আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা- চারুকলার রঙিন প্রস্তুতি
৩১ মার্চ ২০১৮ ১৬:০২
।। কাজী সানজিদা রহমান।।
বাংলা বছরের শেষ মাস চৈত্র । প্রচণ্ড গরম আর ক্লান্তি অবসাদ, বিষাদ, জরাজীর্ণ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বিদায় বেলায় বৈশাখের আগমনী প্রার্থনায় চৈত্র আহবান জানায় ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’।
বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম একটি উৎসবের নাম পহেলা বৈশাখ। এপার ও ওপার বাংলার বাংলা ভাষাভাষীরা এই উৎসব উদযাপন করে।
প্রতিবছর চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় এই উদযাপনের প্রস্তুতি। তাই পহেলা বৈশাখের আয়োজন থাকে গ্রাম শহরে- সবখানে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত মঙ্গলশোভাযাত্রা। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখকে ঘিরে চারুকলা নানা আয়োজন করলেও মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই মঙ্গল শোভাযাত্রা।
পহেলা বৈশাখের শুরুর কথা
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় ( ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন। পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলাবর্ষ নামে পরিচিত হয়।
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। সম্রাটের নিয়ম অনুযায়ী প্রজারা সারাবছরের খাজনা, শুল্ক পরিশোধে বাধ্য থাকত এবং নতুন হালখাতা তৈরির লক্ষ্যে বৈশাখ মাসের পহেলা তারিখে একটি ঘরোয়া আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে মিষ্টান্ন বিতরন এবং নাচ গানের আয়োজন করা হত। নতুন বছর উদযাপনের রীতি ছিল এমনই। যদিও আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোমকীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও একই কাজের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
বর্তমানে ধারা পরিবর্তন হলেও হালখাতার বিষয়টি এখনো অপরিবর্তনীয়। সম্রাটের আমলে মঙ্গল শোভাযাত্রার যদিও কোন চল ছিল না, তবে গত কয়েক দশক ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়া যেন পহেলা বৈশাখ চিন্তাই করা যায় না ।
মঙ্গল শোভাযাত্রা কি?
ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি নান্দনিক অংশ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে আবার চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রার মূল উদ্দেশ্য থাকে গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে সাধারণ মানুষের কাছে ফুটিয়ে তোলা। শোভাযাত্রায় সব শ্রেণি পেশা বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় নানা রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি যেমন- পেঁচা, ঘুঘু, বাঘ, পাখি ইত্যাদি।
১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে এখন পর্যন্ত পালিত হয়ে আসছে।
চারুকলায় এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি
গত ১৫ মার্চ থেকে স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবীর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেছে এবারের পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি । প্রতিবছর মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য লালনের বিখ্যাত উক্তি- ‘‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’’।
শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে চারুকলার সকল ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহন থাকলেও প্রতিবছর একটি ব্যাচ নেতৃত্ব দেয়। এবার নেতৃত্বে রয়েছে ২০তম ব্যাচ।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় কিছু ছোট বড় মাসকট এর ব্যবহার থাকে, যেমন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী রূপচিত্র- বাঘ, পেঁচা,পাখি ইত্যাদি।
পুরো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সফল করার জন্য আয় ব্যয়ের তো কিছু হিসেব থাকেই। তাই মাটির সরা, মুখোশ তৈরি করে বিক্রি কেরতে শুরু করেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এসব বিক্রির টাকা থেকেই উঠে আসে মঙ্গলশোভাযাত্রার ব্যয়।
চারুকলায় শিক্ষার্থী আদিল হাসনাত বলেন, প্রতিবছর এই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতির জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি। আমাদের কাছে রাত দিন কোন হিসেব থাকেনা। এই প্রানের শোভাযাত্রাকে সার্থক করতে আমাদের পুরোটা ঢেলে দেই।
চারুকলা অনুষদে ঢুকতেই প্রস্তুতি চোখে পড়ে। সাধারন দর্শনার্থী যেন কিনতে পারেন সে জন্য এই আয়োজন উন্মুক্ত থাকে সকাল ১০ থেকে রাত ১০ পর্যন্ত। ৫০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় মাটির তৈরি সরা, কাগজের মুখোশ। চারুকলার আরেক শিক্ষার্থী আবু সুফিয়ান বলেন, সাধারণ মুখোশের দাম ২শ থেকেএক হাজার টাকার মধ্যে হয়। এছাড়া পেপারম্যাশ নামে এক ধরনের মুখোশ তৈরি করা হয়, যার থিম থাকে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী রাজা রানী, সূর্যরানী, টেপা পুতুল ইত্যাদি। এগুলো পাওয়া যাবে ৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে।
প্রতিবারের মত ইংরেজি বছর এপ্রিলের ১৪ তারিখেই পড়ছে বৈশাখের প্রথম দিনটি। সাদা লাল পোশাক পরা নারী পুরুষ শিশুরা চারুকলা ঘিরে উৎসবে মেতে উঠবে। উৎসবে মুখর থাকবে শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত এলাকা। রোদ তাপ গরম উপেক্ষা করে বাঙ্গালি ঝরঝরে, চনমনে থাকে এই একটি দিনে।
চারুকলার নান্দনিক উপস্থাপন বৈশাখের আনন্দকে অনায়াসে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। কেউ দলবেঁধে আড্ডায় মেতে উঠতে পারে চারুকলার বকুতলায়। আবার হয়ত কেউ বাদাম চিবুতে চিবুতে চলে যেতে পারে ছোট ‘পন্ডে’র পাশে ঠাণ্ডা শীতল পরিবেশে। চারুকলা এমন একটি প্রশান্তির জায়গা যার ছায়া সুনিবিড় এবং নান্দনিক পরিবেশে কাটিয়ে দেওয়া যায় বৈশাখের সকাল বিকেল।
পুরনো বছরের সকল জরাজীর্ণ স্মৃতি ভুলে নতুনের হাতছানি আসে বৈশাখে। এই আহ্বান হোক নির্মল ও মঙ্গলময়। বৈশাখের যাত্রা শুরু হোক মানুষের আনন্দময় উদযাপনের মধ্যদিয়ে।
আলোকচিত্র- আশীষ সেনগুপ্ত
সারাবাংলা/এসএস