বাইকে তেলের খরচ কমাতে কী করবেন?
১৪ আগস্ট ২০২২ ১৩:৫০
‘তেলের যে দাম, ভাবছি বাইক বিক্রি করে সাইকেল কিনবো’- গত ক’দিনে ঢাকাসহ দেশের প্রায় সর্বত্র মোটরবাইক চালকদের অনেকেরই বক্তব্য প্রায় এইরকমই। হবেই না কেন? সস্তার বাহন মোটরসাইকেলের জ্বালানির দাম যে বেড়েছে!
তেলের দাম বাড়ায় বাইক বিক্রির হিড়িক পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মোটরসাইকেলে ছবি পোস্ট করে এক বাইকার ক্যাপশনে লিখছেন- ‘বাইক বিক্রি করা হবে। কিনলে ইনবক্সে নক দিন’। একই চিত্র বিক্রয় ডট কম সহ অন্যান্য কেনাবেচার প্ল্যাটফর্মেও। সংবাদমাধ্যমের সূত্রে গত পাঁচদিনে প্রায় তিন হাজারের বেশি মোটরসাইকেল বিক্রির বিজ্ঞাপন উঠেছে বিক্রয় ডট কম-এ। অনেকে ‘ইমার্জেন্সি’ বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে এবং বাইকারদের গ্রুপগুলোতেও একই চিত্র। বেশি বিপাকে পড়েছেন চুক্তিভিত্তিক মোটরসাইকেল চালকরা। যাত্রীদের কাছে সকাল থেকে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া চাইতে হচ্ছে তাদের। এতে উল্টো যাত্রীই পাচ্ছেন না তারা। হতাশ হয়ে অনেকেই বিক্রি করতে চাচ্ছেন রুটি রুজির উপলক্ষ্য বাইকখানা।
এটা ঠিক যে, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক চালককেই তেল কিনতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে জ্বালানি খরচ অনেকটাই কমে যাবে, যদি সঠিক নিয়মে মোটরবাইক চালানো হয়। শুধু কিছু বিষয় মেনে চললে কম তেল খরচ করে মোটরসাইকেল চালানো যায়। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার আফসার হোসেইন সারাবাংলার পাঠকদের জানিয়েছেন মোটরসাইকেলে জ্বালানি সাশ্রয়ের কয়েকটি টিপস-
গতি থাকুক নির্দিষ্ট
কম বা বেশি গতি কোনোটাই মোটরবাইকের জন্য ভালো নয়। বাইকের ইঞ্জিন গতি বাড়ার সাথে সাথে তেল ব্যবহারের ক্ষমতাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে নেয়। বরং নির্দিষ্ট গতিতে চালালে তেলের খরচ অনেক কম হয়। তাই সম্ভব হলে একই গতিতে বাইক চালাতে চেষ্টা করুন। এখনকার মোটরবাইকের স্পিডমিটারে ‘ইকোনমি স্পিড’ দেয়া থাকে। এই ইকোনমি স্পিড মানে বড়জোর ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে বাইক চালানো। ইকোনমি স্পিড বজায় রেখে বাইক চালালে জ্বালানি খরচ কম হয়। এছাড়া মোটরবাইক যত কম গিয়ারে চলবে, তত বেশি তেল পুড়বে। এজন্য বাইক স্টার্ট করার পর গতি বাড়িয়ে টপ গিয়ারে রাখুন। এতে জ্বালানি খরচ কমবে।
চেক করুন চাকার হাওয়া
বাইকের চাকার হাওয়ার সঙ্গেও তেল খরচের যোগসূত্র আছে। টায়ারে হাওয়া বা প্রেশার কম থাকলে সেটি রাস্তায় ঠিকভাবে চলতে পারেনা, ফলে চাপ বাড়ে ইঞ্জিনের ওপর। আর ইঞ্জিনের উপর চাপ পড়লেই বাইকের জ্বালানি খরচের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই বাইকের টায়ারের হাওয়া সবসময় ঠিক রাখুন। প্রতিমাসে অন্তত একবার টায়ারের চাপ পরীক্ষা করুন। মাস শেষে দেখবেন, কম তেলে গাড়ি চলেছে আগের চাইতে বেশি পথ।
বেশি ওজনে বেশি জ্বালানি
বাইকের ক্ষেত্রে আরেকটি সূত্র হলো, বেশি ওজনে বেশি জ্বালানি পোড়ে। ওজন বাড়ার সাথে সাথে তেলের খরচ বাড়তে থাকে। তাই জ্বালানি খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে বাইকে অতিরিক্ত যাত্রী বা মালামাল পরিবহন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ইঞ্জিন অয়েল ও তেল
নিম্নমানের তেলের ব্যাবহারে বাইকের মাইলেজ কমে আসে। অনেকসময় তেলে বিভিন্ন কিছু মেশানো হয় যাতে তেলের গুণগতমান কমে যায়। এছাড়া ভালো গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েলের ব্যবহার বাইককে ভালো রাখার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই তেল ইঞ্জিনের স্থায়ীত্বও বাড়িয়ে দেয়। অনেকেই বারবার ইঞ্জিন অয়েলের ব্রান্ড ও গ্রেড বদলান। এতে বাইকের ইঞ্জিনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। আপনার বাইক নতুন হলে প্রথমেই সিনথেটিক অয়েলে না যাওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। ভালো ইঞ্জিন অয়েলে গাড়ির শব্দ মসৃণ হয় এবং জ্বালানিও কম পুড়ে।
এয়ার ফিল্টার পরিষ্কার রাখুন
আপনার গাড়ির এয়ার ফিল্টার যদি পরিচ্ছন্ন না থাকে তাহলে আপনার গাড়ির জ্বালানি খরচ বাড়বে। কারণ অপরিচ্ছন্ন এয়ার ফিল্টারের কারণে ইঞ্জিনে বাতাস চলাচলে বাধা পায়। ফলে ইঞ্জিনের কর্মক্ষমতা কমে যায়। আর এই কারণে ইঞ্জিন বেশি তেল বা জ্বালানি খরচ করে ফেলে। এয়ার ফিল্টার পরিস্কার রাখুন, জ্বালানি খরচ ও ফুয়েলের অপচয় থামান।
ক্লাচের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখুন
অনেকেই বাইক চালানোর সময় ক্লাচ চেপে রাখেন অথবা ব্রেক হালকা করে চেপে রাখেন। অনেকে আবার দ্রুত চলতে গিয়ে বার বার ব্রেক করে হঠাৎ গতি বাড়িয়ে চালান। এ সবই বাইকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। চালানো অবস্থায় বেশিসময় ক্লাচ চেপে রাখবেন না। কারণ ক্লাচ খুব বেশি ব্যবহার করলে জ্বালানি বেশি খরচ হয়। এছাড়া ক্লাচ ত্রুটিপূর্ণ হলে তা ক্লাচ প্লেট এবং প্রেশার প্লেটকেও দ্রুত বিকল করে। এছাড়া ইঞ্জিন স্টার্ট থাকা অবস্থায় বাইক দাঁড়িয়ে থাকলে অযথা থ্রটল ঘুরাবেন না। বাইকের ‘আরপিএম’ চেক করে নিন। অনেকসময় বাড়ানো আরপিএমের কারণে জ্বালানি বেশি পোড়ে। সবচেয়ে ভালো হয় বেশি সময়ের জন্য কোথাও দাঁড়াতে হলে অথবা যানজটে আটকে গেলে বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলে।
চেইন থাকবে পারফেক্ট
বাইকের ঢিলা বা পুরোনো চেইন জ্বালানি খরচ বাড়িয়ে দেয়। আবার অতিরিক্ত টাইট চেইন চাকা জ্যাম ও তেলের ব্যবহার বাড়ার কারন। চেইন টাইট থাকলে স্প্রোকেট খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায় ও চলন্ত অবস্থায় ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই সঠিক মাপে বাইকের চেইন ব্যবহার করা উচিত। সেই সাথে চেইন নিয়মিত পরিষ্কার না করা বা লুব্রিকেন্ট না দেওয়া হলেও মাইলেজ কম পাওয়া যায়। সেজন্য ম্যানুয়ালে উল্লেখ করা মাত্রায় চেইন টাইট রাখুন। এজন্য নিয়মিত চেইন পরীক্ষা করা উচিত যাতে বাইকের চেইনের টান টান ভাব ঠিক থাকে।
কার্বুরেটর ও স্পার্ক প্লাগ পরিস্কার রাখুন
কার্বুরেটরের মধ্য দিয়ে বাইকের ইঞ্জিনে জ্বালানি ঢোকে এবং ইঞ্জিনে বায়ু ও জ্বালানীর মিশ্রণ তৈরি করে। আর এই জ্বালানি পোড়ানোর জন্য ইঞ্জিন বৈদ্যুতিক ব্যাবস্থায় একটি প্লাগের মাধ্যমে স্পার্ক তৈরি করে। কার্বুরেটরে ময়লা জমলে ইঞ্জিনেও ময়লা ঢুকে সঠিকভাবে জ্বালানি পুড়তে বাধা দেয়। আর প্লাগে ময়লা জমলে জ্বালানি পোড়া শুরুর জন্য স্পার্কই হতে পারে না। এজন্য প্রায়ই দেখা যায় স্পার্ক প্লাগের কারণে মোটর সাইকেল বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য বাইকে কার্বুরেটর ও স্পার্ক প্লাগ নিয়মিত পরিস্কার রাখা জরুরী।
যানজটে ইঞ্জিন বন্ধ রাখুন
নগরজীবন মানেই জ্যামের কারখানা। আর রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল বা যানজটে পড়লেই বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিন। কারণ বাইক নিউট্রাল অবস্থায় থাকলেও জ্বালানি খরচ হয়। যদিও বর্তমানে আধুনিক বাইকগুলি এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে নিউট্রাল অবস্থায় ইঞ্জিন জ্বালানি কম ব্যবহার করে। তাই আপনার বাইকের কর্মদক্ষতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিন কোনটা করা ভালো। কিন্তু এটাও ঠিক ইঞ্জিন চালু থাকলেই তেল খরচ হবেই। সেটা কম বা বেশি যা-ই হোক না কেন। তাই অহেতুক ইঞ্জিন না চালিয়ে রাখাই যুক্তিযুক্ত।
ভাঙা রাস্তা ও জ্যাম এড়িয়ে চলুন
বাইকে তেলের খরচ কমানোর জন্য ভাঙা রাস্তা ও জ্যাম এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করুন। কারণ জ্যাম, ভাঙা রাস্তা, গর্ত ইত্যাদির কারণে বাইকের গতি কমানো ও বাড়ানো লাগে। এটা অতিরিক্ত জ্বালানি খরচের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া জ্যামে বাইক চলমান থাকলে ইঞ্জিন এবং গিয়ারের ওপর চাপ পড়ে। যা বাইকের আয়ু কমিয়ে দেয়। ভাঙা রাস্তা ও জ্যাম এড়িয়ে শর্টকাট রাস্তা খুঁজতে জিপিএস ব্যবহার করা যেতে পারে। জিপিএস শুধু সময়ই নয় জ্বালানির টাকা বাঁচাতেও কার্যকর।
নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ
বাইক একবার কেনা মানেই যে দীর্ঘদিন নিশ্চিন্তে চালিয়ে যাবেন তা কিন্তু নয়। বাইকের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। আর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণে বাইক যেমন নতুনের মতো ছন্দে থাকে তেমনি জ্বলানিও সাশ্রয় হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময়েই ইঞ্জিনের শব্দে লক্ষ্য রাখবেন। কোনো গড়মিল পেলেই মেকানিকের কাছে নিয়ে যান। নিয়মিত বিরতিতে ইঞ্জিনের তেল পরিবর্তন, চেইন লুব্রিকেট এবং কুল্যান্টগুলো প্রতিস্থাপন করুন। দেখে রাখুন কাবুরেটর, প্লাগ, ব্যাটারি এবং ক্ল্যাচের হালহকিকতও। কয়েকদিন পরপর চাকার হাওয়া পরীক্ষা করুন। তবে কার্বুরেটর ও ইঞ্জিন টিউনিং করাতে হলে দক্ষ মেকানিকের মাধ্যমে সেটা করানো উচিত।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
অংকিতা চৌধুরী বাইকে তেলের খরচ কমাতে কী করবেন? লাইফস্টাইল সুন্দর যাপন