জামালপুর: পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনাময় একটি স্থান
৩১ মার্চ ২০২২ ২০:৫৭
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে, যা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাকে গড়ে তুলেছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে। নকশী কাঁথা ও হস্তশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ জামালপুর জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। বিখ্যাত সাধক পুরুষ হজরত শাহজালাল (রহ.) স্মৃতি বিজড়িত পুণ্যভূমি জামালপুরের আনাচে-কানাচে রয়েছে অগণিত পর্যটন স্পট। লাউচাপড়া পিকনিক স্পট, গান্ধী আশ্রম, যমুনা সার কারখানা, দয়াময়ী মন্দির, লুইস ভিলেজ রিসোর্ট অ্যান্ড পার্ক, মালঞ্চ মসজিদ, ঝিলবাংলা সুগার মিল, যমুনা সিটি পার্কের অবস্থানও জামালপুরে।
প্রকৃতির নান্দনিকতার অপরূপ সাজে সুশোভিত প্রতিটি স্থান। পাহাড়, টিলা, গাছপালা, নদী, পাখির গান, নদীর কলতান প্রকৃতির চির সবুজ রূপলাবণ্যতার মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে পর্যটন স্পটগুলো।
জামালপুরের বকশীগঞ্জের লাউচাপড়া পিকনিক স্পটে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছবির মতো গারো পাহাড় ভারতের তুরা জেলাকে আলাদা করেছে। এ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে অজস্র ছোট-বড় ঝরনাধারা, আদিবাসীদের পাহাড়ি গুচ্ছগ্রাম আর দিগন্তজোড়া ঘন সবুজ সব মিলিয়ে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ সমারোহ। লাউচাপড়া একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র।
সম্ভাবনাময় পর্যটন ক্ষেত্র হতে পারে যমুনা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, বানার, ঝিনাইয়ের মতো নদীগুলো। ঠিক যেমন তুরস্কের বসফরাস ট্রিপের মতো। এই ট্রিপে যেমন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি জামালপুরের নদীগুলোতে এমন ট্রিপ চালু করা যেতে পারে, যা ভ্রমণপিয়াসীদের নৌভ্রমণের মনের খোরাক মেটাতে সক্ষম বলে বোধ করি।
পাটশিল্পের জন্য জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলাকে ‘দ্বিতীয় ড্যান্ডি’ বলা হতো। নারায়ণগঞ্জের পরই ছিল এ উপজেলার পরিচিতি। ২২টি পাটকলের শব্দে মুখর থাকত এ জনপদ। ধীরে ধীরে অধিকাংশ পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে হারিয়ে যাওয়া সোনালি আঁশের এ শিল্পনগরী।
এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম সার কারখানার অবস্থান জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার তারাকান্দিতে। পূর্বানুমতি নিয়ে পর্যটকদের জন্য রয়েছে সার উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখার সুযোগ। আরও আছে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট, যমুনা জেটি ঘাট। ভোজনরসিক পর্যটকদের জন্য রয়েছে সরিষাবাড়ির বিখ্যাত প্যারা মিষ্টি খাওয়ার সুযোগ।
জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার কাপাসহাটিয়া গ্রামের ‘মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর’। জাদুঘরটিতে রয়েছে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম, ফকির বিদ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ। আরও রয়েছে ১৯৩৪ সালে বাঁশ দিয়ে নির্মিত গান্ধী আশ্রম। মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরের মূল সদর দপ্তর ছিল জামালপুরের কামালপুরে।
১৯৩৮ সালে জামালপুরের বাহাদুরাবাদে চালু হয়েছিল বহুল আলোচিত ও ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে-ফেরি। কালের পরিক্রমায় এই বিরল ফেরি চলাচল বন্ধ হলেও এখনও বহু স্মৃতি আগলে বাহাদুরাবাদ ঘাট রয়েছে ঠিকই। ভাঙাগড়ার খেলায় জোয়ার-ভাটার স্রোত বয়ে যায়; কিন্তু বাহাদুরাবাদের ফেরিতে কারও পা পড়ে না। এ ঘাটটিও হতে পারে বিপুল সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়ার জন্য টেকসই বা পরিবেশবান্ধব গ্রামীণ পর্যটনকে উৎসাহিত করা উচিত। গ্রামীণ পর্যটন বলতে মূলত বোঝায় কৃষি পর্যটন, ইকো-ট্যুরিজম এবং ঐতিহ্য পর্যটন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ পর্যটনের বিকাশ ও উন্নয়নের ধারণা গ্রহণকারী প্রথম অঞ্চল ছিল রাজস্থান এবং কেরালা। স্পষ্টতই, কেরালা অন্যতম বিখ্যাত ইকো গন্তব্যস্থল। উদাহরণস্বরূপ, কেরালার কুমারকম গ্রামীণ পর্যটন প্রকল্প ভারতকে দেখিয়েছে কিভাবে পরিবেশ বান্ধব চর্চা এবং প্রকৃতির যত্ন নিশ্চিত করার সময় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সুবিধা প্রদান করতে হয়। ঠিক একইভাবে দশ হাজার বছরের সুপেয় পানির অববাহিকা রয়েছে যেই জামালপুরে, সেখানেও গ্রামীণ পর্যটনকে উৎসাহিত করা সময়ের দাবী।
জামালপুরে পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে এ জেলার পর্যটনশিল্প পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারেনি। অথচ জেলার আর্থসামাজিক উন্নয়নে, বেকার সমস্যা সমাধানে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
জামালপুরের পর্যটন আকর্ষণের অভাব নেই। অভাব আছে তুলনামূলক পরিকল্পিত উদ্যোগ, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার। পর্যটন শিল্পে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করতে পারলে এবং উপযুক্ত পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে জামালপুর জেলার পর্যটন শিল্প কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
সারাবাংলা/এজেডএস