বৈশাখী সাজ- গলায় দিলাম বড়ওওওও… মালা
১১ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:১৪
জান্নাতুল মাওয়া।।
ফ্যাশন জগতে এখন একটা খুব মজার বৈচিত্র্যময় সময় চলছে। এই বৈচিত্র্যের ছোঁয়াচ ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ গলার মালায়ও লেগেছে। দোকানে গেলে হরেক রকমের যে মালা দেখা যায়! অনেক সময় বাছতে গিয়ে দোটানায় পড়ে যেতে হয় ক্রেতাকে। এখন একেবারে গলাকে প্যাঁচিয়ে ধরে ঝুলে থাকা চোকারের পাশাপাশি সমানতালে চলছে গলা থেকে পেট পর্যন্ত ঝুলে থাকা লম্বা লম্বা মালা। বিশেষত যারা আজকাল নিজেদেরকে আর সবার চেয়ে একটু ইউনিকভাবে উপস্থাপন করতে চান তাদের গয়নার বাক্সে লম্বা গলার মালা দেখা যাবেই। এই লম্বা মালাগুলো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
১৮৮০ সালের একটি স্থিরচিত্রে দেখা যায় এক বাঙালি নারী গলায় স্বর্ণের লম্বা মালা পরে আছেন। এছাড়া আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে লম্বা পয়সা মালা পরে আসছেন। মজার ব্যাপার হল আদিবাসীদের পয়সা মালাগুলো মূলত তাদের আভিজাত্যের প্রতীক ছিলো। এই পয়সাগুলো বানানো হত রূপা দিয়ে। আর আদিবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী যে যত ধনী তার মালা তত লম্বা হতে থাকতো। এখন সেই রূপার পয়সার যুগ গত হয়েছে। তবুও অনেক ফ্যাশন সচেতন মেয়েকেই দেখা যায় নকল রূপায় তৈরি এই আদিবাসী মোটিফের লম্বা মালাগুলো পরেন।
আগেই বলেছি ফ্যাশনে এখন বৈচিত্র্যের যুগ চলছে। কোন একটা ট্রেন্ড ধরে কেউ বেশিদিন বসে থাকছেনা। প্রায় সব ট্রেন্ডই পাল্লা দিয়ে চলছে। মালার আকারের সাথে সাথে মালার ম্যাটেরিয়ালেও সেই বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু সোনা আর রূপার জগত থেকে ফ্যাশনেবল নারীরা বেরিয়ে এসেছেন অনেকদিন হল। এখন গলার বড় মালায় পুঁতি, বিডস, কাঠ, রুদ্রাক্ষ, মুক্তা, তামা, সুতো, কাপড়, গোল্ডপ্লেটসহ চলছে বাহারি ডিজাইন।
প্রতিদিনের বাইরে যাবার জন্যে যারা বড় মালা বেছে নিতে চান তারা মুলত এক লহরির ছোট ছোট পুঁতির লম্বা মালা বা বিডসের মালা বেছে নেন। এই লম্বা মালার সুবিধা হল অনেক সময় চাইলে একে দুই প্যাঁচ দিয়ে ছোট করেও পরা যায়। এরকম পুঁতির লম্বা মালা গুলো পাওয়া যায় ধানমন্ডির মেট্রো শপিং মলের গাঁও গেরামে। গাঁও গেরামের বিক্রয়কর্মী এনায়েত হোসেন জানান, অনেকেই শাড়ির সাথে পরার জন্যে এরকম লম্বা দুই তিনটি পুঁতির মালা নিয়ে যায় এবং একসাথে তিনটিই পরে। আবার অনেকেই পশ্চিমা পোশাকের সাথে একটা চিকন মালাও পরে। পুঁতির এই মালাগুলোর দাম ১শ ৪৩ টাকা।
নিউ মার্কেটেও বেশ কয়েকটি দোকানে পুঁতির আর বিডসের মালা পাওয়া যায়। নিউ মার্কেটের একটি দোকানে দেখা মিললো বেশ ভারি পুঁতির হার যাতে আট থেকে দশটি চিকন পুঁতির মালা ব্যবহার করা হয়েছে। বিক্রয়কর্মী কামাল জানালেন, এই মালাগুলো ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। এগুলোর দাম ৫শ টাকা। বাংলাদেশের ম্রো আদিবাসীদের কেংশ মালাগুলোও গলা থেকে পেট পর্যন্ত ঝুলে থাকে। এগুলো বানানো হয় খুব রঙ্গীন পুঁতি দিয়ে। এছাড়াও বিডসের একটা চিকন বড় মালার দাম ২শ টাকা বলে জানালেন এই বিক্রয়কর্মী। বিডসের, কাঠের আর রুদ্রাক্ষের লম্বা মালাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের চারুকলার সামনে এবং কার্জন হলেও পাওয়া যায়। যারা একটু শিল্পীমনা বা নিজেদেরকে বোহেমিয়ান লুকে দেখতে চান তারাই মূলত রুদ্রাক্ষ, বিডস আর কাঠের মালা বেছে নেন।
নিউ মার্কেটের আরেকটি দোকানে দেখা মিললো জার্মান সিলভারের বেশ ভারী বড় মালা। বিক্রয়কর্মী সোহাগ জানালেন এই মালাগুলোর দাম শুরু হয়েছে ৫শ থেকে এবং ডিজাইন ভেদে ১৫শ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের জার্মান সিলভারের মালা পাওয়া যায় তার দোকানে। তবে এই মালাগুলো সবসময় পরার জন্যে উপযোগী নয়। কেবল বড় বড় অনুষ্ঠানকে সামনে রেখেই এগুলো কিনে থাকেন নারীরা। বিশেষত বিয়ের সিজনে এগুলোর বিক্রি বেশি হয় বলে জানালেন সোহাগ।
এখন পালক, সুতো আর লেদারের গয়নার ট্রেন্ডও শুরু হয়েছে। অনেক মালায় লম্বা চেইনের সাথে সুতো, লেদার আর পালকের তৈরি বড় পেন্ডেন্ট সাজগোজে একদম ভিন্নমাত্রা যোগ করে। দেখতে একইসাথে হালকা এবং আকর্ষণীয় হওয়ায় যে কোন অনুষ্ঠানে বেছে নিতে পারেন এই মালাগুলো। নিউ মার্কেটের ঝুমকা নামের একটি দোকানে পাবেন এইসব নতুন ডিজাইনের পেন্ডেন্ট । ৩০০ টাকার মধ্যেই পেয়ে যাবেন অসাধারণ এই মালাগুলো। বড় চেইনের মালায় এখন আরেকটি ট্রেন্ড খুব চলছে, সেটি হল হ্যান্ড পেইন্টের পেন্ডেন্ট। সুতোর কালো একটি মালার মধ্যমণি হয়ে ঝুলে থাকা যামিনী রায়ের পেইন্টিংয়ের কপি অথবা ফ্রিদা কাহলো নজর কাড়ে এক মুহূর্তেই।
এই পেন্ডেন্টগুলো বেশি পাওয়া যায় অনলাইন দোকানগুলোতে। অনলাইনে গয়না বিক্রেতা ইথা চাকমা জানান, এখন এই হ্যান্ড পেইন্টের পেন্ডেন্টগুলোর পাশাপাশি লম্বা কর্ডে বা চেইনে ঝোলানো একটা ছোট সাইকেল বা ক্যামেরা কি হাতি এমন নানান বৈচিত্র্যে ভরা পেন্ডেন্টের দিকে ঝুঁকছে মেয়েরা। এই লম্বা চেইনগুলো এমন কি ট্যুরে যেতেও হালকা একটা ফতুয়া বা টিশার্টের সাথে গলায় ঝুলিয়ে নেয়া যায়। এতে খুব একটা সাজগোজ না করেও ইউনিক লুক আনা যায় বলে আজকাল মেয়েরা খুব কিনছে এই লম্বা চেইন আর নিজের পছন্দের পেন্ডেন্ট। ইথা জানালেন, ধরেন কেউ সাইকেল চালাতে পছন্দ করেন তিনি পরলেন ছোট্ট একটা সাইকেল, কারো নেশা ফটোগ্রাফিতে, তার গলায় ঝুললো একটা ক্যামেরা। এগুলোর চেইনটা এমন সিস্টেমে তিনি বানিয়ে দেন যে চাইলেই সময়, জায়গা এবং রুচি অনুযায়ী চেইনের আকার বড় ছোট করা যাবে। এই মালা গুলোর দাম ৫০ থেকে শুরু হয়ে ২শ টাকা পর্যন্ত আছে। ইথা জানান, তিনি আদিবাসীদের রুপার বড় মালার আদলে মালাগুলোরও অর্ডার নেন। এগুলোর দাম নির্ধারণ হয় মালায় রুপালি পয়সাগুলোর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে।
মডেল তারকা ইশরাত রথি বলেন, তিনিও বড় মালা পরতে পছন্দ করেন। তবে তিনি ভারি মালা এড়িয়ে চলেন। যেহেতু সারাদিন নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন তাই হালকা গয়নাকেই বেশি প্রাধান্য দেন রথি। একটা লম্বা চেইনে বড় একটা পেন্ডেন্ট ঝুলিয়ে রাখতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশি। রথি জানান, বিয়েবাড়িতেও তিনি খুব বেশি ভারি গয়না পরেন না। বিয়েবাড়িতে একটা মেটালের বড় মালার সাথে ছোট কানের দুলই যথেষ্ট মনে হয় তার। বড় মালা পরলে সাথে মাঝারি, ছোট কয়েক ধরণের মালা পরে ভারাক্রান্ত হয়ে যাবার ঘোর বিরোধী আজকের যুগের মেয়ে রথি।
বিয়েবাড়িতে সোনা, রূপা, জার্মান সিলভার বা তামার ভারি বড় মালা ছাড়াও অনেকেই গোল্ডপ্লেটের চিকন লম্বা মালা পরেন। এই মালাগুলোর সুবিধা হল এগুলো বয়স্করাও স্বচ্ছন্দ্যে পরতে পারেন। চেইন শপ কে জেড-এ এই মালাগুলো পাওয়া যায়। এই মালাগুলোতে ডায়মন্ড কাট লকেটও আছে। এছাড়াও কোন কোন মালার পুরোটাতেই ডায়মন্ড কাট পাথর বসানো। অত্যন্ত অভিজাত এই মালাগুলোর দাম ৫শ থেকে ২৫শ টাকা পর্যন্ত। কে জেড এর বিক্রয়কর্মী সাইফুল ইসলাম জানান, সব বয়সের নারীই এই মালার ক্রেতা।
এছাড়াও বড় মালার মধ্যে আছে মুক্তার কিংবা টারকোয়েজের এক লহরী মালা। উনিশ শতকের শুরুর একটি স্থিরচিত্রে কুচিবিহারের রানী ইন্দিরা দেবির গলায় ঝুলতে দেখা যায় এক লহরি মুক্তার বড় মালা। এই মালাগুলো একইসাথে সিম্পল কিন্তু অভিজাত একটা লুক দেয়।
ছোট্ট বাচ্চারা একসময় বাড়ির উঠানে দল বেঁধে হইহই করে খেলতো যেখানে সুর সুরে ছন্দে ছন্দে বলতো রাজবাড়িতে গিয়ে পানসুপারি খাবে, তারপর সবশেষে রাজবাড়ির এক মেয়ে যার নাম রেনুমালা তাকে সবাই মিলে মুক্তার মালা পরিয়ে দেবে। দারুণ মজার এই খেলা থেকে মনে হয় একসময় হয়তো এই অঞ্চলের অভিজাত নারীরা মুক্তার মালা পরতেন! তবে আজকাল এই অঞ্চলের অভিজাত নারীদের রকম সকম পাল্টেছে। তারা এখন শুধু মুক্তার মালা পরেন না, তাদের কাজ আর জীবনের মত মালায়ও এসেছে বিপুল বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যকে যে যত দ্রুত গ্রহণ করতে পারছেন তিনি হয়ে উঠছেন তত ইউনিক!
আলোকচিত্র – আশীষ সেনগুপ্ত
মডেল- আঁখি ভদ্র
সারাবাংলা/জেএম/এসএস/আরএফ