মানসিক প্রশান্তি আর শারীরিক সুস্থতায় মেডিটেশন
২১ মে ২০২১ ২১:০৪
বর্তমান সময়ে সারাবিশ্বের মানুষ সুস্থ থাকতে মেডিটেশন বা ধ্যান অনুশীলন করছে। মেডিটেশন নিয়ে আলোচনা এবং এর গুরুত্ব দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। কারণ মেডিটেশন অনুশীলন মন এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মেডিটেশন চর্চার ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। এর দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের দালানের ভাস্কর্য গুলোতে দেখা যায়, ধর্মীয় গুরু বা পণ্ডিতেরা চোখ বন্ধ রেখে বিশেষ ভঙ্গিমায় বসে রয়েছেন। এই ভঙ্গিমাগুলো সবই ধ্যানের প্রতীক এবং প্রমাণ। ধ্যান সুস্থতার পাশাপাশি মানুষের মনের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়। সুস্থতা নিশ্চিত করতে ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসার একটি অন্যতম থেরাপি পদ্ধতি হলো মেডিটেশন বা ধ্যান।
সুস্বাস্থ্যে ধ্যানের গুরুত্ব
মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। একটা পাওয়া পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে আরেকটা কিছু পাওয়ার ইচ্ছা জেগে ওঠে। পাওয়ার এই ইচ্ছাকে পূরণ করতে আমরা বিভিন্ন উপায়ের মধ্য দিয়ে ছুটতে থাকি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমাদের পাওয়ার ইচ্ছাগুলো আসলে আমাদের প্রয়োজন নয় বরং আমাদের ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণ বা মোহ। যেমন, মোবাইল ফোনের কথাই ধরি। কথা বলা, গান শোনা, ভিডিও দেখা থেকে শুরু করে নানা রকম পেশাগত কাজে আমরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। এর জন্য বাজারে দশ থেকে পনের হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায় এমন মোবাইল দিয়ে মোটামুটি সব ধরনের কাজ করার পরও এসব মোবাইলের প্রায় পঞ্চাশ থেকে সত্তর ভাগ জায়গা খালি থেকে যায়। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো—দেখা যায় যে, একজন ছাত্র বা গৃহিণী লক্ষ টাকার একটি আইফোন ব্যবহার করছে। যার প্রায় আশি ভাগ ফাংশনই হয়তো তার কাজে লাগছে না। এমন অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য মোহকে বাস্তবে রূপ দিতে দিতে আমরা জীবনের অধিকাংশ সময় খরচ করে ফেলি। আমরা নিজেকে বোঝার চেয়ে অন্যকে বুঝতে চাই বেশি। নিজের প্রতি সন্তুষ্ট না হয়ে অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে থাকি। মনের এই অবস্থা থেকেই আমাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি, দুশ্চিন্তা, হতাশা, অভাব, ক্ষোভ, রাগ, হিংসা, হীনমন্যতা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে আমাদের মন এবং শরীর অসুস্থ হতে থাকে। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের (চোখ, নাক, কান, জিহ্বা, ত্বক) সঠিক ব্যবহার না হলে মূলত: এই অসুস্থতা তৈরি হয়। ধ্যান পঞ্চেন্দ্রিয় গুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার হতে সাহায্য করে সুস্থ থাকা নিশ্চিত করে। ধ্যান বুঝতে সাহায্য করে যে, প্রকৃত প্রয়োজনটা কি আসলে আইফোন না অন্য কিছু।
ধ্যান অনুশীলনের মাধ্যমে মন এবং চিন্তার গতিবিধিকে বোঝা যায়। বোঝা যায় শরীরে আমাদের চিন্তার প্রভাব। নিয়মিত ধ্যান অনুশীলন করলে তাই নিজেকে বোঝা যায়। নিজের সঠিক প্রয়োজনকে উপলব্ধি করা যায়। এবং সে অনুযায়ী জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃত সাফল্য লাভ করা যায়।
সব বয়সীদের জন্য ধ্যানের একটি সহজ পদ্ধতি
অনেককেই দেখা যায়, মেডিটেশন অভ্যাস করতে অনলাইনের বিভিন্ন মেডিটেশন পদ্ধতির ভিডিও বা অডিও চালিয়ে সে অনুযায়ী ধ্যান করার চেষ্টা করে। মেডিটেশনের মূল উদ্দেশ্য এক হলেও এর অনুশীলনের অনেক রকম পদ্ধতি রয়েছে। কার জন্য কোন পদ্ধতিটি কার্যকর হবে সেটা ঠিক করে নেয়ার জন্য একজন ইন্সট্রাক্টর এর সাহায্য লাগে। আমরা সাধারণত জানি যে, সোজা হয়ে বসে কোলে বা হাঁটুতে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে মেডিটেশন করতে হয়। কিন্তু এটা একমাত্র পদ্ধতি নয়, শুয়ে এমনকি হেঁটেও মেডিটেশন করা যায়। তেমনি চোখ বন্ধ করে আমি কি করবো, কোথায় ফোকাস করবো এরও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উপায়। চোখ খোলা রেখেও ধ্যান করা যায়। আজকে সব বয়সীদের জন্য মেডিটেশনের একটা সহজ পদ্ধতি তুলে ধরছি।
আজকের ধ্যানের ধাপগুলো হলো —
১. ধ্যানের আসন: ইয়োগা ম্যাট বা একটা মাদুর অথবা কম্বলের উপর পা দুটো আড়াআড়িভাবে ক্রস করে বসা। বসার সময় মেরুদণ্ড, ঘাড়, মাথা সোজা রাখা। বসার সময় মেরুদণ্ড সোজা থাকতে হয় কারণ আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত যে জীবনী শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে তা চলাচলের প্রধান রাস্তা হচ্ছে মেরুদণ্ড। কোন পানির লাইনে যেমন কিছু আটকে গেলে পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় ঠিক তেমনি মেরুদণ্ড বাঁকা থাকলেও জীবনী শক্তির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই সোজা হয়ে বসা জরুরি। এবার হাতের তালু দুটো একটির উপর আরেকটি রেখে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করা। এটা ধ্যানের একটি সহজ আসন যা সব বয়সী মানুষের জন্য উপযোগী।
২. মনঃসংযোগ করা: এবার দুই ভ্রুর ঠিক মাঝখানে যে জায়গাটা রয়েছে চোখ বন্ধ অবস্থায় সেখানে ফোকাস করা। পুরো মনোযোগ এই কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা। এখানে মনোযোগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোমবাতির উপর জ্বলতে থাকা আগুনের শিখার মতো কমলা রঙ্গের ঢেউ দুলতে দেখা যাবে অথবা একটা হলুদ বা কমলা রঙ্গের আলোর রশ্মি বড় ছোট হতে দেখা যাবে। স্থির হয়ে বসে শুধু সেখানে ফোকাস করে যেতে হবে।
৩. চিন্তা পর্যবেক্ষণ করা: এবার ধীরে ধীরে মনের মধ্যে চলতে থাকা চিন্তাগুলোকে লক্ষ্য করা। নানা ধরনের চিন্তা আসতে যেতে থাকবে। কোন চিন্তাকেই ধরবো না, পড়বো না, বুঝবো না। একটার পর একটা চিন্তা আসবে আর যাবে শুধু স্থির হয়ে বসে দেখে যাবো। সিনেমার পর্দায় যেমন চিত্র ভেসে বেড়াতে থাকে তেমনি চিন্তাগুলো একটার পর একটা ভেসে যাবে। শুধু দর্শক হয়ে থাকতে হবে, নিয়ন্ত্রক নয়।
উপরের এই ধাপগুলো অনুসরণ করে ধ্যান শুরু করে নিয়মিত অনুশীলন করে গেলে কয়েকদিনের মধ্যেই নিজের মধ্যে হতে থাকা ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারা যায়।
ধ্যানের প্রস্তুতি
·সময়: ধ্যান করার সবচেয়ে ভালো সময় হলো সকালে সূর্য ওঠার আগে এবং বিকেলে। সময়টা সকাল চারটা অথবা বিকেল চারটা। এই সময়গুলোতে সূর্য এবং পৃথিবী ষাট ডিগ্রী কোণে অবস্থান করে। এই অবস্থান ধ্যানে নিমগ্ন ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে দিনের অন্যান্য সময়ও ধ্যান করা যায়।
·পরিবেশ: কোলাহল মুক্ত নিরিবিলি ঘর বা খোলা জায়গা হলো ধ্যানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। যেমন, জানালা খোলা ঘর, বারান্দা, ছাদ অথবা পুকুর বা নদীর পারে। ঘর বা জায়গাটা হতে হবে এমন যেখানে বাতাস চলাচল করে। গুমোট কোন জায়গা ধ্যানের জন্য উপযুক্ত নয়।
মৃদু আলোর বাতি জ্বালিয়ে বা বাতি নিভিয়ে ধ্যান করলে মনঃসংযোগ করা সহজ হয়।
·পোশাক: ধ্যান করার সময় সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পড়া ভালো। সুতির পোশাকে শরীরের তাপমাত্রার রেগুলেশন ভালো হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধ্যান করা অবস্থায় মহাবিশ্বের শক্তির সঙ্গে ব্যক্তির শরীরের শক্তির আদান-প্রদান হয়। সুতির ঢিলেঢালা পোশাকে এই আদান-প্রদান সহজে হতে পারে।
·খাবার: একবারে খালি পেটে বা খুব ভরা পেটে মেডিটেশন করতে হয় না। মেডিটেশন শুরু করার আগে পানি বা ফলের জুস খেয়ে নেয়া যেতে পারে। ফল বা বাদাম এরকম হালকা খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণ পর ধ্যান করা যায়।
·ধ্যানের স্থায়িত্বকাল: ধ্যান করার সময় নিয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। বলেন যে, আমিতো ধ্যানে মনোযোগ দিতেই পারি না এক বা দুই মিনিট বসাই কঠিন হয়ে যায়। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। শুরুর দিকে দুই মিনিট বসতে পারা মানে ধ্যান হচ্ছে না এমন নয়। দুই মিনিট থেকেই ধীরে ধীরে পাঁচ মিনিট তারপর দশ মিনিট এরপর ধীরে ধীরে ত্রিশ মিনিটও বসা যাবে। শুধু ধৈর্য ধরে নিয়মিত ধ্যানে বসার প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে হবে।
নিয়মিত মেডিটেশন অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ নিজের লক্ষ্য স্থির করতে পারে এবং সেখানে পৌঁছাতে পারে। ধ্যান অনুশীলন মানুষকে যেমন সাফল্য এনে দেয় তেমনি নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা যেমন অনিদ্রা, পেটের অসুখ, হার্টের অসুখ, হরমোনাল সমস্যা সহ দুশ্চিন্তা, হতাশা কাটাতে সাহায্য করে। ধ্যান মানুষকে বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। করোনা মহামারির সময়ে স্কুল কলেজের ছাত্ররা দীর্ঘ সময় সহপাঠী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবহ থেকে দূরে থাকার কারণে মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত হয়ে খিটখিটে মেজাজ সহ নানা ধরনের মানসিক এবং শারীরিক রোগ ব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। শ্রমজীবীরা আর্থিক অনিশ্চয়তায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে হতাশা, হাইপারটেশনে আক্রান্ত হচ্ছে। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দূরত্ব, আপনজনের মৃত্যুতে কাছে যেতে না পারার ফলে অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে মানসিক অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। মহামারির এই কঠিন সময়ে সুস্থ জীবন যাপনের জন্য মনকে শান্ত রেখে বাস্তবিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ধ্যান একটি অন্যতম উপকারী উপায়। বিশ্ব মেডিটেশন দিবস হোক সকলের মানসিক প্রশান্তি আর শারীরিক সুস্থতার উৎসাহ।
সারাবাংলা/আরএফ