রুদ্র লালে শুদ্ধ সাদায়- পহেলা বৈশাখ অমলিন হোক
১৩ এপ্রিল ২০১৮ ২০:৩৭
রাজনীন ফারজানা।।
একদিনের বাঙালিয়ানা বলে উপহাস হয়ত আছে, কিন্তু বৈশ্বিক প্রভাব তো ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব না। একদিনের জন্যও যদি আমরা শেকড়কে অনুসন্ধান করি, তাতে ক্ষতি তো নাই কোন। যে মেয়েটা জিনস টি-শার্ট কিংবা সালোয়ার কামিজে অভ্যস্ত সেও বৎসরের এই একদিন আনাড়ি ভঙ্গিতে পাটভাঙা সুতি শাড়ি পরে। কপালে দেয় লাল টিপ, হাতে রেশমি চুড়ি আর খোঁপায় জড়ায় বেলি ফুলের মালা। যে ছেলেটা রোজ রোজ প্যান্ট আর টি-শার্ট কিংবা শার্ট পরে সেও পহেলা বৈশাখে একটা সুতি পাঞ্জাবী পরে। পায়ে গলায় একটা চামড়ার চপ্পল। তার আধুনিক কাটের চুল হয়ত জেল দিয়ে সাজানো। তবুও পরনের দেশীয় কাপড় আর মোটিফের পাঞ্জাবী বলে দেয় সে বাঙালি। আর এভাবেই পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে সার্বজনীনভাবে বাঙালিয়ানার উদযাপন।
বৈশাখ মানেই তো সব ভেঙ্গেচুড়ে নতুন করে গড়া, নতুন চোখে দেখা আর নতুন করে অনুভব করা। বসন্তে ফোটা পলাশ শিমুলের ডালে ডালে লালের আভাস মুছতে না মুছতেই বাঙালির জীবনে কালবোশেখীর প্রলয়বাতাসে উড়ে আসে বৈশাখ, আমের বোলের সুঘ্রাণ। শীতের মালিন্য থেকে মুক্তি পেতে আমরাও রবি ঠাকুরের সুরে গেয়ে উঠি
”…বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক…”
বৈশাখ মানেই ঝড়, বৈশাখ মানেই প্রকৃতির রুদ্র রূপ। তবুও সে ঝড়ের পরে আসে প্রশান্তি। এমনই প্রলয়ঙ্করী বৈশাখকে কি আর ঘরে বসে আহ্বান জানানো যায়?
যায় না। আর তাই তো বাঙালি ছেলে, বুড়ো সব দলবেঁধে বেরিয়ে পড়ে বৈশাখকে স্বাগত জানাতে। দিনের প্রথম প্রহরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের গান শুনতে যায় তারা। হাতে মুখোশ আর গালে রঙ মেখে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় সামিল হয়। এরপর সারাদিন ধরে মেলায় ঘুরে, নগর জুড়ে চলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে, নাগরদোলায় চড়ে, ফুচকা, চটপটি আর মাটির সানকিতে নানা পদের ভর্তা আর ইলিশ পান্তা খেয়ে উদযাপন করে বছরের প্রথম দিনটি।
পুরো দেশটা যেন পরিণত হয় বিরাট এক উৎসবমঞ্চে। তাতে সামিল হতে বাঙালি নারীর পরনে দেখা যায় সাদা খোলের সুতি শাড়ি আর পুরুষের পরনে পাঞ্জাবী। শিশুরাও শাড়ি পাঞ্জাবীতে সাজে এদিন। বছরের প্রথম দিনের উৎসবে শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবীই কেন বেছে নেয় এদেশের অধিকাংশ মানুষ? ফ্যাশন ডিজাইনার চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, সারাবছরই তো নানা রকম দেশি বিদেশি পোশাক পরি আমরা। এই একটা দিন বাঙালিয়ানা উদযাপন করতেই বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম পোশাক শাড়ি আর পাঞ্জাবী বেছে নেই আমরা।
তবে সবাই যে শাড়ি পরে তা না। অনেকেই সালোয়ার কামিজ কিংবা অন্যান্য পশ্চিমা পোশাকও বেছে নেন পয়লা বৈশাখ উদযাপন করতে। এ বিষয়ে চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, সালোয়ার কামিজ কিংবা অন্য পোশাক আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক না। সালোয়ার কামিজকে অনেকে বাঙালি পোশাক বলেন কিন্তু আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে এদেশের অধিকাংশ মেয়ে হয়ত জিন্স আর টপস পরবেন। তাহলে দীর্ঘদিন পরার ফলে সেটাও কি বাঙালি পোশাক হয়ে যাবে? তা যেহেতু না তাই বছরের এই একদিন খাঁটি বাঙালি পোশাক শাড়ি আর পাঞ্জাবীই পরা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন। যেহেতু এই দিনটিকে আমরা বেছে নিয়েছি বাঙালিয়ানা উদযাপন করতে।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন কীভাবে আর কবে থেকে শুরু হল তা জানতে আমাদের যেতে হবে একটু পেছনের দিকে। ইতিহাস বলে, ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পয়লা বৈশাখে হোমকীর্তন ও পূজার ব্যাবস্থা করা হয়। ১৯৩৮ এর পহেলা বৈশাখেও ছিল একই আয়োজন। এরপর তো দুই বাংলা আলাদা হয়ে দুটি দেশের অংশ হয়ে গেল।
পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণের অন্যতম হাতিয়ার ছিল বাঙালি সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করা। সেই উদ্দেশ্যে তারা রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা চালায়। সেই সময় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের শিল্পীরা ১৯৬৭ সালের পহেলা বৈশাখের দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত কন্ঠে গান গেয়ে আহ্বান জানান নতুন বছরকে। যে জায়গায় তারা গান গেয়েছিলেন সেটা রমনার বটমূল বলে পরিচিত হলেও আসলে সেটি একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছ।
এখনও প্রতিটা পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে বাঙালিরা শুভ্র পোশাকে পলাশের লালের ছোঁয়া মেখে ছুটে যায় রমনায়। পহেলা বৈশাখের সাদা শাড়ি যেন সকালের সূর্যের প্রথম রশ্মি আর তার আঁচল ও পাড়ের লাল যেন উদিত সূর্যের রক্তিমাভা। আর কপালের লাল টিপ তো ঠিক যেন আস্ত সূর্যটাই এসে আসন গেড়েছে বাঙালি ললনার কপালে। এদিন অধিকাংশ নারীর চুলের এলোখোঁপায় দেখা যায় শুভ্র বেলী ফুল। বেলী ফুলের মালা কিংবা গাজরায় উড়ে উড়ে ঘুরতে এসে কোন ভ্রমর যেন চুপটি করে বসে যায় তার চোখের কাজল হয়ে।
এই তো চিরাচরিত বাঙালি নারীর রূপ। তবে অনেকেই কিন্তু সাদা শাড়ি লাল পাড় বেছে না নিয়ে লাল শাড়িও পরেন। আর সেই লাল শাড়ির পাড় কিংবা আচল যে সবসময় সাদা হয় তাও নয়। সারা বিশ্বজুড়েই ফ্যাশনে পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে। সেই নিরীক্ষা আর একঘেয়েমী কাটানোর প্রয়াসে অনেকেই এখন পহেলা বৈশাখে লাল আর সাদায় সীমাবদ্ধ না থেকে কমলা, নীল, হলুদ রঙের পোশাকও পরে থাকেন। কিন্তু লাল কিংবা সাদার একটু ছোঁয়া থাকেই। চন্দ্র শেখর সাহা মনে করেন, এই একটা দিন লাল আর সাদায়ই উদযাপন করা উচিৎ। কারণ সারা বছর নানা উপলক্ষে নানা রঙের পোশাক তো পরাই যায়।
আধুনিক পহেলা বৈশাখ উদযাপন তো নাহয় শুরু হল ১৯১৭ সালে এসে। কিন্তু এর আগে পহেলা বৈশাখের কী কোন মাহাত্ম্য ছিল না? নাকি সেটা ছিল শুধুই বাংলা বছরের প্রথম দিন। ভারতবর্ষে সম্রাট আকবরের শাসনামলে চৈত্র সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ বসন্তের শেষ দিনের মাঝে প্রজাদের জমিদারকে সব খাজনা পরিশোধ করতে হত। সেই উপলক্ষে পহেলা বৈশাখের দিন শাসকরা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এই উপলক্ষে থাকত নানারকম উৎসব আয়োজন। এইদিন প্রজারা ধোয়া কিংবা নতুন কাপড় পরে জমিদার অথবা রাজার বাড়ি যেত, আনন্দ আয়োজনে অংশ নিত। সেই উৎসবই দিনে দিনে আজকের বিপুল আনুষ্ঠানিকতার রূপ পেয়েছে।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনে লাল আর সাদা কেন বেছে নেয় সবাই? কীভাবে এল এই রঙের পোশাক?
সম্রাট আকবরের সময় থেকেই এইদিন নতুন করে হিসেবের খাতা খোলার রেওয়াজ। হিসেবের সেই খাতার নাম হালখাতা। আর এই হালখাতার উপরের মলাট হয় লাল রঙের। অনেকে মনে করেন এভাবে এসেছে বৈশাখের পোশাকের লাল আর সাদা। আবার আমাদের দেশের উৎসবের রঙটাই লাল। বাঙালি হিন্দু নারীরা পূজা করার সময় পরে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। আবার বিবাহিতা নারীরাও পরে লাল পেড়ে শাড়ি। আবার আমাদের দেশের বিয়ের কনেরা পরে লাল বেনারসি। তাই নতুন বছর উদযাপনেও আমরা শুভ্রতার পাশাপাশি বেছে নেই লাল রঙ। এখন অবশ্য আরও অনেক উজ্জ্বল রঙের দেখা মেলে। কিন্তু সাদা জমিনে লাল পাড় যেন বৈশাখের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গরদ শাড়িতে। আবার পাঞ্জাবীতেও সাদার উপর লালের কারুকার্য প্রাধান্য পায়।
পহেলা বৈশাখের পোশাকে রঙের পাশাপাশি উঠে আসে বাঙালি ঐতিহ্যবাহী মোটিফ আর কারুকার্য। এসব পোশাকে বাঘের মুখাবয়ব, মাটির পুতুল, পেঁচা, পালকি, নাকে নথ পরা ঘোমটা পরা বউয়ের মুখ, আলপনার ডিজাইন ইত্যাদি উঠে আসে। ইদানিং অবশ্য ফ্যাশন ডিজাইনাররা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা খুঁজে বের করে তাঁর নকশাও তুলে ধরছেন বৈশাখের পোশাক ডিজাইন করার সময়।
তবে শুধু শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবীতেই নয়। আধুনিক সময়ে মানুষ বৈচিত্রের খোঁজে কিংবা নিজেকে বাকি সবার থেকে ভিন্ন দেখাতে বেছে নেন অন্যান্য পোশাক। সালোয়ার কামিজ, টি-শার্ট, টপস কিংবা কুর্তি- যাই হোক না কেন এদিনের পোশাকে থাকে লাল নাহয় সাদার ছোঁয়া। অথবা কোন ঐতিহ্যবাহী মোটিফের নকশা। ফ্যাশন ডিজাইনার ও ফ্যাশন হাউস অঞ্জনসের কর্ণধার শাহীন আহমেদ বলেন, পহেলা বৈশাখে দেশি বা পশ্চিমা যেরকম পোশাকই মানুষ পরুক না কেন, তাতে লাল আর সাদা ছোঁয়া থাকেই। তিনি মনে করেন, এই ঐতিহ্যটা ধরে রাখাই উচিত, কারণ তাতে বৈশাখের রুদ্র ও একই সাথে শুদ্ধ রূপটি প্রকাশিত হয়।
বিশ্বায়নের প্রভাব তো পড়বেই আমাদের জীবনে। দেশি ঐতিহ্য আর পশ্চিমা ফ্যাশনের ফিউশন আমাদের চনমনে করে তুলবে প্রতিদিন। কিন্তু আমাদের অন্তরে, আমাদের বুকের গভীরে দেশের শিল্প সংস্কৃতি আর মাটির গন্ধ চিরঅমলিন হয়েই থাকবে। তার প্রভাব পড়বে আমাদের জীবনযাপনে, ভাষায়, এমনকি উৎসব উদযাপনেও। তাই প্রতি পহেলা বৈশাখে বাঙালির আত্মঅনুসন্ধান তার লাল সাদা পোশাকে, রবিঠাকুরের গানে আর মঙ্গশোভাযাত্রার ঐতিহ্যে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
মডেল – রামীম হাসান ও ঝিলমিল আখতার
পোশাক – রঙ বাংলাদেশ
গয়না – আর্টোপলিস ও রঙ বাংলাদেশ
মেকাপ – জারা’স বিউটি লাউঞ্জ
ছবি – আশীষ সেনগুপ্ত
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস