পুনর্মিলন ভেঙেছিল সীমান্ত, দিগন্ত ও প্রশান্ত
১০ মে ২০২২ ১৬:০৪
বিশাল বড় কয়েকটি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে কিউবা। কিউবার দক্ষিণে জ্যামাইকা ও দক্ষিণ-পূর্বে হাইতি। আরো পূর্ব দিকে অগ্রসর হলে আটলান্টিক মহাসাগর। পশ্চিমে মেক্সিকো উপসাগর এবং আরো পশ্চিমে বিশাল দেশ মেক্সিকো। বিশ্বমঞ্চে কিউবা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দেশ নামেই পরিচিত। তিনি প্রচার করেন সমাজতন্ত্রের সাম্যবাদ। বেশিরভাগ জনগণ তার মতবাদকে স্বাগত জানায়। পুঁজিবাদের মোড়ল আমেরিকার ঠিক পেটের ভেতরে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ বেড়ে উঠবে, এটা কল্পনা করা যায় না। ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও তার মতবাদকে যে সকল কিউবান মেনে নিতে পারেনি তারা ছেড়েছে কিউবা, ছেড়েছে প্রিয়জন, নিয়েছে আশ্রয় ভিন্নদেশে। নতুন জীবনের আশায়।
হাভানার দুই নতুন প্রজন্ম আলেক্স ও আনালোই গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে, একে অপরের প্রেমে আসক্ত। তাদের স্বপ্ন ফ্লোরিডাতে যেতে হবে নতুন জীবনের সন্ধানে, যেখানে খুঁজে পাবে স্বাধীনতা ও মানবতার মৌলিক অধিকার। কিন্তু ফ্লোরিডাতে তো ঢোকা কঠিন? কী করা? শেষে প্লান করলো আনালোইকে প্রথমে সুইডেনে পাঠানোর। এক বছর ধরে টাকা জমা করে আনালোইকে সুইডেনে পাঠানো হয়েছে দালালের মাধ্যমে। একমাস প্রায় হতে চলেছে আনালোই সুইডেনে এসেছে। এরই মধ্যে আনালোই জানতে পেরেছে যে সুইডেনে তার পারমিশন হবে না, সে সুইডেনে বসবাস করতে পারবে না, তাই তার মন বেশ খারাপ। আলেক্সকে ছেড়ে একাকী জীবনে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে শেষে এসেছে ডাক্তারের কাছে। ঠিক একই সময় আমার সহধর্মিণী মারিয়া ঐ একই হাসপাতালে এসেছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেই ভাষাগত সমস্যার কারণে ঠিকমতো তার সমস্যা বোঝাতে পারছে না। সে ইংরেজি বা সুইডিস জানে না, স্প্যানিশ ভাষাতে চেষ্টা করছে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝতে পারছে না। এমতবস্থায় ডাক্তার মারিয়াকে দোভাষী হিসাবে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করে।
আনালোই মারিয়ার সাহায্যে আপ্লুত হয় এবং স্বল্প সময়ের পরিচয়ে তাদের মাঝে বেশ একটি বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। সুইডেনে থাকার ব্যবস্থা না হবার কারণে মারিয়া তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আনা হ্যানসনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আনালোই দেখতে অনেকটা হ্যানসনের মতো, চুল এবং চোখের রং শুধু ভিন্ন। হ্যানসন আনালোইয়ের সব জানতে পেরে তার পাসপোর্ট দিয়ে বললো, ‘তুমি দেখতে যখন আমার মতো, তাই পুলিশের কন্ট্রোল ছাড়াই সুইডেন থেকে চলে যেতে পারবে তাছাড়া সুইডেন থেকে বের হতে সচরাচর পুলিশের চেক হয় না। তোমার চুলের রং কালো। তাই লম্বা চুলকে কালার করলে এবং চোখে নীল লেন্স লাগালে কোনো অসুবিধা হবে না।’ প্লান অনুযায়ী আনালোই স্টকহোম থেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের শহর মায়ামিতে যাবে। একজন সুইডিস হিসাবে। আমি সেদিন অবাক হয়েছিলাম মারিয়া এবং তার প্রিয় বান্ধবী হ্যানসনের মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ দেখে। মনে হচ্ছিলো ‘জীবে দয়া করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ আনালোই মারিয়ার বান্ধবীর পাসপোর্টে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রওয়ানা দিলো স্টকহোম আরলান্ডা থেকে মায়ামি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ফ্লোরিডাতে।
আনালোই মায়ামি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতেই বাথরুমে ঢুকে সুইডিশ পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে চুল কেটে ছোট করে, চোখের লেন্স ফেলে দিয়ে তার কিউবার পাসপোর্ট এবং নিজের চেহারায় ফিরে ইমিগ্রেশনে হাজির একজন কিউবান হিসেবে। পুলিশের সন্দেহ থাকার কথা নয়, কারণ পারফেক্ট স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা থেকে শুরু করে সবকিছু ঠিকঠাক। পুলিশের প্রশ্ন কিভাবে কোথা থেকে এবং কোন এয়ারলাইন্সে সে এলো? আনালোই পুলিশকে জানিয়েছে দালালের মাধ্যমে এবং তাদের সহায়তায় সে এসেছে। ১৯৯৬ সালের কথা, নিয়ম অনুযায়ী যদি কোনো কিউবান আমেরিকার বর্ডারে একবার ঢোকে, তবে তাকে ফেরত দেবার নিয়ম নেই। আর সেই সুযোগ নিয়ে আনালোই ঢুকে গেলো ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকাতে।
খবর পৌঁছে গেলো হাভানাতে, আলেক্স খুশি যে তার বান্ধবী ঢুকেছে আমেরিকাতে। এখন আলেক্সের পালা। আনালোই এর আমেরিকান গ্রীন কার্ড রেডি হতে সময় লাগবে কয়েক বছর। আর দেরি নয়, রিস্ক নিতে হবে। ভালোবাসার পূনর্মিলনের জন্য জীবন দিতে বাঁধা নেই আলেক্সের। রাতের আঁধারে আলেক্স প্লান করেছে ছোট্ট নৌকা করে হাভানা থেকে কী-ওয়েস্ট পাড়ি দেবে। যার দূরত্ব প্রায় ৮০ কিমি। আটলান্টিক এবং গালফ অব মেক্সিকোর সমন্বয়ে এই সাগর যার মধ্যে রয়েছে হাঙ্গর। তারওপর রয়েছে সাগরে বর্ডার গার্ড পুলিশ। সব কিছু জেনেশুনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের আঁধারে ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস করে এই প্রেমিক রওনা দিলো সেদিন। কি-ওয়েস্ট সাগরপাড়ে পথ চেয়ে বসে থাকা তার প্রেমিকার উদেশ্যে। দীর্ঘ তিনদিন তিনরাত ছোট্ট নৌকায় করে পথ চলতে সে দেখেছিল ক্ষুধার্ত হাঙ্গর, ভয়কে জয় করেছিলো শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়ে। পরিশেষে ঢুকতে পেরেছিল কী-ওয়েস্টে তার প্রিয়তমা আনালোই এর কাছে। কিছু ঝামেলা হয়েছিল ইমিগ্রেশনের শুরুতে, পরে সব ঠিকঠাকমতো হয়ে যায়। দুইজন যুক্তরাষ্ট্রে খুঁজে পায় ভালোবাসার জীবন। আমাদের সঙ্গে আলেক্স এবং আনালোই এর অতীতের স্মৃতি থেকে যোগাযোগ এখনও রয়েছে। আলেক্স ও আনালোই এর আমেরিকাতে পারমিশনের এক বছর পরে এসেছিলাম বেড়াতে তাদের বাড়িতে। দুজনই প্রকৌশলী, সুন্দর জীবন যাপন করছে তারা আমেরিকাতে। আমাদেরকে পেয়ে তারা হয়েছে দিশেহারা, মনে হচ্ছে ভালোবাসার ঋণ শোধ করতে এমনটি আয়োজন। এমন কৃতজ্ঞতাবোধ অনুভব করিনি এর আগে। উপকার তো নিজের আপনদেরও করেছি, কিন্তু তারা কেন অকৃতজ্ঞ হল? ভাবনায় এসেছিল ক্ষনিকের তরে সেদিন। আলেক্স ধরেছে আমাদেরকে নিয়ে যাবে কী-ওয়েস্টে, যেখানে প্রথম মিলন হয়েছিল দুজনার দুজনায়। আলেক্সের মুখে তন্ময় হয়ে শুনলাম তার হাভানা থেকে কী-ওয়েস্টে আসতে নৌকাভ্রমণের ভয়ংকর কাহিনী, শুনলাম সাগরের বর্ডারগার্ড পুলিশের সাথে প্রথম দর্শনের বর্ণনা।
অতপর প্লান করলাম সবাই মিলে একসঙ্গে গাড়িতে করে বেড়াতে যাব কী-ওয়েস্টে। পথে স্মৃতিচারণ করতে করতে এবং পুরানো সেই দিনের কথা শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম সেই প্যারাডাইস দ্বীপ কী-ওয়েস্টে। বইতে পড়েছি, আজ ইতিহাসের সামনে দাঁড়ানোর উপলব্ধি সে এক বিশাল ব্যপার। কী-ওয়েস্ট, আমেরিকার সর্বশেষ দক্ষিণের স্পট। ছোট্ট একটি ভূখণ্ড, ফ্লোরিডার মূল ভূখণ্ড থেকে ১২৯ মাইল দূরে সাগরের মধ্যে। অসম্ভব সুন্দর একটি ড্রাইভওয়ে দিয়ে কানেক্ট করা হয়েছে কী-ওয়েস্টকে। টানা চার ঘণ্টার ননস্টপ ড্রাইভিং। বামে আটলান্টিক ডানে গালফ অব মেক্সিকো। একদম সামনের দূরে ক্যারিবিয়ান সি। ক্ষণিকের তরে স্বপ্নের রাজ্যে নীল জলের মধ্য দিয়ে পুলসিরাতের মতো একখান রাস্তা দিয়ে এ যেন স্বর্গের পানে ছুটে চলা!
মজার ব্যাপার সেটা হলো কী-ওয়েস্ট পৌঁছনোর পর কিউবার হাভানা ছিল নিকটস্থ ভূখন্ড। তবে খালি চোখে দেখা সম্ভব না। এই লম্বা স্থলভাগ একটি চিকন শলার মতো সাগরের ভেতর চলে গেছে। বিশাল দুই সাগরের মাঝ দিয়ে চলে গেছে ওভারসি হাইওয়ে। এই হাইওয়ে দিয়ে যেতে দুই সাগরের অগাধ নীল জলরাশির যে মোহনীয় রূপ দেখেছি তা অতুলনীয়। মেঘের উপরে সোনালী আকাশ, সূর্যের কীরণ পড়েছে সাগরে সেদিনের বিকেলে, সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। কী-ওয়স্টের আরেকটি পরিচয় রয়েছে সেটা হলো আর্নেস্ট হামিংওয়ে। এখানে রয়েছে তার সামার হাউজ যা এখন মিউজিয়াম এবং এক অপূর্ব আকর্ষণ বিশ্বজাতির জন্য। হামিংওয়ের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবার পরে স্থানটির নাম আরও পরিচিত হয়ে উঠেছে। আলেক্স ও আনালোই এর প্রেমের নাম হতে পারত বেদনা কিন্তু অঢেল ত্যাগ, পরস্পরের উপর বিশ্বাস আর আশ্বাসের সমন্বয়ে বেঁধেছে তারা ভালবাসার সুখের ঘর। তাই হয়তো কী-ওয়েস্টের প্রতি এত আকৃষ্ট হয়েছিলাম সেদিন। মায়াভরা মায়ামি আর সাগর পথে আলেক্সের কী-ওয়েস্টের নৌকাভ্রমণ কেড়ে নিয়েছিল আমার মন। স্মৃতির পাতা থেকে কিছু পুরানো কথা লিখতে মনে পড়ে গেল আজ থেকে ২৫ বছর আগের কথা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, জীবন যুদ্ধের সংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে, ভালোবাসার টানে পরিবার, আত্বীয়স্বজন, ভাই-বোন, মা-বাবা সবাইকে ছেড়ে কিউবার হাভানা থেকে ছোট্ট নৌকায় করে হাঙ্গরে ভরা সাগর দিয়ে প্রথমে কি-ওয়েস্ট, পরে মায়ামি, ফ্লোরিডাতে এসেছিল এক প্রেমিক আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে। সেদিনের সেই পুনর্মিলন ভেঙ্গেছিল সীমান্ত, দিগন্ত ও প্রশান্ত। পরে গড়েছে ভালোবাসার বসতবাড়ি কী-ওয়েস্টের অদূরে আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, মায়ামিতে। বেঁধেছে প্রেমের ঘর ভালোবাসা আর বিশ্বাসের পর, এক সুখি পরিবার।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
পূনর্মিলন ভেঙ্গেছিল সীমান্ত- দিগন্ত ও প্রশান্ত বেড়ানো ভ্রমণ রহমান মৃধা