[পর্ব-১৮ ]হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ, সোনালু, সোনালু রে…
২১ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:৩৫
হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িল কে/ পাখিটি ছাড়িল কে রে আমার/ পাখিটি ছাড়িল কে!
বৈশাখের স্বাগতমী রঙ সাদা লাল। বাংলার চিরন্তন কৃষ্টি এই বৈশাখ বরণ। বাংলা বছরের শেষ দিনে চৈত্র সংক্রান্তির মাঝ দিয়ে নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। এবারও আনন্দ উৎসব পালনে এক চিলতে হেরফের হয়নি কারো বৈশাখকে বরণ করবার পুরো দিনটি জুড়ে।
লাল সাদা রঙে মাখা বৈশাখের রেশ থাকতে থাকতেই হঠাৎ চমকে দেখি আমার ছাদবাগানে সোনালু কুঁড়িগুলো থেকে আস্ত আস্ত ফুল হয়ে ফুটে আছে। ছাদবাগানের ঐ কোনটা যেন সোনারঙে হলুদ হয়ে গিয়েছে। তিন বছরের অপেক্ষা শেষে তারা আমার ছাদবাগানকে সোনারঙে আলোকিত করে দুলছে। ধানচারা রঙের সবুজ সবুজ সোনালুর পাতার মাঝ থেকে সোনালু ফুলগুলোকে একদম হলুদিয়া পাখির মতন দেখতে লাগে। মনে হয় কোন এক গাঁয়ের বধূর হারিয়ে যাওয়া হলুদিয়া পাখিটি আমার ছাদবাগানে লুকিয়ে আছে। পাখিটি ছাড়িল কে!
সোনালু, সোনাল, বাঁদর লাঠি, বাঁন্দর ছড়া বা গোল্ডেন শাওয়ার যে নামেই ডাকি না কেন, আমার প্রিয় ফুলের মাঝে তিনি এক নম্বর স্থান অধিকার করে আছেন। সোনালু বাংলার মাটিতে শিমুল পলাশের মতনই খুব সহজে বেড়ে ওঠা আরেকটি ফুলের গাছ। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের গাছ। সংসদ ভবন বা কাকরাইলের মোড়ে বেগুনী জারুল, গোলাপী কড়ই আর লাল কৃষ্ণচূড়ার সাথে সোনারঙা সোনালু ফুল ফুঁটে থাকতে দেখলেই বুকের ভেতর এক হাহাকার জাগতো। এত বড় গাছ কি করে ছাদবাগানে দত্তক আনবো!
প্রায় তিন বছর আগে, ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় সোনারঙা সোনালুর প্রভাবে একদিন নার্সারি গিয়ে একখানা সোনালুর চারা দত্তক নিয়েই তবে বাসায় ফিরেছিলাম আমি। সে চারা অবস্থাতেই দেড় ফুট লম্বা ছিল। পরের দিন বড় ড্রামে পাঁচ বস্তা মাটি আর দুই বস্তা জৈবসারের মিশ্রণে সোনালুর বাসস্থান তৈরি করে, চারদিন পর তাতে সোনালুকে পাকাপোক্ত জায়গা করে দিয়েছিলাম। কয়েকটা মাত্র পাতা আর লিকলিকে গাছটিকে বেশী মায়া করে ফেলেছিলাম আমি। ফুল ফুটুক না ফুটুক সে আমার ভালোবাসা হয়ে ছাদে আছে। তাতেই স্বস্তি আমার। এখন সে ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে প্রায় সাত ফুট লম্বা হয়েছেন।
শীত শেষ হতেই পাতা ঝরা শুরু হয় সোনালুর। সে সময় ড্রামের উপর থেকে এক হাত মাটি সরিয়ে সেটুকু শুধু নতুন জৈবসার দিয়ে ভরে দিয়ে থাকি আমি। প্রতিদিন জল, একবেলা একদম ভরপুর। চৈত্রের মাঝামাঝি একদম পাতাবিহীন থাকে সোনালু। খুব খেয়াল করলে দেখা যাবে নির্জীব ডালের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট সবুজ পাতা বের হচ্ছে। গত তিন বছরে এই পাতাদের দিকে রোজ তাকিয়ে থেকে বেলা শেষ করেছি। অপেক্ষা করেছি সেসব সবুজে হলুদ সোনালুর কুঁড়ি দেখবো বলে। মৌমাছি বা ভিমরুলেরা সোনালুর পাতা পছন্দ করে। ছাদবাগানে তাদের আনাগোনা শুরু হয় সোনালুর নতুন পাতার জন্য।
এবার আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। ছাদবাগানে সোনালু ফুল ফুটবে, সবাই বলেছে সম্ভব নয়। আমি শুধু শক্ত হাতে যত্ন নিতে নিতে সবাইকে বলেছিলাম, সোনালু ফুটবে। যেদিন ফুটবে আমার চাষী জীবন সেদিন আধেক সার্থক হবে। ঠিক তাই। সেই সবুজ সবুজ গুটি গুটি পাতার সাথে এ বছরের বৈশাখের প্রথমদিনেই সোনালুর কুঁড়িগুলো ভালোবাসার চাষাবাদের উপহারের ডালি নিয়ে এসেছে। তিনচার দিনের মাথায় সোনালুরা ফুটতে শুরু করেছে। সেই গানের হলুদিয়া পাখিটি আমার ভালোবাসার ছাদবাগানে শিষ দিয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিদিন।
এ পর্যন্ত চাষী জীবনের সকল ব্যর্থতা, সোনা রঙে ধুয়ে মুছে পরিস্কার। আপনার ছাদবাগানের রোদ্দুর ভরা এক খন্ড সোনালুর জন্য তৈরি করে ফেলতে পারেন। নগর চাষী যখন তার ছাদবাগানে সোনালু ফুল ফুটিয়েই ফেলেছে, জানি আপনিও পারবেন। চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি আমি। শুধুমাত্র ধৈর্য ধরে থাকতে হবে। সোনালুর সোনারঙ দেখলে সব কষ্ট মাটি। হয়ে যাক এবার ছাদবাগানে সোনালুর চাষাবাদ। বছর তিনেকের মাঝে আবারও প্রমাণিত হবে – চাষী পরিবার, সুখী পরিবার।
সারাবাংলা/এসএস