Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তেহরানে অ্যাডভেঞ্চার: তোচাল স্কি রিসোর্টে ২ ঘণ্টার আনন্দযাপন


২০ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:০৩

।। শাওলী মাহবুব, তেহরান থেকে।। 

ইরানের রাজধানী তেহরানের ভানাক এলাকায় আমার বাড়ির ব্যালকনি থেকে আলবুরুজের যে অংশটুকু দেখা যায়, ঠিক ওটাই যেন তোচাল। অন্তত রাতে দূরের পাহাড়ে উঠে যাওয়া আলোগুলোর হাতছানি যেন তাই বলত। ভূগোল বলে, তেহরানের তিনদিক ঘিরে আছে আলবুরুজ পর্বতমালা। উত্তর ইরানে আলবুরুজের যে অংশটুকু পড়েছে, তারই এক পাহাড় হলো তোচাল। আর এখানেই তোচাল স্কি রিসোর্টটি । উচ্চতার মাপামাপিতে তোচালের সর্বোচ্চ চূড়া ৩,৯৩৩ মিটার বা ১২,৯০৪ ফুট।

বিজ্ঞাপন

বাড়ির এতো কাছের এক স্কি রিসোর্টে যাওয়া হচ্ছে না, তা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। তাই একদিন মোটামুটি ছোট এক দলে রওনা হলাম তোচাল। আলবুরুজের পাঁজর ভেদ করে করে, গিরি বাঁকের খাঁজ উপভোগ করতে করতে, বরফ সাদা পাহাড়ের অলিগলি আর হিল ট্রাকারদের দেখতে দেখতে এই সেদিন ঘুরে এলাম তোচালে। অসাধারণ সময় কাটলো প্রায় ঘন্টা দুয়েক।

প্রতিদিন মেঘ পাহাড়ের মিতালি আর ভরা শীতে আলবুরুজের উপরকার বরফের রঙ বদলানোর গল্প দেখতে দেখতে কখন যেন আলবুরুজকে নিজের আঙিনার অংশ ভাবতে শুরু করেছিলাম। অন্তত নিজের ডাইনিং টেবিল থেকে যখন তার সকাল দুপুরের রঙ মাখামাখির খেলা দেখা যায়, তখন তাকে আর আমার নিজের ভাবতে দোষ কোথায়? প্রায়ই দেখা যেতো মেঘেদের সাথে পাহাড়ের সখ্য। কখনো মেঘেরা পাহাড় হতে চাইত অর্থাৎ পাহাড়-চূড়ায় জমা বরফ এর পাশে ঘন সাদা মেঘকে মাঝে মাঝে পাহাড়ই মনে হতো। অথবা কোন কোন দিন পাহাড়ের কোলে বসে যেতো কালো মেঘ। আর দূর থেকে তাকে আগ্নেয়গিরি লাভা উদগীরণ করছে বলে মনে হতো। দিনকার পরিচিতি, তবু যেন সে অপরিচিত। কারণ পাহাড় যেন এক আড়াল। তার ভাঁজে আর ভঙ্গিমায় বরফের মতো জমে থাকে আহবান। খুব কাছের মনে হলেও তা যেন দূরের, অনতিক্রম্য। তাই তাকে জানতে চাওয়া মানুষের জন্মগত অভ্যাস।

বিজ্ঞাপন

আধুনিক ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক উন্নত। পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের সুবিধাসমূহ। টেলি কেবিন এবং স্কি রিসোর্টের সব ধরণের সুবিধা নিয়ে তোচাল তৈরি তার অভিযাত্রীদের জন্য। তোচাল পাহাড়ে রয়েছে মোট চারটি স্টেশন। এখানে আছে লম্বা গন্ডোলা লিফট যা ভ্যালেনজাক ভ্যালি (১৯০০ মিটার বা ৬২০০ ফুট) থেকে শুরু এবং উঠে গেছে একদম চূড়া (৩৭৪০ মিটার) পর্যন্ত। থেমে থেমে যাবার মতো গোন্ডলা লিফট এর চারটি স্টেশন আছে। ভ্যালেনজাক ভ্যালিতে আছে পার্কিং এরিয়া, ছোট ছোট খাবারের দোকান, অন্যান্য সুবিধা এবং আছে দেখার মতো ছোট এক পাহাড়ি ঝর্ণা। এটা হলো প্রথম স্টেশন। দুই নম্বর স্টেশন ২৪০০ মিটার বা ৭৯০০ ফুট উঁচুতে, তবে এখানে ঘোরাঘুরির সুবিধা খুব বেশি নেই। স্টেশন পাঁচ ২,৯৩৫ মিটার উচুঁতে এবং পর্যটকদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে এখানে আর সাধারণ পর্যটকদের গন্তব্যও এই পর্যন্ত। স্টেশন সাত ৩৭৪০ মিটার উঁচুতে এবং তোচাল পাহাড়ের মূল চূড়ার একদম ধারে। মূল স্কি রিসোর্ট এখানেই।

পাঁচ নম্বর স্টেশনটি সাধারণ যাত্রীদের জন্য। নার্ভাস যাত্রীরাও নির্বিঘেœ টেলি কেবিনে চড়ে পঞ্চম স্টেশন পর্যন্ত আসতে পারেন। আর যারা স্কি করতে চান, বড় বড় স্কি বোর্ড, হাত মোজা আর ভারী কাপড়ে সজ্জিত হয়ে তারা পা বাড়ান সাত নম্বর স্টেশনের দিকে। সেখানকার টেলিকেবিনগুলো যেন একটু বেশি রঙচঙে, আর নতুন। সবগুলোই টুকটুকে লাল রঙের। আমরা যারা সাধারণ যাত্রী তারা পাঁচনম্বর স্টেশনেই নেচে গেয়ে মুগ্ধ। কিন্তু পাঁচ নম্বর স্টেশনও কম কি! অন্তত ভূপৃষ্ঠ থেকে তিন কিলোমিটার নভঃ গমন তো সহজ কথা নয়। পাঁচ নম্বর স্টেশনে যাবার রাস্তাও বেশ বর্ণময়। দ্ইু নম্বর স্টেশন থেকে টেলি কেবিনে চড়ে, মধ্যপথে চলতে চলতেই আর একটি স্টেশনে মিনিট পাঁচেকের ধীর গতিতে পথ বদল করে করে পৌঁছুতে হয় পাঁচনম্বর স্টেশনে। রোলার কোস্টারে চড়ার অথবা নাইন ডি সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা যেমন, এযাত্রা যেন ঠিক তেমনই। পাহাড়গুলো তো আর সমান উচ্চতার নয় যে পথ হবে মসৃণ। মূল স্টেশন থেকে ‘কেবল কার’ যখন ঝাঁপ দেয়, তখন তা শূণ্য থেকে লাফিয়ে পড়ার মতোই। অন্তত জীবনে প্রথমবার এই অভিজ্ঞতা নিতে গেলে ভয় তাকে আঁকড়ে ধরবেই।

যাত্রার শুরুতে পাহাড়ের নিচের দিকে বরফ ছিলো না। ক্রমেই গভীর হয়ে এলো পাহাড়। নিচে দেখা গেলো পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে অভিযাত্রীরা পায়ে হেঁটে উঠছেন। ভাবলাম হয়ত উচ্চতা কম, বরফ নেই তাই পথ চলতে পারছেন। কিন্তু না একটু পরেই ভুল ভাঙল যখন হাইকারদের বা পাহাড়চারীদের দেখা গেলো বরফ ঠেলে হাঁটতে। যিনি অভিযাত্রী তিনি তো রহস্যকে আকঁড়ে ধরেন। তিনি জানেন তিনি একবারই মরবেন। বারবার নয়। তাই আলবুরুজের উচ্চতা, বরফ পিচ্ছিল পথ কোন কিছুই হাইকারদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। কখনো দল বেঁধে, কখনো বা একলা। এদের মধ্যে ইরানি নারীরা উল্লেখযোগ্য হারেই আছেন। স্কি করার যাবতীয় সরঞ্জাম এবং প্রস্তুতি দুটোই রয়েছে তাদের। যেনবা নেপালে এভারেস্টে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। কোন একজনকে ভারী কাপড় পরে হাঁটতে দেখা গেলো। মুখটা দেখে চমকে উঠতে হলো। কারণ কোন ক্রমেই তাঁর বয়স পঁচাত্তরের কম নয়। বেশ দুর্গম পথে হাঁটতে দেখা গেলো অভিযাত্রীদের। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ঘন পাহাড়ের ভেতর।

বরফ ঢাকা পাহাড় চারপাশে। চড়াই উৎড়াই আর খাড়া পাড় ধরেই টেলি কেবিনের রাস্তা। চলতে চলতে অ্যাডভানচারাস হলিউডি কোন সিনেমার অংশবিশেষ হয়ে গেলাম যেন। টেলি কেবিন একবার উঠছে আবার পাহাড়ের সাথে মিল রেখে নামছে খাড়াভাবে। কেবল কারের ডানপাশে নীচে দেখা গেলো কেবল চেয়ারের রাস্তা। এক ইরানি নারীকে দেখা গেলো তার মোটামুটি ছয়বছর এবং তিন বছরের দুই বাচ্চাকে নিয়ে কেবল চেয়ারে করে রাস্তা পাড়ি দিতে। কেবল চেয়ার সম্পর্কে যারা জানেন তাদের জানা আছে এটা বক্স নয়, চেয়ারের সামনের দিকটা কোনরকমে হয় শিকল দিয়ে আর নয়ত একটা লোহার শিক দিয়ে আটকানো থাকে। কাজেই এটা যে ভীষণই ভয়ঙ্কর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এবং ইরানি নারী অবলীলায় তার বাচ্চাসমেত চেয়ারে উপবিষ্ট। ইরানি নারীরা ভীষণ সাহসী বলে পরিচিত। পরেও দেখেছি তাদের দুঃসাহসী কা-। পাঁচ নম্বর স্টেশনেও দুই ইরানি তরুণী তার এক পা খাড়া পাহাড়ের ঢালে আর এক পা ভেতরে রেখে রীতিমতো খাওয়াদাওয়া শুরু করেছিলেন। কাজেই তাদের দুঃসাহসী বলা ছাড়া আর উপায় কী?

চলতে চলতেই সামনের রোদ আলোকিত অংশগুলোতে নিজেকে উন্মুক্ত করল পাহাড়। চারপাশে সাদাসফেদ বরফ। মাঝে মাঝে কালো পাথরের মুখ বের করে চারপাশ দেখা আর বরফ ভেঙে শ^াস নেয়া। দীর্ঘ বারো মিনিট হিল ট্রাকারদের দেখা, বরফ মোড়ানো পাহাড়ের বিচিত্রতা, অসীম শূন্যে নিজেকে আবিস্কার করতে করতে পৌঁছে গেলাম পাঁচ নম্বর স্টেশনে।

স্টেশনের ডানপাশটা একটা ছোট মালভূমির মতো। চারপাশে বরফ ছড়ানো। মাঝে কাঠ বিমের তৈরি এক রেস্টুরেন্ট, নাম ‘ক্লাসনো’। ছোটখাটো ভ্যালিগুলো বরফে মোড়া। ছোটখাটো চড়াইউৎরাই বরফ সামলে চলতে হয়। পাহাড়ের ধারগুলো একদম খাড়া। পা হড়কে গেলে নির্ঘাৎ পটল তুলতে হবে। আমাদের বিচরণ ছিলো এই মালভূমির সমতল অংশেই। ছবি তোলার জন্য চটপট দাঁড়িয়ে গেলাম। এই স্টেশন আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের জন্য। এখানে খাবার রেস্টুরেন্ট, প্রার্থনা করা, টয়লেটসহ যাবতীয় সুবিধাদি রয়েছে। ছবি তুলতে শুরু করলাম। চূড়া থেকে তেহরান শহরকে শহর প্ল্যানারদের এক মডেল মনে হচ্ছিল। দুপুরের খাবার সেরে নিলাম এই রেস্টুরেন্টে। বখতিয়ারি কাবাবের সাথে ভাত, স্যুপ, কফিসহ অন্যান্য খাবার।

খেতে খেতে দেখা গেলো মেঘ ঘিরে ফেলেছে। এবং একটু পরে শুরু হলো বরফ পড়া। খুব হালকা । কিন্তু চটুল তার সঞ্চারণ। পাহাড়ে বসে পাহাড়ের গায়ে বরফ পড়তে দেখা বেশ রোমাঞ্চকর। খাবার শেষ করে পড়ন্ত বরফ এর মাঝে আনন্দে অবগাহন করলাম। এরই মাঝে দুটো কুকুর বেশ আসর জমিয়ে ফেলল পর্যটকদের মাঝে। এর মধ্যে একটা গোল্ডেন রিট্রিভার এবং অন্যটি ল্যাব্রাডর রিট্রিভার। লোমশ কালো রঙের কুকুরটির সাথে আমার কন্যার খুব সখ্য হলো। তাকে ঘিরে বেশ কিছু ছবিও তোলা হলো। রেস্টুরেন্টটির বর্ধিত অংশের কাঠের ছাদে কাঠের ফাঁক চুইয়ে পানি নেমে সেখানে তৈরি হয়েছে স্ট্যালাকটাইট। সাধারণত গুহার ভেতর চোখা হয়ে থাকা বরফের এই রূপটি দেখা যায়। মনে হয় ইচ্ছে করেই ফাঁক রাখা হয়েছে এটি তৈরির জন্য।

ইরানে আসার পর যেখানেই গেছি ইরানিরা নিজ থেকেই পরিচিত হতে এসেছে এবং স্বাগত জানিয়েছে তাদের দেশে। এটা এদের সংস্কৃতির বেশ উল্লেখযোগ্য একটা অংশ। তোচালেও ইরানি তরুণীরা নিজে থেকে পরিচিত হলো এবং ইরানে স্বাগত জানালো। তাদের অভিবাদন আরও উপভোগ্য করে তুলল আমাদের আনন্দযাপন।

শেষ করার আগে বলে নিই যে, তোচাল একেবারেই তেহরানের গা ঘেঁষে। ওখানে যেতে সময়ও বেশি লাগে না, কষ্ট বা খরচও তেমন নেই। নিজের গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই, অন্যথায় ট্যাক্সি ভাড়া করেই ওখানে যাওয়া যায়।

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর