মেনোপজ – নারীর জীবনের বিশেষ অধ্যায়
১ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:৩২
ফারহানা ইন্দ্রা।।
ক্লাস নেয়ার সময় হঠাৎ করেই ৫৩ বছর বয়সী আফরোজা অনুভব করলেন তার সারা শরীরের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো কি যেন হলো! সাথে তীব্র গরমের অনুভূতি, ঘাম। আজই প্রথম নয়। এখন প্রায়ই এমন হচ্ছে। নিজেকে সামলে ক্লাস নেয়ায় মন দেয়ার চেষ্টা করলেন তিনি।
গৃহিনী শাহানার বয়স ৪৭ চলছে। আজকাল অল্পতে মেজাজ হারাচ্ছেন, সাথে শরীরে প্রচন্ড জ্বালাপোড়া। নিজেকে কেমন যেন ফেলনা মনে হচ্ছে তার। সবাই নিজের মতো করে ব্যস্ত, কারও যেন তার প্রতি নজর নেই। নিজের বয়স হিসাব করে তার মনে হলো স্বামীর সাথে আলোচনা করে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার।
তানিয়া একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় পদে চাকুরি করেন। বয়স ৪২। খুবই স্বাস্থ্য সচেতন, নিয়মিত জিম করেন। এই বয়সেও তাই ত্রিশের বেশি মনে হয় না তাকে। ইদানীং তার রাতে একদমই ঘুম হচ্ছে না। কোমরের হাড়ে ব্যথা, পিরিয়ড অনিয়মিত, প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। এসব নিয়ে কারও সাথে কথা বলবেন কিনা ভেবে পাচ্ছেন না।
এই তিনজন ভিন্ন বয়সের নারী একই সমস্যার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকগুলো শারীরিক অসুবিধার জন্য দায়ী এই সমস্যাকে বলা হয় ‘মেনোপজ পূর্ববর্তী অবস্থা’।
মেনোপজ কি?
সহজ ভাষায় মেনোপজ হচ্ছে নারীদের পিরিয়ড স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। মেয়ে শিশুর জন্মের সময়েই নির্দিষ্ট সংখ্যক ডিম্বাণু জরায়ুতে জমা থাকে। প্রতিমাসে পিরিয়ডের সাথে অনিষিক্ত ডিম্বাণু বের হয়ে যাওয়ায় সঞ্চিত ডিম্বাণুর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। এভাবে কমতে কমতে ডিম্বাণুর সংখ্যা একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার অবস্থাকেই ‘মেনোপজ’ বলে।
কোন বয়সে হয়?
এ দেশের আবহাওয়ায় সাধারণত ৪৮ থেকে ৫৪ বছর বয়সে নারীদের মেনোপজ হয়। গড় হিসাব করলে এটাকে ৫১ বছর ধরা যায়। অনেকের অবশ্য আর্লি মেনোপজ হয়ে থাকে। সেটার নির্দিষ্ট বয়স নেই, তবে সাধারণত চল্লিশোর্ধ হবার পরেই হয়। আর্লি মেনোপজ জেনেটিক্যালি হয়ে থাকে। অর্থাৎ বংশের মা, খালা, নানির থেকে প্রাপ্ত জিনোমের জন্য আর্লি মেনোপজ হয়। অসুস্থতা জনিত কারণে অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করা হলে সেটাকে সার্জিক্যাল মেনোপজ বলে।
মেনোপজের লক্ষণ
মেনোপজের সাধারণ কিছু লক্ষণ হলো লম্বা সময় ধরে পিরিয়ড অনিয়মিত থাকা, শরীরের বিভিন্ন হাড়ের জয়েন্টে ব্যাথা, রুক্ষ্ম মেজাজ, হট ফ্ল্যাশ, দেহের মধ্যভাগে হঠাৎ করে চর্বি জমা, ঘুম একেবারে কমে যাওয়া ইত্যাদি। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া, নিজেকে ফেলনা ভাবা, অল্পতে মুড বদল হওয়া, নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা ইত্যাদি হচ্ছে মেনোপজের মানসিক লক্ষণ।
মেনোপজ নিয়ে কথা হচ্ছিলো মিরপুরের আল হেলাল হসপিটালের গাইনোকলোজিস্ট ডাঃ জাহানারার সাথে। তিনি জানালেন, ‘নারীজীবনের শারীরবৃত্তীয় পর্যায় হলো চারটি। ঋতুচক্রের শুরু, প্রসব, প্রসব পরবর্তী সময় এবং মেনোপজ। প্রতিটি পর্যায়েই ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নামক দুটি হরমোনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। মেনোপজের সময় আসন্ন হলে এই হরমোন নিঃসরণ কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যায়। এই হঠাৎ পরিবর্তন শরীর মানতে পারে না, তাই সাময়িকভাবে নানান রকম উপসর্গ দেখা দেয়। এই পরিবর্তন ন্যাচারাল বলে একসময় শরীর মানিয়েও নেয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উপসর্গ দেখা দেওয়ার সময়টুকু। তখন পরিবারের সদস্যদের এ ব্যাপারে সচেতন, ধৈর্য্যশীল ও যত্নবান হতে হবে।‘ তিনি আরও জানান ব্যক্তিভেদে কমবেশি হটফ্ল্যাশ, খিটখিটে মেজাজ, মানসিক অবসাদ, বিষণ্ণতা, অল্পতে হাপিয়ে উঠা, ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস, চুলকানি এসবই মেনোপজের লক্ষণ। এসবের পাশাপাশি কখনো শরীর থেকে গরম হল্কার মতো বের হবে, কখনো প্রচন্ড ঘাম হবে কিংবা হাত পা জ্বালাপোড়া করবে।
মেনোপজের প্রভাব
মেনোপজের শারীরিক ক্ষতিকারক প্রভাব হচ্ছে ‘অস্টিওপোরোসিস’ বা হারক্ষয়। এ সময় শরীরে ক্যালসিয়াম কমতে থাকে বলে নারীর কোমরের হাড় কমজোরি হয়ে যায়। খুব সামান্য আঘাতেই তখন বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কোমর এবং শরীরের নীচের দিকের হাড় দূর্বল হয়ে যাওয়ায় মেনোপজের সময় বেশিরভাগ নারী কোমর ব্যাথায় ভোগেন।
মেনোপজের শারীরিক সমস্যাগুলো অনেক অস্বস্তিকর হলেও মনের উপরই এর প্রভাব বেশি। বেশিরভাগ নারী এসময়ের পরিবর্তন মেনে নিতে পারেন না। নানারকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের দেশে সাধারণত পুরুষদের স্ত্রীর মেনোপজ সম্পর্কিত বিষয়ে যথাযথ ধারণা না থাকায় এ সময়ে দাম্পত্য কলহ বাড়ে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বড় ধরনের ঝগড়া হয়, মনোমালিন্য ঘটে। সন্তানদের সাথেও দূরত্ব তৈরি হয়। বাল্যকাল থেকে চলে আসা অভ্যস্ততা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নারীদের মাঝে শূন্য অনুভূতি, কি যেন নেই, জীবন থেকে কিছু হারিয়ে গেলো, বুড়িয়ে গেলাম এইসব মানসিক দুশ্চিন্তা দেখা দেয়।
ভালো থাকার মূলমন্ত্র
মেনোপজ নিয়ে বেশিরভাগ নারী অসচেতন থাকেন বলে হুট করে উপসর্গ দেখা দিলে নিজেরা খেই হারিয়ে ফেলেন। নিজেকে নিয়ে সচেতন থাকলে, নিজের প্রতি যত্নবান হলে এই সমস্যা স্বাভাবিকভাবে মোকাবেলা করা যায়। বেশিরভাগ নারী সংসার, সন্তান, পারিবারিক দায়িত্ব এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে নিজের দিকে তাকানোর খুব একটা সময় পান না। এসব কারণেই মেনোপজের সময় তারা অনেক বেশি ভেঙ্গে পড়েন।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রথমেই নিজেকে ভালোবাসতে হবে। শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজের জন্য আলাদা করে কিছুটা সময় রাখতে হবে, নিজের যত্ন করতে হবে। নিজের সমস্যা বুঝে মেনোপজের সময় দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি বাগান করা, লেখালেখি করা, সূচিকর্ম করা, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া, নিজের কোন অপূর্ণ শখ পূরন করা ইত্যাদি কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে মানসিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠা অনেকাংশেই সম্ভব।
মেনোপজের কারণে সৃষ্ট সমস্যার চিকিৎসা
যেহেতু মেনোপজ একটি প্রাকৃতিক পরিবর্তন তাই শরীর ধীরে ধীরে এই পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়। সাধারণত তিন থেকে চারবছরের মাঝে শরীর মেনোপজ পরবর্তী অবস্থার সাথে অভ্যস্থ হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘসময় পরেও যদি শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যা দূর না হয় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া আবশ্যক। ডাঃ জাহানারা জানান, ‘হটফ্ল্যাশ, নাইট সোয়েট, ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস, চুলকানি এসব শারীরিক সমস্যার জন্য ঠিকমত চিকিৎসা দরকার। প্রয়োজনে হরমোন ট্রিটমেন্টও করা হয়ে থাকে। ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোনের ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যাগুলো হয় বলে এসব হরমোন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সমস্যা কমিয়ে আনা যায়। তবে হরমোনের ট্রিটমেন্ট বেশ খরচের এবং সময়সাপেক্ষ।’
তিনি আরোও জানান, মেনোপজের সময় নারীদের মানসিক সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে সেটাকে ‘এম্পটিনেস সিনড্রোম’ বলে। এমন সমস্যা হলে অবশ্যই মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে প্রপার কাউন্সিলিং করা দরকার। সেই সাথে পরিবারের সকলের আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতামূলক ব্যবহার মানসিক সমস্যা দূর করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মেনোপজে খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম
মেনোপজের সময় শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়। তাছাড়া পরিণত বয়সে চাইলেও সব ধরণের খাবার খাওয়া যায় না। তাই এ সময় পুষ্টিকর খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার নিয়মিত খেতে হবে। কিডনি বিন, হোলগ্রেইন চালের আটা, লাল চালের ভাত, মুরগির মাংস, কলিজা, ব্রোকলি, সবুজ শাকসব্জি, গরুর দুধ এসব পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায়।
ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স খাওয়া যেতে পারে। অতি অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এতে শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি ত্বকও ভাল থাকবে। হরমোনের পরিবর্তন ঘটায় এ সময় অনেকের দেহের মধ্যভাগে মেদ জমে। এটা দূর করতে নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে, কিংবা ঘরে বসেই করা যেতে পারে বিভিন্ন ধরনের ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ।
পরিবারের দায়িত্ব
মেনোপজের সময় হওয়া শারীরিক ও মানসিক অসুবিধার সময় পরিবারের সবাইকে নারীদের ব্যাপারে অধিকতর যত্নশীল হতে হবে। বিশেষ করে স্বামী ও সন্তানদের এই বিষয়ে সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ বিষয়ে গৃহিনী শাহানা জানান, ‘যখন বুঝতে পারলাম মেনোপজ শুরু হচ্ছে তখন পার্টনারের সাথে শেয়ার করলাম। যথেষ্ট সাপোর্ট পেলাম। নিজের পরিবর্তনগুলো তাই খুব বেশি অস্বস্তিকর বা বিরক্তিকর মনে হলো না। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস আগে থেকেই ছিলো। নতুন করে ব্যায়াম শুরু করলাম। নিজের পছন্দের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে লাগলাম।’
মেনোপজ মানেই কি যৌনজীবনের শেষ?
বহুল প্রচলিত এই ধারণাটি একেবারেই উড়িয়ে দিলেন ডাঃ জাহানারা। মেনোপজের সময় হরমোনের ঘাটতির কারণে ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া এই সময়ে ছোট বাচ্চার দায়িত্ব কিংবা সার্বক্ষনিক তটস্থ থাকা লাগে না বলে যৌনজীবন হতে পারে নির্বিঘ্ন। গর্ভধারনের ভয় থাকে না বলে স্বামী স্ত্রী দুইজনই নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পার্টনার যথাযথ সাপোর্ট দিলে এই সময়ে আনন্দময় যৌনজীবন উপভোগ করা সম্ভব।
মেনোপজ নারীজীবনের স্বাভাবিক একটি অবস্থা। যদিও অসেচতনতার কারণে অনেকেরই পরিবর্তিত শারীরিক অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়, তবুও এখনকার ব্যস্ত নারীদের এ নিয়ে বিলাপের সময় নেই। ‘বুড়ি হয়ে গেলাম, জীবন থমকে গেলো’- এই ভাবনার দিন ফুরিয়েছে। এখনকার আধুনিক নারীরা নিজেদের শরীর নিয়ে অনেক সচেতন। তারা নিত্য কাজের পাশাপাশি নিজেদের জন্যও আলাদা সময় বের করে নেন। পাশাপাশি সচেতন, সাপোর্টিভ পার্টনার তাদের মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। আজ তাই অনেক নারীই মেনোপজের সময়টা সুস্থতা ও আনন্দের সাথে অতিক্রম করতে পারছেন।
মডেল- রুখসানা কাঁকন
আলোকচিত্র (ফিচার ফটো)- সাকী চৌধুরী
সারাবাংলা/এসএস