Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইদের খাদ্যাভ্যাস

ডা. ইব্রাহিম মাসুম বিল্লাহ
৩ মে ২০২২ ১৯:৩১

এক বছর পর ফের এসেছে পবিত্র ইদুল ফিতর। দীর্ঘ ৩০ দিন সিয়াম সাধনার পর ইদ নিয়ে আসে আনন্দের বার্তা। আর বাঙালির ইদ মানেই মুখরোচক খাবার ও বাহারি পোশাক। ইদ উপলক্ষে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব পরিবারেই থাকে হরেক পদের মুখরোচক খাবারের আয়োজন। একমাসের খাদ্যাভাস বদলে এ দিনে সবাই সকালে নাস্তার টেবিলে বসে পড়েন। মুখে দেন সেমাই, পায়েস, জর্দা, পোলাও কোর্মাসহ নানা পদের কত টক-ঝাল-মিষ্টি। সব ঘরে ঘরে আয়োজন থাকে বলে খাওয়াও হয় খুব করে।

কেবল ইদের দিন নয়, ইদের পর কয়েকদিন ধরে চলে বাড়তি খাবারের এই চাপ। কিন্তু দীর্ঘদিনের উপবাস অভ্যাস থেকে অতিভোজনে হুট করে শিফট হওয়াটা একটু চ্যালেঞ্জেরই। তাই লক্ষ করা দরকার খাবারের প্রতিক্রিয়ার দিকে। বিশেষত খেয়াল করার দরকার খাবারের পরিমাণের দিকে। একমাস সংযমে ছিলাম বলে ইদ ও ইদের পরের কয়েকদিনেই ৩০ দিনের পরিমাণে সবকিছু খেয়ে ফেলতে হবে, এমন প্রবণতাকে দমাতে হবে। টক ঝাল মিষ্টি যাই খাই না কেন, তা অবশ্যই হতে হবে পরিমিত।

এবারের ইদ যেহেতু বৈশাখের তীব্র তাপদাহের সময়ে হচ্ছে, তাই বেশি পরিমাণে তরল খাবার অবশ্যই খেতে হবে। খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে সহজে হজম হয় এমন খাবার। একসাথে অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার হজমে ব্যাঘাত ঘটায়। বুকের জ্বালাপোড়া বাড়ায়, পেট ফাঁপায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি করে।

ইদের দিন এবং এর পরের কয়েক দিনের খাবারদাবার নিয়ে আগে থেকেই মোটামুটি একটি পরিকল্পনা থাকা দরকার। দিনের মূল খাবার অর্থাৎ দুপুর ও রাতের খাবার কোথায় খাবেন ঠিক করে ফেলুন। অন্য জায়গায় যথাসম্ভব কম খেতে চেষ্টা করুন। পানি, শরবত, ফলের রস ও অন্য তরল খাবার বেশি করে গ্রহণ করুন। এতে গুরুপাক খাবারের জন্য পেটে স্থান কমে যাবে।

খাবারের মেন্যুতে স্বাভাবিকভাবেই মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি থাকে। এ ছাড়া পোলাও, মুরগি, গরু বা খাসির মাংস, কাবাব ইত্যাদির সঙ্গে ঝাল খাবারও থাকে। আরও আছে চটপটি, দইবড়া কিংবা বোরহানির মতো টক খাবারও। যাদের বয়স কম এবং শারীরিক কোনো সমস্যা নেই, তারা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন এবং তাদের হজমেরও কোনো সমস্যা হয় না। শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো। তবে, অনেকে একমাসের অনভ্যাসের কারণে হঠাৎ খুব বেশি ঝাল বা তৈলাক্ত বা ভাজাপোড়া খেলে অসুস্থবোধ করতে পারেন। তাই সবার জন্যই খাবার হওয়া উচিত কম মসলাযুক্ত, কম তৈলাক্ত এবং ভালোভাবে রান্না করা।

যারা মাঝবয়সী বা বয়োবৃদ্ধ বা যাদের অন্যান্য শারীরিক সমস্যা আছে, যেমন— ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেশার বা হৃদরোগ ইত্যাদি, তাদের খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। ডায়াবেটিক রোগীকে অবশ্যই মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তারা বরং টক খাবারের মাধ্যমে রসনা পূরণ করতে পারেন। সবজি বা টক ফল দিয়ে মজাদার খাবার আগেই বানিয়ে রাখুন, এগুলো আপনাকে অন্য খাবার থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে। নেহায়েত মিষ্টি খেতেই চাইলে চিনির বিকল্প দিয়ে তৈরি করে নিবেন।

পোলাও-বিরিয়ানিও কম খাবেন, ভাত খাওয়াই ভালো। অতিরিক্ত খাবার অবশ্যই পরিহার করবেন। মুরগী বা গরুর মাংস খাওয়া যাবে যদি অতিরিক্ত তেল বা চর্বি না থাকে। সাথে কিডনির সমস্যা থাকলে মাংস পরিহার করাই ভালো। খাসি, কলিজা, মগজ, চিংড়ি ইত্যাদি খাবেন না।

খাবারের পরিমাণটা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা এসব খাবার একবেলাই খাওয়া উচিত, অন্য বেলা স্বাভাবিক খেতে হবে। রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এদিন একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, প্রয়োজনে ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিনের মাত্রা একটু বাড়াতে হতে পারে। এ ব্যাপারে ইদের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

যাদের রক্তে কলেস্টেরল বেশি বা উচ্চ রক্তচাপ আছে, অথবা হার্টের সমস্যা আছে অথবা যারা মুটিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অবশ্যই তেল ও চর্বি এড়িয়ে যেতে হবে। তবে চর্বি ছাড়া গরুর মাংস খাওয়া যাবে পরিমাণ মতো। ভাজা পোড়া খাবেন না, বিশেষ করে ঘরের বাইরে। আগের দিনের বাসি মাংস জ্বাল দিয়ে খাবেন না। মিষ্টিও পরিমাণের বেশি খাওয়া যাবে না। পোলাও কম খাবেন, ভাত হলেই ভালো। ফল, ফলের রস, সালাদ ইত্যাদি বেশি করে খাবেন। বিশেষ করে খাবারের শুরুতে সালাদ খেলে অন্য খাবারের জন্য জায়গা কমে যাবে। এ ছাড়া টক দই খেলে উপকার পাবেন।

কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমন মাছ-মাংস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দিনে দুই টুকরোর বেশি নয়। ফল খাবার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা থাকে। এদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেয়া উচিত ঈদের আগেই। যারা দুধ সহ্য করতে পারেন না, তাদের দুধের তৈরি খাবার এড়ানো ছাড়া উপায় নেই, তবে, বোরহানি বা টক দই খাওয়া যায়। অনেকে সালাদ খেলে সমস্যায় পড়েন, তাদেরও তা এড়াতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে যাতে কোষ্ঠকাঠিন্য না হয়।

ইদে অতিরিক্ত খেয়ে পেট জ্বালা করা, ফাঁপা আর পেপটিক আলসার খুব সাধারণ সমস্যা। যাদের পেটের এই সমস্যা আছে তারা অতিরিক্ত ঝাল, মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করবেন। দুই বেলা খাবার আধঘণ্টা আগে আলসারের ওষুধ যেমন ওমেপ্রাজল, ইসমিপ্রাজল, রেনিটিডিন ইত্যাদি খেয়ে নেবেন। প্রয়োজনে খাবার পর দুই চামচ এন্টাসিড খেতে পারেন। পেট ভরে খাবেন না, গোগ্রাসে না খেয়ে সময় নিয়ে চিবিয়ে খাবেন, খাবার সাথে সাথে পানি না খেয়ে একটু পরে খাবেন, রাতে খাবার পর পরই ঘুমোতে যাবেন না। কিছুক্ষণ হাঁটা চলা করতে পারেন, দুই তিন ঘণ্টা পর ঘুমাবেন।

ইদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। একে রোজায় পানি কম খাওয়া হয়, সবজি কম খাওয়া হয়, ভাজা পোড়া খাওয়া হয় বেশি। ঈদেও সেই ধারা বজায় থাকে, উপরন্তু মাংস তেল চর্বি বেশি খাওয়ায় পানির অভাব আরও বেশি দেখা দেয়। ফলে অনেকেই, বিশেষ করে বৃদ্ধরা সমস্যায় পড়েন। এক্ষেত্রে ইদের আগের রাতে বা ইদের সকালে ইসবগুলের ভুষি পানিতে মিশিয়ে খেয়ে নিতে পারেন। সকালে ইদের নামাজে যাওয়ার আগে সেমাই পায়েসের সাথে সাথে ফলের রস খেতে পারেন। এর সাথে প্রচুর পানি পান করে নেবেন। ইদের দিন দুপুর ও রাত্রে অবশ্যই সবজির একটি পদ রাখবেন। আর সব খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি বা অন্যান্য পানীয় পান করতে ভুলবেন না।

ইদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। ইদে তাই সবার জন্যই থাকে একটু অন্য রকম মজাদার খাবার। খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে, খাওয়াটা যেন হয় ভেজালমুক্ত, টাটকা, স্বাস্থ্যসম্মত, সহজপাচ্য ও উপাদেয়। অবশ্যই হতে হবে পরিমিত এবং পরিকল্পিত। অতিভোজনের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তাহলেই শরীর ও মনটাও সুস্থ থাকবে সবসময়। এ কথাও মনে রাখতে হবে, অতিভোজন এমনকি স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়ার ফলেও যদি শারীরিক সমস্যা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

লেখক: উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফরাজী হাসপাতাল, ঢাকা

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ ইদের দিনের খাদ্যাভ্যাস টপ নিউজ ডা. ইব্রাহিম মাসুম বিল্লাহ সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর