Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছাদবাগানের জুঁই- শুদ্ধতায় নির্মল- যেমন আমার নানাভাই


১১ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:০১

আমার কাছে ভালোবাসার মানুষের কোন মৃত্যুদিন থাকে না। তাঁরা বেঁচে থাকেন, তাঁদের ভালোবাসার মানুষের হৃদয়ে। ছাদবাগানে এমন অনেক গাছ দত্তক নেয়া হয়েছে, যেগুলো শুধুমাত্র আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া ভালোবাসার মানুষদের স্মরণে। আমার সাথে তাঁরা বেড়ে ওঠে। ফুল ফোঁটায়, ফল ধারণ করে, বংশ বৃদ্ধি করে। এভাবেই আমি প্রতিদিন তাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যাই। আমিও বেঁচে থাকি তাঁদের হৃদস্পন্দন নিয়ে। আমার ছাদবাগানে আমি ভালোবাসার চাষাবাদ করি, মনের আনন্দে।

বিজ্ঞাপন


আমার নানাভাই, মেহতের বিল্লাহ্। বিক্রমপুরের কাঠ ব্যবসায়ী ছিলেন। আসাম থেকে কাঠ আনতেন তিনি। ঘোড়ায় চড়ে কাঠের আড়ত ঘুরতেন। আসামের গৌহাটিতে ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত এলাকার একমাত্র মুসলিম পরিবারের কন্যা আমেনা বিল্লাহ্ কে বিয়ে করার পর ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কমলাপুর এবং শাহজাহানপুরের মাঝে। সে সময় সবচেয়ে বেশী তাঁর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরের প্রধাণ ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ জেঠুর সাথে। তাঁদের বিকালের চা পর্বে দেখা হওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। ইংরেজী কোরআন শরীফ পড়ে শোনাতেন জেঠুকে, নানাভাই। সূর্যাস্তবেলায় ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ জেঠু মন্দিরে প্রবেশ করতেন, সান্ধ্যকালীন প্রার্থনার জন্য আর নানাভাই বৌদ্ধ মন্দিরের উঠানে মাগরিবের নামায আদায় করতেন, পাঁটি বিছিয়ে। দু হাতের মোনাজাতের প্রার্থনায় গেয়ে উঠতেন – “তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে মলিন মর্ম মুছায়ে তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে লক্ষ্য-শূন্য লক্ষ বাসনা ছুটিছে গভীর আঁধারে জানি না কখন ডুবে যাবে কোন অকুল-গরল-পাথারে প্রভু, বিশ্ব-বিপদহন্তা তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা তব শ্রীচরণ তলে নিয়ে এস, মোর মত্ত-বাসনা ঘুচায়ে মলিন মর্ম মুছায়ে তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।”

বিজ্ঞাপন

নানাভাইকে দেখিনি। ওঁনার শেষ বয়সের একটা পেন্সিল স্কেচের ছবি আছে শুধু। বাবড়ি দীর্ঘ কেশ আর দাড়িতে মনে হয় যেন তিনি একজন সূফি সাধক অথবা দরবেশ। উনি ‘৬১ সালের ১১ এপ্রিল সকলকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শুদ্ধ আত্মার এক বিন্দু হলেও আমার আত্মার সাথে জুড়ে আছে। তাই তাঁর স্পর্শ পেয়েছিলাম এক সন্ধ্যায়, এমনই এক এপ্রিলে, এক নার্সারীর এ্যারোমেটিক জুঁইয়ের শুদ্ধ এবং স্নিগ্ধ সৌরভে। প্রায় তিন বছর আগে তাই তাঁকে নার্সারী থেকে সোজা দত্তক নিয়ে এসেছিলাম, আমার ভালোবাসার চাষাবাদের স্থানে। ছোট্ট লতানো ছিল সে। তাই কাঁধ দিয়েছিলাম ছোট। দু’বছরের বেশ বড় লতা বের হতে শুরু করায়, তাঁকে তাঁর নিজস্ব মাচাং তৈরী করে, বড় একটা মাটির টবে বাসস্থান পাকাপোক্ত করে দিয়েছিলাম। পাতার ফাঁকে ফাঁকে সাদা সাদা ফুলগুলো ঠিক সাঁঝবেলায় তাদের সৌরভ ছড়ায়।

অদ্ভুতরকম এ্যারোমেটিক জুঁই চৈত্রের শেষ থেকে ফুঁটতে আরম্ভ করে। নানাভাই চলে যাওয়ার সময়ের আগ দিয়ে। এখন সে বেশ বড় সর গুচ্ছ গুচ্ছ লতানো ডালপালা মেলে তাঁর জন্য তৈরী মাচাং এ আধিপত্য দেখিয়ে বেড়ায়। এ বছর চৈত্রের মাঝামাঝিতেই কুঁড়িতে কুঁড়িতে ভরে গিয়েছিল সে। দুটো চারটা করে ফুঁটেছে। ঠিক সূর্যাস্তের আগে তার কাছে গেলে মন ভরানো শুদ্ধ সৌরভ একদমই অন্যদিকে যেতে দেয় না। এমন কি দুপুরের তীব্র রোদ্দুরেও এ্যারোমেটিক জুঁইয়ের সাদাময় স্নিগ্ধতাও কোন অংশে কম নয়। আমার বারান্দাটা বড় হলে ঠিক নিয়ে আসতাম তাঁকে ঘরের পাশে। বছরে দুবার তাঁর মৃতপ্রায় ডালগুলো ছেঁটে দিতে হয়। চৈত্রের মাঝ থেকে একদম আষাঢ় মাস পর্যন্ত বিরামহীন ফুঁল ফুটিয়ে থাকে। অন্য সময়গুলোতে মাঝে মধ্যে কিছু ফুল হয়। ঠিক মতন জল একবার দিতেই হবে।

নানা ভাইয়ের শুদ্ধ আত্মার সৌরভে ছাদবাগানের এ্যারোমেটিক জুঁই ফুঁটছে। প্রতি সূর্যাস্তে মনে করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, মানসিক শুদ্ধতা মানুষকে কখনও ছেড়ে চলে যায় না। মানুষ শুদ্ধতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না, নিজের অজ্ঞতায়। বাইরে থেকে আসা আত্মায় জমতে থাকা কালিমাগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে মানসিক শক্তি ব্যবহার করতে পারে না, সবসময়।

আমরা নানা ভাইয়ের মতন মাগরিবের নামায বৌদ্ধ মন্দিরের উঠানে আদায় করতে পারি না। আমাদের মানসিক শুদ্ধতা এ্যারোমেটিক জুঁইয়ের মতন স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ সৌরভ ছড়ায় না, এখন। তাই আমরা নামাযের মোনাজাতের সময় প্রার্থনায় গেয়ে উঠতে পারি না – “আছ, অনল-অনিলে, চির নভোনীলে, ভূধরসলিলে গহনে আছ বিটপীলতায় জলদের গায়, শশীতারকায় তপনে আমি নয়নে বসন বাঁধিয়া ব’সে, আঁধারে মরিগো কাঁদিয়া আমি দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু, দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে মলিন মর্ম মুছায়ে তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে মলিন মর্ম মুছায়ে তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে” ভালোবাসলে ভালোবাসা আসে।

চাষী পরিবার, সুখী পরিবার।

ছবি – লেখক 

সারাবাংলা/আরএফ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর