Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খড়ম থেকে চপ্পল- গরম দেশের ফ্যাশন


২৫ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:১৭

Black flat ribbon sandals styled with 3.8” turquoise ribbon.

জান্নাতুল মাওয়া।।

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও এই অঞ্চলের মুরুব্বিরা খড়ম পরতেন। এটি কাঠের তৈরি বিশেষ এক ধরণের জুতো যেটি পায়ে আটকানোর কোন বন্দোবস্ত নেই। শুধু বুড়ো আঙ্গুল আর তার পাশের আঙ্গুল দিয়ে জুতোটিকে ধরে রাখার জন্যে  জুতোর সামনের দিকে একটি কাঠের গুটি বসানো থাকে। এই অঞ্চলের জুতোর ইতিহাসের প্রথম দিককার জুতোই হল খড়ম। ধারণা করা হয় ছয় সাত হাজার বছর আগে এই খড়মের উৎপত্তি।

প্রাচীন সূর্যমূর্তি কিংবা কার্তিকের জুতা পরা থেকে অনুমান করা হয় যে, ভারতবর্ষে জুতোর ব্যবহার প্রাচীনকালেই শুরু হয়েছিল। রামায়ণেও রামের জুতোর উল্লেখ আছে। ১৩০৩ সালের বিখ্যাত সুফি দরবেশ হযরত শাহজালালের ব্যবহৃত খড়ম এখনও তার সমাধিস্থলে রক্ষিত আছে। তবে এই জুতোটি পরে খুব বেশিদুর হাঁটাচলা করা সুবিধাজনক নয়। ফলে এই অঞ্চলের সাধারন মানুষ খালি পায়েই বেশি হাঁটতেন। ধীরে ধীরে খড়ম চলে  গেলো মিউজিয়ামে  আর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুজার ঘরে।

 

মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে আধুনিক জুতো  স্যান্ডেলের ব্যবহার এই অঞ্চলে বাড়ে। জুতো তৈরির পরিকল্পিত কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। সাধারণ মানুষের হাঁটা চলার সুবিধার কথা বিবেচনা করে এই অঞ্চলে এলো হাওয়াই চপ্পল এবং জয় করল মানুষের পা। দামেও সস্তা হওয়ায় হাওয়াই চপ্পলের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া।

একসময় যখন ভোগবাদিতার এত জয়জয়কার ছিলোনা তখন প্রায় সব মানুষই স্বাচ্ছন্দ্যে হাওয়াই চটি পরে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু হাওয়াই চপ্পলের যুগও একসময় পড়তির দিকেই চলে গেলো । চপ্পলগুলো জায়গা করে নিলো  ফ্যাশন সচেতনদের বাথরুম বা টয়লেটের সামনে। তবে দামে স্বস্তা হওয়ায় এখনো হাওয়াই চপ্পল আগলে আছে এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের মেহনতি পা। এছাড়াও যানবাহনের চাকায় ব্যবহৃত টায়ার ও টিউব কেটে তৈরি হয় এক ধরনের বিশেষ জুতা। যার নামকরণ করা হয়েছিলো টায়ার জুতা। এখন আমাদের দেশে চামড়া, রেকসিন, প্লাস্টিক, কাপড় ইত্যাদি নানান উপাদানে তৈরি নানান রঙের নানান ঢঙের জুতো পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশের আবহাওয়ায় একে তো বেশিরভাগ সময় গরম, তার ওপর আদ্রতা বেশি হবার কারনে ঘামও হয় প্রচুর। তাই এখানে শীতকালে এবং ব্যায়ামের প্রয়োজনে ছাড়া পা বন্ধ জুতো পরে বেশিরভাগ মানুষই স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেনা। আর এই ফ্যাশনপ্রেমী এবং আরামপ্রিয় লোকেদের জন্যে এসেছে নানান ডিজাইনের নানান উপাদানে তৈরি চপ্পল বা চটি। আগের হাওয়াই চপ্পলের জায়গা অনেকটাই দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের ফ্ল্যাট স্যান্ডেল। তবে এখন আবার হাওয়াই চপ্পলকে নতুন ভাবে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। চপ্পলের স্ট্রাইপে ফুল বা যে কোন নকশার ফিতা, চুমকি বসিয়ে দিয়ে চপ্পলটিকে আকর্ষণীয় করে ফেলা হচ্ছে। ছেলে মেয়ে সবার জন্যে ব্যবহারের উপযোগী এই ধরণের স্যান্ডেলগুলো ঢাকার যে কোন মার্কেটে পাওয়া যায়। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের চৌরঙ্গীর একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী জনাব জামান জানান, এই স্যান্ডেলগুলো কোন কোনটি চায়না থেকে আসে আবার অনেকগুলো দেশেই বানানো হয়। তিনি আরো বলেন বাংলাদেশে সব ঋতুতেই এই স্যান্ডেলগুলো প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। এই চপ্পলগুলো সাধারণত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রীদের পায়ে বেশি দেখা যায়। এর কাছাকাছি আরেক ধরণের রাবারের তৈরি চপ্পল রয়েছে যেগুলোকে বলে বার্মিজ স্যান্ডেল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সিতারা মাহাজাবিন জানান, ক্লাসে আসতে তিনি বেশিরভাগ সময়েই এই স্যান্ডেল পরেই সাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন। এছাড়া আমাদের দেশের রাস্তাঘাটগুলো তো অল্প বৃষ্টিতেই কাদা পানিতে ভেসে যায়। এই জুতোগুলো পরে ভার্সিটিতে এসে তিনি সহজে পা ধুয়ে ফেলতে পারেন। এই  জুতোও খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। মেয়েদের এই স্যান্ডেলগুলোর দাম শুরু হয়েছে দেড়শো থেকে, আর ছেলেদের জুতোগুলোর দাম শুরু হয়েছে দুশো টাকা থেকে।

বিজ্ঞাপন

আজ থেকে চার হাজার বছর আগে আমাদের এই যুগের এই চপ্পলগুলোর মতই চপ্পল পরতো প্রাচীন  মিশরের মানুষ। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনো তিন হাজার বছর আগের প্যাপিরাসের তৈরি  চপ্পল দেখতে পাওয়া যাবে। চীন জাপানে ব্যবহার করা হত ধানের খড়। আজকের আধুনিক যুগের চপ্পল যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়তা পায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। জাপানের জোরি নামের একপ্রকার স্যান্ডেল থেকে আজকের আধুনিক চপ্পলের উৎপত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা দেশে ফিরে যাবার সময় সাথে করে জোরি জুতো নিয়ে যায়। ১৯৬০ সালের দিকে ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে ক্যাজুয়াল সমুদ্র সৈকতের স্টাইলের অনুষঙ্গ হিসেবে চপ্পল যুক্ত হয়। আমাদের দেশেও এখন  সমুদ্র সৈকতে বা কোন ভ্রমণে যাবার আগে সবার প্রথমেই অনেকে এই স্যান্ডেলগুলো একজোড়া কিনে ফেলেন।

স্যান্ডেল শব্দটি এসেছে গ্রীক থেকে। প্রাচীন গ্রীসে যোদ্ধারা যে স্যান্ডেল পরতো সেগুলোকে পায়ের সাথে বেঁধে রাখার জন্যে ব্যবহার করা হত ফিতা। আজকাল সেই আদলে অনেক  ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পাওয়া যায়। ফ্যাশন সচেতন মেয়েরা যারা কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকে বলে হিল পরতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করেনা তাদের অনেকেই এই স্যান্ডেলগুলো বেছে নিচ্ছেন। পশ্চিমা ধাঁচের পোশাকের সাথে এই স্যান্ডেলগুলো  খুব সুন্দর মানিয়ে যায়। এছাড়াও স্যান্ডেল পরে পার্টিতে যাওয়া যায়না এই মিথ ভেঙ্গে দিচ্ছে আজকালকার স্টাইলিশ স্যান্ডেলগুলো। সেগুলোর ওপরে অসাধারণ সুন্দর কাজ চপ্পলগুলতে যোগ করছে ফ্যান্সি আবেদন। শুধু তাই নয় চপ্পলগুলোর পেছনটা বন্ধ ডিজাইন করে এগুলোকে অফিসে পরার উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। ডিজাইনার এই স্যান্ডেলগুলোর দাম শুরু হয়েছে পাঁচশো টাকা থেকে।

চিকিৎসকদের মতে ফ্ল্যাটজুতোর তেমন কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই। তবে রাজধানীর ইমপালস জেনারেল হাসপাতালের অস্থিচিকিৎসা বিভাগের প্রধান ডা. পারভেজ শাহেদি জানান, জুতোর সোল যাতে নরম হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। এছাড়া একদম ফ্ল্যাট না হয়ে  জুতোতে যদি হালকা হিল থাকে সেটি শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে বলে জানান ডঃ শাহিদি।

এই স্যান্ডেলগুলো পরলে পায়ের অনেকটা অংশ খোলা থাকে বলে ঘরে ফিরে পায়ের আলাদা যত্ন নেয়া খুবই দরকারি। তবে এখনকার ডিজাইনার স্যান্ডেলগুলোতে খুব কায়দা করে ডিজাইন দেয়া হয় এমনভাবে যে পায়ের অনেকটা অংশও ঢাকা পড়ে। আবার কোন কোন স্যান্ডেলতো পেছনদিকে ফিতে দিয়ে পা’কে সঠিকভাবে জুতোতে আটকে রেখে ভারসাম্য রক্ষার কাজও করে। অনেক স্যান্ডেলের পেছনে খুব হালকা করে হিলও দেয়া হয় যেন স্যান্ডেল পরে অনেকক্ষণ থাকা যায়। গ্যালারি অ্যাপেক্স, বাটাসহ বেশ কিছু দোকানে এই স্যান্ডেলগুলো পাওয়া যায়।

 

 

সারাবাংলা/জেএম/এসএস

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর