পোশাকে নয় শুধু, স্বাধীনতা উদযাপন হোক পাঠে, চর্চায়
২৫ মার্চ ২০১৮ ২১:০৪
শারমিন শামস্।।
মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা। বাংলাদেশ। আমাদের রক্তে মিশে আছে শব্দগুলো। আমাদের চেতনায় গেঁথে আছে এক একটি উচ্চারণ। মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করে আমরা এগিয়ে এসেছি এতটা পথ। আমাদের প্রাণের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর বিশ্বাসই একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমাদের টিকিয়ে রেখেছে।
কিন্তু আজ- এই ২০১৮ সালে- স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ ও একাত্তরের চেতনা আমাদের অস্তিত্বের গভীরে কতটা ক্রিয়াশীল? আমাদের জীবনাচরণে, দৈনন্দিনে, কর্মে, আদর্শে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে কতটা জড়িয়ে রাখতে পারছি? সন্তানদের কতটা সম্পৃক্ত করতে পারছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে? কতটা জানাতে পারছি তাদের এদেশের প্রকৃত ইতিহাস? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কতটা আমরা নিজেরাই বা জানতে চাইছি?
প্রতি বছর আসছে ২৬শে মার্চ। স্বাধীনতা দিবসের মুহূর্ত উদযাপিত হয় সবুজ শাড়িতে, পাঞ্জাবীতে, সূর্যের মত লাল টিপে। কিন্তু পোশাকের বাহারে, উৎসবের আমেজে ও দাপটে কি চাপা পড়ে যায় আমাদের চেতনা, ভালবাসা আর বিশ্বাসের অনুশীলন? আমরা কি নিজেদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে চর্চায় রাখি প্রতিদিনের জীবনে? সন্তানের হাতে কি তুলে দেই মুক্তিযুদ্ধের বই? একাত্তরের জন্য নিবেদিত কবিতামালা কি পাঠ করি কখনো? আমাদের বাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে কি বাজে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের সেইসব কালজয়ী গান? আমাদের জীবনযাত্রায় দেশাত্ববোধক গান, কবিতার চর্চা কি কি আছে? থাকে? নতুন প্রজন্মকে কি আমরা সঠিক ইতিহাস জানাতে সময় ব্যয় করি? নাকি প্রতিবার ছাব্বিশে মার্চে একটি লাল সবুজ জামা পরিয়ে সেলফি তুলে আর ফটোসেশন করেই শেষ হয় আমাদের দেশপ্রেম প্রদর্শন?
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটার এ জীবনে বই পড়াই তো কমে গেছে। যেটুকু পড়ছি, তা মধ্যে কতটা আমরা বেছে নিচ্ছি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইপত্র? সন্তানকে কি চেনাচ্ছি দেশকে? বঙ্গবন্ধুকে? সন্তানের হাতে কি তুলে দিচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের বই?
যে প্রজন্ম গড়ে উঠছে আমার আপনার হাতে, সেই প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে সবার আগে তো চাই তার জন্য ইতিহাস শিক্ষা। নিজের দেশের অতীতকে জানতে হবে তার। একইভাবে বাবা মা হিসেবে আমাদেরও জানতে হবে এদেশকে। জানতে হবে একাত্তরকে। আমাদের জ্ঞানপিপাসা সন্তানের মধ্যেও বিস্তৃত হবে। আমাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশাত্ববোধ প্রবাহিত হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের দিকে।
না, অন্ধভাবে নয়, শোনা কথায় নয়। জেনে বুঝে দেশকে জানতে হবে। দেশপ্রেমের বোধকে শক্তিশালী করতে দেশের গৌরবময় ইতিহাসকে মগজে ধারণ করতে হবে। কুতর্কে না মেতে সঠিক তথ্য নিয়ে সুস্থ চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে। একইভাবে এই চর্চার জায়গাটিতে নিয়ে যেতে হবে শিশুদের। এরাই গড়বে দেশের ভবিষ্যৎ। তাই এদের সুস্থ সুন্দর মনন তৈরি করতে হবে আমাদেরই। এর আগে নিজেদেরও তৈরি হতে হবে। এজন্য পাঠের কোন বিকল্প নাই।
নগরজীবনে বই পড়া এবং বই কেনার পরিবেশ বলতে কিছুদিন আগেও শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটই ছিল বইপাড়া হিসেবে প্রসিদ্ধ। এর বাইরে নিউমার্কেট ও বেইলী রোডের কিছু বইয়ের দোকান বইপ্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে আজ গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বুকক্যাফে। পাঠক সমাবেশ, দীপনপুর, বেঙ্গল বই, বাতিঘর তার অন্যতম। এসব বুকক্যাফেতে মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এখানে নানা ধরণের বইপত্রের সমাবেশ রাখা হয়েছে। শুরু হয়েছে অনলাইনে বই কেনাবেচা। বাড়িতে হোম ডেলিভারি দেবার সুন্দর ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তাই বইপত্র আজ আরো হাতের নাগালে।
আমাদের জীবনযাপনে বইপাঠ একটি অন্যতম সুন্দর বিষয়। এই বিষয়টি যেন আরো ডালপালা বিস্তার করে। আরো সুন্দর সাবলীল হয়ে ওঠে। নানারকম বই পাঠের সাথে সাথে দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বইকে যেন আমরা আমাদের চর্চার মধ্যে নিয়ে নিতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বিজয়কে আমরা যেন শুধুমাত্র লাল সবুজ সাজপোশাকে উদযাপনের মধ্যে সীমিত করে না ফেলি। আমরা যেন আমাদের জ্ঞানে, চিন্তায়, ভাবনায় ও বোধে ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকে নিরন্তন বয়ে নিয়ে চলি। কারন বিকৃতি, মিথ্যাচার, অপরাজনীতি, ষড়যন্ত্র আর নানা পাপাচারে এদেশের ইতিহাস নানাভাবে রক্তাত্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। আর তার প্রভাব পড়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে, চিন্তায়, যাপনে। এ থেকে মুক্তি পেতে হবে আমাদের। স্বাধীনতার যথার্থ সংজ্ঞা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখতে হবে আমাদের স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা আর একাত্তরের বেদনাকে। এ ভুললে চলবে না, নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছে। কিন্তু সেই বেদনাবিধুর নয়মাসের লড়াই যতটা কঠিন ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন এই স্বাধীনতাকে ধরে রাখা। স্বাধীনতার লাল সূর্য যেন কখনো অস্তমিত না হয়- সেই বিশ্বাস বুকে ধারণ করে যার যার অবস্থান থেকে লড়ে যেতে হবে আমাদের। লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করতে হবে আমাদের সন্তানদের। এই চিন্তা ও দর্শণ থেকেই যেন আমরা হাতে তুলে নিই বই। ইতিহাসের পাঠে নিজেরা নিমগ্ন হই। মুক্তিযুদ্ধকে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করি।
আমাদের স্বাধীনতা দিবসের উদযাপনে যেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইপত্র সংগ্রহ হয়ে ওঠে অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। একটি লাল সবুজ শাড়ি ও পাঞ্জাবীর সাথে আমরা যেন কিনে নিয়ে যাই মুক্তিযুদ্ধের দলিল অথবা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর একটি কপি। সন্তানের হাতে যেন তুলে দিই যুদ্ধদিনের গাঁথা, তাকে শুনতে দিই সেই অমর সুর যা আমাদের অস্তিত্বে মিশে আছে- সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইবো বিজয়ের গান/ ওরা আসবে চুপি চুপি/ যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ…..
ছবি- আশীষ সেনগুপ্ত
মডেল- আঁখি ভদ্র, রণদা দাস ও আরোহী অনুরাধা
স্থান- দীপনপুর
সারাবাংলা/এসএস