(পর্ব- ১৬) ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কি বা মৃদু বায়
২৯ মার্চ ২০১৮ ১৭:৫২
বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর দেশ। বারো মাসে তেরো পার্বনের দেশ। লাল সবুজ পতাকায় ঢাকা দেশ। তিরিশ লাখ শহীদের রক্তে রাঙানো দেশ। মাটি আর ধূলিকণায় মিশে থাকা প্রতিটি বিন্দুতে সে রক্ত মিশে আছে। এই মাটি আমার পরিচয়, স্বজন আর পরিবারের আবাস। দেশের মাটির প্রতি অন্ধ এক ভালোবাসা আমাকে ছাদবাগান করতে উৎসাহী করেছে। এগারো তলার ছাদে ড্রাম আর টবে যখন মাটি ভরছিলাম তখন মনে মনে ভেবেছিলাম, পুরো বাংলাদেশটাকেই ছাদে নিয়ে এসেছি। যখন মন চাইবে, তখনই দেশকে ছুঁয়ে দিতে পারবো পরম মমতায়, মাটিকে স্পর্শ করে।
নগর চাষীর কলাম পড়তে থাকলে দেখবেন যে আমি আপন স্মৃতি থেকে ষড়ঋতুকে মাথায় রেখে ছাদবাগানে চাষাবাদ করেছি। বাংলাদেশের মাটি বারো মাসকে কেন্দ্র করে ফল ধরায়, ফুল ফোটায় এবং শষ্য ফলায়। চাষাবাদে নামতে হলে সবচেয়ে আগে তাই জেনে নিতে হয় ষড়ঋতুর আচার ব্যবহার। যদিও বা আজকাল আমাদের দেশে হাইব্রীড ফল, ফুল বা শষ্যের প্রচলন বেশি, তারপরও এই সব কিছুই কোথাও গিয়ে ঋতুকে ভর করেই তাদের বেড়ে ওঠা অব্যাহত রাখে।
আমার ছাদবাগানের ফুলের চাষাবাদ একদম ফাগুন মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত সাজানো। বাদবাকি মাসগুলো শীতকালীন স্বল্প সময়ের ফুল চাষ করে থাকি। তবে ফলগাছ বা শষ্য হলেও তাদের ফুল দেখবার আগ্রহটাও কম নয় আমার। আবার কিছু ফুল বা ফলের গাছ মায়ের অনুরোধে দত্তক আনতে হয়েছে। তিনি হঠাৎ করে বলে ওঠেন, ওই ফুলটা দেখতে মন চায়। আমি নার্সারি ঘুরে ঘুরে তা আনবার চেষ্টা করি, যতটা পারি।
বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়। বলবার কারণও আছে। ফাগুন আসবার আগ থেকেই ব্লিডিং হার্ট বা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ফুল ফুটতে থাকে। সাথে থাকে সারা বছর টুকটুক করে ফুটে থাকা অপরাজিতা, গ্রাউন্ড অর্কিড, নয়নতারা, কাঁটা মুকুট, কাঁটা মেহেদী, টগর, জবা। শরতের শিউলী ফোটা শেষ হয়ে আবারও নতুন ডালপালা মেলা শুরু করে। ফাগুন শেষ না হতেই থোকা থোকা লাল রঙ্গনের কুঁড়িতে ভরে ওঠে ছোট গাছটা। সাথে শিউলী ফুটতে থাকে অবিরাম।
চৈত্র আসে, হলুদ আর গাঢ় গোলাপী বাগানবিলাস সবুজ পাতাকে ঢেকে নিজেদের রঙে ভরিয়ে রাখা শুরু করে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রিয় ফুলগুলোর মাঝে এই বাগানবিলাস একটি।
ঠিক তার পাশেই গাঢ় সোনালী রঙা থোঁকায় থোঁকায় স্বর্ণপ্রভা আমার ছাদবাগানের কোনটিকে রাঙিয়ে তোলে। আরেকদিকে ফুটতে শুরু করে নানা রঙা লিলি। সাদা, গোলাপী, লাল, কমলায় ভরে থাকে সেদিকটা। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এ সময়ে সারা বছর খটখটে কাঁটাময় ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কমলা মরু গোলাপ বা মোম গোলাপ অপরূপ কমলা রঙে পুরো গাছটা ভরিয়ে ফেলে।
সত্যি বলতে বছরের এ সময়গুলো ছাদবাগানের শ্রেষ্ঠ সময় বলে মনে করি আমি। দেড় হাজার স্কয়ার ফুটের প্রায় প্রতিটি দিকে তাকালেই, কোন না কোন ফুল ফুটে থাকতে দেখা যায়।
বৈশাখ আসতে আসতে বেলী, টগর, হাস্নাহেনা, কুন্দ, মাধুরীলতা আর স্পাইডার লিলি, টাইগার লিলি তাদের প্রত্যেকের সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয় ছাদবাগানে। বৈশাখ শেষ না হতেই মে ফ্লাওয়ার বা বল লিলি উঁকি দিতে থাকে তাদের মাথা উঁচু করে। এ সময়ে খানিকটা বৃষ্টি শুরু হলে পুরো বর্ষা জুড়েই বিভিন্ন রঙের রেইনলিলি ফুলের আগমণ ঘটে। সাথে প্রাণ ভরিয়ে দেয়া দোঁলনচাঁপা তো ফুটতেই থাকে একেবারে শীত না আসা পর্যন্ত।
লাল আর হলুদ কলাবতী বর্ষায় বেশী ফোটে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি আরো একবার দেখা যায় তাদের। কাঠগোলাপ আর থাই গোলাপ চৈত্র মাস থেকে একদম বর্ষা পর্যন্ত ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকে।
ছাদবাগানের এ্যারোমেটিক জুঁই নামের লতানো ফুল গাছটি অদ্ভুত এক মায়াময় সবুজ পাতায় ভর করে করে শত শত সাদা জুঁই ফুঁটিয়ে থাকে, বছরে চারবার। ঠিক একই চরিত্রের আরো দুটো লতানো গাছ হচ্ছে ঝুমকোলতা এবং নীল চিতা। ঝুমকোলতা আমার দুই রঙের আছে। বেগুনী আর লাল। এর সাহেবী নাম ‘শঙ্খ গদা চক্র পদ্ম’। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ফুল এই ঝুমকো এবং নীল চিতা।
পৌষে আমি শীতের ফুল দত্তক আনি। গাঁদা, কসমস, ক্রিসেন্থিমাম, সূর্যমূখী, পিটুনিয়া। এরা তাদের স্বল্প সময়ের জীবনে মনের মাধুরী মিশিয়ে ছাদবাগানকে নানা রঙে এঁকে রাখে সেই মাসগুলো। তবে এই সময়ে ড্রেসিনিয়া এবং অগ্নিস্বর নামের পাতাবাহারও অদ্ভুত সুন্দর ফুল ফোঁটায়। পাতা ঝরে যায়। বসন্তের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকে, নতুন পাতার জন্য।
ফলের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর ফুল ফোটায় পেয়ারা, জামরুল, আলুবোখারা আর কামরাঙা। আর বেশিরভাগ শাকের ফুল হলুদরঙা হয়ে থাকে। সবজির মাঝেও হলুদ ফুলের সংখ্যা বেশি। কুমড়া, স্কোয়াশ, ধুন্দল, শশা এর মাঝে পরে। লাউ, চিচিংগা, ঝিঙে, চালকুমড়া ফুল সাদা হয়। শিমের ফুল বেগুনী আর ঢেঁড়স ফুল হলুদ খয়েরী রঙের সংমিশ্রনে ফুটে থাকে।
ষড়ঋতুর বারো মাস ছাদবাগানে ফুলের বাহার দেখতে হলে একটুখানি আমার মতন চিন্তা করে গাছ দত্তক নিলেই বাগান রঙীন হয়ে থাকবে।
ছয় বছর ধরে একটু একটু করে আমি আমার ভালোবাসার চাষাবাদ করে আসছি। এখন আমার বাগানে ফল, ফুল আর সবজি মিলিয়ে ২৮ রকমের ফুল ফুটছে রোজ। বসন্তরাজ তার অপার্থিব চমক দেখাচ্ছে। চাষী জীবনে এর চেয়ে সুন্দর ফসল আর কী বা হতে পারে!
চাষী পরিবার, সুখী পরিবার।
সারাবাংলা/এসএস