Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দ্বিতীয় সন্তান কখন নেবেন?


২৮ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:৫৪

রাজনীন ফারজানা।।

‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’ পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে এই বাক্য দুটির সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। রাস্তার পাশের বিশাল বিশাল হোর্ডিং, টিভির বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে অনেকেই দুটো সন্তান নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা সাজায়। তবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে গিয়ে এখন অনেকেই একটি মাত্র সন্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কারণ, সন্তান জন্মদানের পর তাকে ঠিকভাবে বড় করে তোলা একটা বড় দায়িত্ব।

বিজ্ঞাপন

সীমা (৩৮) এবং কবীর (৪০) দম্পতির সন্তান মিমের বয়স যখন পাঁচ তখন তারা দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কর্মজীবী বাবা মায়ের সন্তান হওয়ায় মিম ছোটবেলা থেকেই কাজের লোকের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছেন। সীমা ও কবীরের বাবা–মা এসে দেখাশোনা করেছেন মাঝেমধ্যেই। মূলত মিমের একাকীত্ব অনুভব করেই তারা আরেকটি সন্তান নিতে চাইতেন। কিন্তু সবসময় দেখাশোনা করার মত কাছের কোন লোক নেই, তাই চাইলেও আর দ্বিতীয় সন্তান নেওয়া হয়নি। এসব ছাড়াও সীমার অসুস্থতা, নিরাপত্তাজনিত সমস্যা, বেবি সিটারের অভাব ও অর্থনৈতিক কারণে এক সন্তান নিয়েই সন্তুষ্ট আছেন এই দম্পতি।

সীমা ও কবীর দম্পতির মতই কমবেশি আমরা সবাই এখন পূর্ব পরিকল্পনা করে নিজেদের জীবন সাজাই। কবে চাকরি, কবে বিয়ে, কয়টা সন্তান, কতটা সেভিংস, কবে বাড়ি, কবে গাড়ি, সন্তানের ভবিষ্যৎ সবই থাকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার আওতায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় শিক্ষাবর্ষে পিছিয়ে অনেকেরই চাকরি জীবন শুরু করতে দেরি হয়। আজকাল কেউই ক্যারিয়ার স্থিতিশীল না করে হুট করে বিয়ে কিংবা সন্তানের দিকে ঝুঁকতে চায়না। একটা সন্তানকে ঠিকভাবে মানুষ করতে গিয়ে অনেকেই আবার দ্বিতীয় সন্তান নিতে চান না। তবে অনেকেই অন্তত দুটো সন্তান চান। সেক্ষেত্রে শারীরিক মানসিক সুস্থতার পাশাপাশি প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা।

বিজ্ঞাপন

মা তাসমিয়াহ নুহিয়া আহমেদ, মেয়ে  নাজারাত ও ছেলে নিহান

একটা দম্পতি কখন তাদের দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণ করবেন তার আসলে নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। মা বাবা ও প্রথম সন্তানের বয়স কত হবে তাও নির্দিষ্ট নয়। একই পরিকল্পনা একটা পরিবারের জন্য ফলপ্রসূ হলে অন্য পরিবারের জন্যও হবে, তাও নয়। অনেকে তিরিশের আগেই দুটো সন্তান নিয়ে নেন আবার অনেকেই তিরিশের পরে বিয়ে করেন ও সন্তান নেন। যেমন ভারতীয় অভিনেত্রী হেমা মালিনীর ৩৩ বছর বয়সে প্রথম সন্তান এশা দেওলের জন্ম হয়। আর দ্বিতীয় সন্তান অহনা দেওলের জন্ম হয় যখন অভিনেত্রীর বয়স ৩৭। অন্যদিকে ৩৮ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের মা হন আরেক  অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন।

সুস্থ জীবনযাপনের উপর সুস্থ প্রেগনেন্সি নির্ভর করে। জেড এইচ শিকদার মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর শেখ জিন্নাত আরা নাসরীন বলেন, সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রকম রোগব্যাধির সম্ভাবনা থাকে যার প্রভাব পড়ে সন্তানের সুস্থতার উপর। তাই দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রীর বয়স ৩৫ ও স্বামীর বয়স ৪০ এর মাঝে থাকার পরামর্শ দেন তিনি। নানাবিধ রোগের সম্ভাবনা থাকা ছাড়াও চল্লিশের পরে পুরুষের স্পার্ম কোয়ালিটি খারাপ হতে থাকে। বিশেষত নিয়মিত ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে স্পার্ম কোয়ালিটি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্পার্ম কোয়ালিটি খারাপ হলে কী হয়? অধ্যাপক জিন্নাত বলেন, এতে করে বাচ্চার অস্বাভাবিক হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

তবে কি কেউ চল্লিশের পরে বাচ্চা নেন না কিংবা নেবেন না?

অনেকেই নিচ্ছেন এবং রীতিমত সুস্থ্ সবল সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। সন্তান নেয়ার আগে একজন বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিৎ। ক্রোমোজোমে কোন সমস্যা আছে কিনা তা আগেই পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া যায়। আর গর্ভের শিশুটির কোন অ্যাবনরমালিটি আছে কিনা তাও জানা সম্ভব। সাধারণত নয় থেকে দশ সপ্তাহের মাঝেই বোঝা যায় গর্ভের শিশুটি সুস্থ কিনা। তখন সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয় বলে জানান অধ্যাপক জিন্নাত। তাই যারা পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশের পরে দ্বিতীয় সন্তান নিতে চান তারা গাইনোকলজিস্টের সাথে যোগাযোগ করেই পরিকল্পনা করুন।

আবার অনেক সময় দেখা যায় প্রথম গর্ভধারণের সময় কোন ধরনের জটিলতা থাকলে দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রেও একইরকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। আবার জটিলতা নাও দেখা দিতে পারে।

পারিজা ও পৃথিকা

মিতু তার ছয় বছরের মেয়েকে দেখতেন একা একা এ ঘর ও ঘর করে বেড়ায় না হয় টিভি দেখে সময় কাটায়। ওনারা স্বামী-স্ত্রী মিলে কথা বললে দেখতেন মেয়েটা একা বোধ করে। কথায় কথায় রাগ করে। তাই মেয়ের একাকীত্ব ঘোচাতেই দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। এদিকে প্রথম সন্তান যখন গর্ভে তখন মাঝমধ্যে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিত মিতুর। চিকিৎসক জানান, দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা নাও দিতে পারে। গর্ভধারণের প্রায় দুই থেকে তিন মাস পর মিতুর সেই পুরনো অক্সিজেন ঘাটতির সমস্যা ধরা পড়ে। সেই সাথে নতুন জটিলতা হিসেবে দেখা যায় এবার তার ফ্লুইড গ্রো হচ্ছে কম। ফলে গর্ভধারণের পুরোটা সময় মিতুকে অসম্ভব সতর্কতার সাথে কাটাতে হয়েছে। প্রায়ই হাসপাতালে গিয়ে অক্সিজেন নিয়ে আসতে হয়েছে। পরে সন্তানদের সময় দিতে গিয়ে মিতুকে তার চাকরিটা ছাড়তে হয়েছে। একটা নামকরা কলেজের ম্যানেজমেন্টের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন তিনি। বাচ্চাদের দেখাশোনা করার মত বিশ্বস্ত লোক বা আত্মীয় থাকলে মিতুকে হয়ত চাকরি ছাড়তে হত না।

যেহেতু দ্বিতীয় সন্তান নেয়া সাথে কেরিয়ার, দাম্পত্য, প্রথম সন্তানের মানসিক অবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয় জড়িত তাই সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে জানান সিনয়র কনসালটেন্ট ও শিশু মনরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মনোয়ারা পারভীন জাহাঙ্গীর। ড. মনোয়ারা আরও বলেন, পরিকল্পনা প্রয়োজন প্রথম সন্তানের সাথে বয়সের পার্থক্য, প্রথম সন্তানকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা, মায়ের মানসিক অবস্থা ইত্যাদি সব বিষয়েই।

প্রথম সন্তানের সাথে বয়সের পার্থক্য কত হবে তা আসলে নির্দিষ্ট না। মুরব্বীরা প্রায়ই বলেন, অল্প ব্যবধানে বাচ্চা হলেই ভালো, এতে দুই বাচ্চা একসাথে বড় হয়ে যাবে। শিশু মনোবিদ ড. মনোয়ারার কথায়ও পাওয়া গেল সেই কথার আভাস। তিনি বলেন, দুই বছরের ব্যাবধানে বাচ্চা নিলে ভালো হয়। এতে করে দুই সন্তান একসাথে বেড়ে ওঠার পথে একসাথে খায়দায়, ঘুমায়, খেলাধুলা করে। তারা যদি মারামারিও করে তবুও দেখা যায় তাদের মাঝে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে।

মায়ের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রথম সন্তানের সাথে বয়সের ব্যবধান চার হলে ভালো হয় বলে জানান স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জিন্নাত। এই সময়ের মধ্যে একজন মা আবার আগের মত সুস্থতা ফিরে পান।

দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিশু মনরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মনোয়ারা বলেন, এক্ষেত্রে প্রথম সন্তানের সাথে বাবার সম্পর্ক ভালো করতে হবে। গর্ভধারণের আগে থেকেই বাবা যেন তাকে বেশি করে সময় দিতে থাকে। এতে করে সে বাবার জন্য অপেক্ষা করবে ও মায়ের উপর নির্ভরতা কমাবে। ফলে মা যখন গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান, নবজাতকের দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তখন সে মাকে অতটা মিস করবে না। এতে করে মায়ের জন্য দুই বাচ্চা সামলানো সহজ হয়ে যাবে।

আবার অনেক সময় পরিবারে আরেকটি শিশু আসলে প্রথম সন্তানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রথম সন্তানকে অনেক আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত করা দরকার বলে মনে করেন ড. মনোয়ারা। তিনি বলেন, ছবি আঁকার ছলে শিশুকে বোঝাতে হবে যে একটা পরিবারে বাবা-মা আর ওর পাশাপাশি আরেকটা বাচ্চাও আসবে। চারজন মিলে পূর্ণ হবে ওদের পরিবার, এভাবে বোঝাতে হবে। সবসময় ‘তোমার ভাই’ বা ‘তোমার বোন’ হিসেবে সম্বোধন করতে হবে নতুন শিশুকে। এতে করে সে শিশুটিকে আপন বলে ভাবতে শিখবে বলে জানান তিনি। আবার নতুন শিশুর জন্য কোন কিছু কেনাকাটা করলে প্রথম শিশুর জন্যও কিছু কেনার পরামর্শ দেন তিনি।

সবমিলিয়ে একটা পরিবারের একটা শিশুর আবির্ভাব মানে নতুন করে কিছু খুশি, হাসি ও কান্নার গল্প তৈরি হওয়া। সেই গল্পটা সুন্দর হবে যদি গর্ভধারণ থেকে শুরু করে শিশুর জন্ম, বেড়ে ওঠা সবকিছু সঠিক পরিকল্পনামত হয়।

 

মডেল-

মা রুম্মান ও মেয়ে পারিজা ও পৃথিকা

মা তাসমিয়াহ নুহিয়া আহমেদ এবং মেয়ে  নাজারাত ও ছেলে নিহান

 

 

সারাবাংলা/আরএফ/এসএস

 

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর