্টসকে দেখা যায় হাসি হাসি মুখ করে খালি পায়ে রেড কার্পেটে উঠে পড়েছেন।

বিজ্ঞাপন

 

 

এর মাধ্যমে এই জনপ্রিয় তারকা সবাইকে জানান দিলেন যে, হাই হিল পরা তার পছন্দ হলেও এটি পরার সিদ্ধান্ত কেউ তার উপর চাপিয়ে দিতে পারেনা।

বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট ববি ব্রাউন হিল জুতো পরা ছেড়ে দিয়েছেন কারন তিনি বলেন, তার ক্লসেট ভর্তি হয়ে আছে অনেক সুন্দর সুন্দর হাই হিলে। কিন্তু তিনি যা পরে আরাম বোধ করেন তা পরেই সবচেয়ে খুশি থাকেন। পাঁচ ফিট উচ্চতার এই মেকআপ আর্টিস্ট তার নিজের উচ্চতা নিয়ে প্রথমদিকে দ্বিধায় ভুগলেও এখন খুব আত্মবিশ্বাসের সাথেই ফ্ল্যাট জুতো পরে ঘোরাফেরা করেন তার চেয়েও অনেক লম্বা সব সুপারমডেলদের সাথে। বিখ্যাত ডিজাইনার এবং মডেল ভিক্টোরিয়া ব্যাকহামও নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া হিল জুতো পরা ছেড়ে দিয়েছেন।

স্বাস্থ্য না ফ্যাশন?

বাংলাদেশেও মডেল ও তারকাদের হাত ধরে হিল জুতোর চল শুরু হয়। এখানে নারীরা প্রতিদিনের কর্মক্ষেত্রে হিল না পরলেও প্রায় সব ফ্যাশন সচেতন নারীর জুতোর তাক ঘাটলে দুই এক জোড়া হিল জুতোর সন্ধান মিলবে। কথা বলছিলাম রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের এক জুতোর দোকানের বিক্রয়কর্মী শফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি জানালেন, সাধারণত বয়সে তরুণ ও ফ্যাশন সচেতন নারীরা এবং মডেল তারকারা তার দোকানের স্টিলেটো হিলগুলোর ক্রেতা। এছাড়াও ব্যালেন্সড যে হিলগুলো আছে সেগুলোর ক্রেতা প্রায় সব বয়সের নারীই। বিশেষত কর্মজীবী নারীরা ব্যালেন্সড হিলের প্রতি বেশি আগ্রহী। বয়স্কদের  প্রায় কেউই হিল কেনেন না। অর্থাৎ হাই হিলের সাথে শারিরীক সক্ষমতার বিষয়টিও জড়িত।

রাজধানীর ইমপালস জেনারেল হাসপাতালের অস্থিচিকিৎসা বিভাগের প্রধান ডা. পারভেজ শাহেদি জানান, নিয়মিত এবং দিনের অনেকটা সময় হিল জুতো পরে থাকলে বায়োমেকানিক্স কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। কারন যিনি হিল পরছেন তার পুরো শরীরের ভর থাকে তার পায়ের আঙ্গুলের উপর। এতে তার বুড়ো আঙ্গুল বাঁকা হয়ে যেতে পারে। যারা নিয়মিত হিল জুতো পরেন তাদের অনেকেই একটা সময় হ্যালক্স ভাল্গাস নামের একটি রোগে আক্রান্ত হন যেখানে তার বুড়ো আঙ্গুলের আকার পরিবর্তিত হয়ে যায়। এছাড়া অতিমাত্রায় হিল পরার কারনে পায়ের গোড়ালি আর পায়ের সামনের পাতার জয়েন্ট খুব খারাপভাবে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানান ডঃ শাহেদি। অনেকেই হিল পরে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়ে যান বা পায়ের গোড়ালি মচকে যায়। সব মিলিয়ে ডঃ শাহেদির মতে স্বাস্থ্যসচেতন কারোই দুই ইঞ্চির বেশি উঁচু হিল পরা উচিত নয়।

 

কিন্তু হিলের প্রশ্নে ফ্যাশন সচেতন নারীরা স্বাস্থ্যসচেতনতাকে একটু কম গুরুত্ব দেন বলেই বোধ হয়। কথা হয় পারভিন মেরির সাথে। বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেলেও তিনি প্রাণে ধরে তার হিল জুতোগুলোকে ছাড়তে পারেননি। কীভাবে হিল ম্যানেজ করেন এই প্রশ্নের জবাবে মেরি জানান, তিনি হিল জুতো পরেই অভ্যস্ত, বরং ফ্ল্যাট জুতো পরলেই তিনি অসাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার মতে হিল পরলে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি স্মার্ট মনে হয়। তবে মেরি জানান, আগে পাঁচ ইঞ্চি স্টিলেটো হিল পরতেন আর বয়স চল্লিশ পেরোনোর পর সেটি কমিয়ে তিন ইঞ্চিতে এনেছেন। আর এখন স্টিলেটো ছেড়ে ব্যালেন্সড হিল পরার চেষ্টা করেন। তারপরও কোন পার্টিতে গেলে স্টিলেটো হিল পরতেই বেশি ভালোবাসেন তিনি।

হাই হিলে সচেতনতা

কেন ফ্যাশন সচেতনরা হিল জুতোকে স্মার্টনেসের প্রতীক মনে করেন-  এই প্রশ্ন নিয়ে গিয়েছিলাম গ্রুমিং প্রতিষ্ঠান উজ্জ্বলা এবং মেকওভার সেলুন রেড এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর আফরোজা পারভীনের কাছে। আফরোজা জানান, হিল পরলে আমাদের দেহভঙ্গি (বডি পোশ্চার) খুব সুন্দর আকার ধারণ করে। যা দেখতে বেশ আকর্ষণীয় লাগে। আর তাই সৌন্দর্য সচেতন নারীরা হিলের প্রতি আগ্রহী হয়। এছাড়াও আমাদের দেশের মডেলরা যথেষ্ট লম্বা হলেও র‍্যাম্প মডেলিংয়ের আন্তর্জাতিক যে মান আমরা দেখি সেটির সাথে তাল মেলানোর জন্যে আমাদের মডেলরা পাঁচ-ছয় ইঞ্চি উঁচু জুতো পরেন। তবে আফরোজা পারভীনের মতে এই পুরো ব্যাপারটাই আসলে অভ্যস্ততা এবং ক্যারি করতে পারার দক্ষতার উপর নির্ভর করে। স্লিপার পরেও অনেকে খুব স্মার্টলি নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন।

হিল পরার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখা উচিত বলে এই গ্রুমিং বিশেষজ্ঞ জানান। বিষয়গুলো হল- খুব বেশি অভ্যস্ত না হলে তিন ইঞ্চির বেশি হিল পরা উচিত নয়, কারন অতি উঁচু হিল পরে হাটতে না পারলে ব্যাপারটা দেখতে আর স্মার্ট লাগেনা। এছাড়া হিল পরে বাইরে বেরোনোর আগে সবার উচিত যথেষ্ট প্র্যাক্টিস করে নেয়া। অনেক সময় অভ্যস্ততার অভাবে হিল পরলে অনেকেরই ঠুকঠুক করে শব্দ হয় যা স্মার্টনেসের বদলে অন্যের বিরক্তি উদ্রেক করে। তবে ভুল জুতো পরার কারনেও এই শব্দ হতে পারে। তাই হিল কেনার সময় সঠিক জুতো কেনার বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। আর বিশেষ কোন মিটিংয়ে বা পরীক্ষার হলে, যেখানে শব্দ করা অবাঞ্ছনীয় সেসব জায়গায় হিল না পরা কিংবা হিল পরে শব্দ যেন না হয় সেদিকে খুব বেশি খেয়াল করা উচিত বলে মনে করেন আফরোজা পারভীন। স্বাস্থ্যসচেতনতার দিকটিও হিল পরার সাথে অনেকখানি যুক্ত। তবে আফরোজা জানান, যারা ওভারওয়েট তারাই হিল পরে স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে পড়েন তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই হিল পরার সাধকে টিকিয়ে রাখতে হলেও আপনাকে বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেলতে হবে। এছাড়াও শারিরীক সুস্থতা বজায় রাখতে হলে যত্রতত্র এবং খুব বেশি সময় ধরে হাই হিল পরে থাকার অভ্যাস ছাড়ার কোন বিকল্প নেই।

হাই হিল পরলে সবাইকে দেখতে স্মার্ট লাগে- এই কথাটিকে ঘুরিয়ে আরো সঠিক করে বলা যায় হিল জুতো সঠিকভাবে ক্যারি করতে পারলেই কেবল হাই হিল পরলে স্মার্ট মনে হবে। নিয়ন্ত্রিত ওজন, নিয়ন্ত্রিত উচ্চতার হিল এবং সঠিক সময়- এই তিনটি বিষয়ই কেবল পারে স্বাস্থ্য সচেতনতা আর ফ্যাশন সচেতনতাকে এক বিন্দুতে আনতে।

 

 

ছবি- ইন্টারনেট

সারাবাংলা/জেএম/এসএস

হাই হিল