নুহাশ পল্লিতে বৃষ্টিস্নান
১৩ নভেম্বর ২০২২ ১৪:০৮
“বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান…বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান। যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে এসো গান করি, মেঘ মল্লারে করুণাধারা দৃষ্টিতে আসবে না তুমি, জানি আমি জানি, অকারণে তবু কেন কাছে ডাকি। কেন মরে তৃষ্ণাতে, এই এসো না চলো জলে ভিজি শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে”।
গাড়ির সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে আসছিল হাবিব ওয়াহিদের গাওয়া অসাধারণ গানটি। বাদলা দিনে আমরা গিয়েছিলাম গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকায় অফিসিয়াল ট্যুর-এ। সারাদিন গাদা গাদা কাজ করতে কিছুটা একঘেয়েমি অনুভব করছিলাম। অতঃপর ডাকবাংলোতে বসে ভাবছিলাম অবকাশ যাপনে যাওয়া দরকার। বর্ণ ও তার মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লিতে। গাড়ি ছুটে চলেছে, আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে। আকাশে মেঘরাশি কেমন জানি দলবদ্ধ হয়ে ঝুলে আছে। জলীয় বাষ্পগুলো উড়ছে মেঘের ভেলায় চড়ে। একটু পড়ে মনে হয় আকাশের পেট চিড়ে নামবে বৃষ্টি। গুড়ুম গুড়ুম বজ্রপাতের শব্দ। আকাশ জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামল। গাড়ির স্বচ্ছ কাচের উপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ছে টুপটাপ করে। বর্ণ-ও তার মা আফরোজা পাগলামি শুরু করল, চলো বৃষ্টিতে ভিজি। বর্ণ গাড়ির কাচে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। আফরোজাকে বললাম নুহাশ পল্লিতে গিয়ে বৃষ্টি বিলাসে ভিজতে পারবে!
গাজীপুরের কাছে হুতাপাড়া বাজার হয়ে যে সড়কটি উত্তর পাশে চলে গেছে ঠিক তার মাঝখান দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে মেঠো পথে কাদা মিশ্রিত পানিতে গাড়ির চাকা আটকে যাচ্ছিল বারবার। রাস্তার পাশে শালবন, গজার, সেগুন আরো নানা প্রকৃতি গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে। একেবারে পাখি ডাকা ছায়াঘেরা এক বন। গাড়ি এসে থামল পিরুজালী গ্রামের নুহাশ পল্লির মূল ফটকের সামনে। হুতা পাড়া বাজার থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ পেরুলে নুহাশ পল্লি। বৃষ্টির ছাট কিছুটা কমে এসেছে। বৃষ্টির ছোঁয়া নিয়ে নুহাশ পল্লিতে প্রবেশ করলাম। নুহাশ পল্লিতে প্রবেশ করতে হলে ২০০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। নুহাশ পল্লিতে অর্জিত আয় দিয়ে পল্লির রক্ষাণাবেক্ষণ খরচ এবং লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত করা নেত্রকোণার কুতুবপুর গ্রামের শহীদ বিদ্যাপীঠের যাবতীয় খরচ মেটানো হয়। নুহাশ পল্লিতে প্রবেশ করলে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে। প্রকৃতির বিছিয়ে দেওয়া সবুজ গালিচা বিছানো পুরো মাঠ জুড়ে দূর্বা ঘাসের চাদর। আফরোজা হাত দিয়ে বৃষ্টিভেজা ঘাসগুলো স্পর্শ করে তার মুখে লাগাতে লাগল। বর্ণ চিৎকার করে বলছে বাবা ওয়াও কী সুন্দর নুহাশ পল্লি! বাবা দেখো ভূত ভূত।
লেখক হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯৭ সালে ৪০ বিঘা জমির উপর এটি গড়ে তোলেন। নুহাশ পল্লিতে লেখক তিন তিনটি বাংলোঘর স্থাপন করেছেন। সত্যি দেখার মতো। একজন লেখকের যে এত চমৎকার রুচি সত্যি অবিশ্বাস্য। নুহাশ পল্লিতে না আসলে বুঝাই যাবে না যে গাজীপুরের হুতা পাড়ার পিরুজালী গ্রামের ছবির মতো ছায়া ঘেরা সুন্দর এক পল্লি। লেখক তার সন্তানের নামে নাম রেখেছেন নুহাশ পল্লি। ছোটো পাকা বাংলোটির পাশে আপেল গাছ। তার একটু সামনে কাঠের নকশা করা বৃষ্টি বিলাস বাংলো। বাংলোর ভিতর শুটিংর সরঞ্জাম আরও কত কী। কিছুটা দূরে ভূত বিলাস বাংলো। ছোটো একটি সুইমিং পুল নির্মাণ করেছেন। লেখক মাঝে মাঝে সুইমিং পুলে নেমে গলা পরিমাণ পানিতে বসে থাকত কখনো, কফি চা পান করত। আড্ডা দিত প্রিয়জনদের সাথে। পাথরের ফলকে খোদাই করা লিখা আছে, “রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান আমার ছোটো বাবাকে মনে করছি”। একটু দূরে বড়ো এক দৈত্য দানবের মূর্তি হাত বের করে দিয়ে হাঁ করে বসে আছে। তার অপর পাশে পদ্মপুকুরে জীবন্ত এক মৎস্যকন্যার মূর্তি দেখলে মনে হবে যেন দিঘিতে হেঁটে হেঁটে পদ্ম ফুল তুলতে ব্যস্ত আছেন। পাশে দাবার গুটির প্রতিকৃতি, টি হাউজ, নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। পল্লির একপাশে চোখে পড়বে শুভ্র বর্ণের হুমায়ূন আহমেদের আবক্ষ মূর্তি , লেখক হুমায়ূন আহমেদকে কোনো এক জন্মদিনে তার পরিবারের পক্ষ থেকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও নয়নাভিরাম লেখক হুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লিতে হরেক রকমের নাম না জানা বৃক্ষ রয়েছে সত্যি তিনি যে এক আজব বৃক্ষপ্রেমী তা নুহাশ পল্লিতে এসে টের পেলাম।
প্রায় ২৫০ প্রজাতির দুর্লভ ঔষধি গাছ, ফলদ, বনজ, ভেষজ আরও কত বাহারি বিদেশি ফুলের গাছ রয়েছে। লেখক বিদেশে থেকে এনে নিজ হাতে চারাগাছগুলো লাগিয়েছেন। গাছগুলোকে যত্ন করতেন শিশুর মতো। বাংলোর পিছনে বিদেশি খেজুরের গাছও চোখে পড়বে। একটু সামনে গেলে ছোটো একটা চা বাগান। মাঠের চারিদিকে হরেক রকমের বনজ ও ফলদ গাছ। মাঠের এক পাশে জীবন্ত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি দেবী তার নিচে ছোটো একটি শিশু। তার এক পাশে কুমারী দেবী, হাতে ফলের কাঁচা। অন্য পাশে বসার দোলনা। ছোটো ছোটো কিছু মাটির কুটিরও চোখে পড়বে। একটু সামনে গেলে দেখা মিলবে আমগাছের উপর ছোটো একটি টিনের কুঁড়েঘর। লেখক নিজে মাঝে মাঝে কুঁড়েঘরে বসে বই পড়তেন। না হয় চুপচাপ বসে থাকত। মাঠের ঠিক পিছনে রয়েছে। লীলাবতি দিঘি। মাঠের মাঝখানে মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো আছে নামাজের স্থান। তার অন্যপাশে ছোটো একটা লিচুবাগান। লিচুবাগানের মাঝখানে চিরতরে শুয়ে আছে প্রিয় লেখক, প্রকৃতিপ্রেমী, বৃক্ষপ্রেমী, বৃষ্টিপ্রেমী, জোছনাপ্রেমী, হুমায়ূন আহমেদ স্যার। দিঘি লীলাবতীর পাড়ে রয়েছে কাঠের সাঁকো। পক্ষীরাজ নৌকা, পাথরে খোদাই করে লিখা, নয়ন তোমারে পাই না দেখিতে রয়েছে নয়নে নয়নে। লাইন দুটি পড়ে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ল। আফরোজাকে বললাম দেখো, সত্যি আমি যেন জীবন্ত এক হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে অনুভব করছি। মনে হচ্ছিল এইতো লেখক মোড়ায় বসে আছেন, দোলনায় চড়ছেন, মাঝে মাঝে যেন মেঝেতে বসে কাঠের পিঁড়িতে বসে বসে গল্প লিখছেন। নাটকের শুটিং করছেন নুহাশ পল্লিতে। দিঘিতে বড়শি নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। মাঝে মাঝে আদা আর এলাচি মিশ্রিত ধূমায়িত লাল চায়ের মগে চুমুক দিচ্ছেন ফুড়ক ফুড়ক করে।
জোছনা রাতে গানের আসর বসে আছেন। হুমায়ূন স্যারের দিক নির্দেশনায় গলা ছেড়ে কে যেন গাইছে, ওগো দয়ার সাগর ওগো দয়াময়, চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। গান শুনতে শুনতে জোছনার সুধা পান করছেন লেখক। মাঝে মাঝে যেন হলুদ পাঞ্জাবি পরিধান করে কদম ফুল হাতে নিয়ে বৃষ্টিতেও ভিজছেন প্রিয়জনদের নিয়ে। একটু পরে টের পেলাম, আমি যেন প্রিয় লেখক হুমায়ূন বন্দনায় মগ্ন হয়ে তন্দ্রা বিলাস করছিলাম। তন্দ্রা কেটে গেলে টের পেলাম আমি আর আফরোজা বৃষ্টিতে ভিজছি দুজনের মাঝখানে নেচে নেচে ভিজছে আমার মেয়ে বর্ণ। বারবার কেন জানি ছুটে যাচ্ছিলাম, লিচুবাগানে যেখানে লেখক চিরতরে শুয়ে আছেন ঠিক সেখানে। এক সময় তিনজনে মিলে, হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করলাম। হে মহান সৃষ্টিকর্তা আপনি আমার প্রিয় লেখককে জান্নাতের বাগানের ফুল ফুটিয়ে রাখেন। যেদিন প্রিয় লেখক চির বিদায় নেন, সেদিনটির কথা বারবার মনে পড়ছিল, বৃষ্টিস্নাত এক পড়ন্ত দুপুরে লেখকের কফিন স্পর্শ করে চির বিদায় দিয়েছিলাম। ১০টি বছর বৃক্ষের পাতার মতো ঝরে গেল লেখক হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মাঝে নেই। বিশ্বাস হয় না আমার। মনে হয় প্রতি বছরেই তিনি একুশের বইমেলায় আসেন হলুদ পাঞ্জাবি পরিধান করা হিমু সেজে। বইয়ের স্টলে বসে তার ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। জোছনা রাতে নুহাশ পল্লিতে পায়চারি করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
যখন সমাধিস্থল ত্যাগ করছিলাম ঠিক তখনই আবার বৃষ্টির ছোঁয়া এসে স্পর্শ করে কানে কানে বলে গেল, মরিলে কাঁদিসনে আমার দায়, মরিলে কান্দিনস না আমার দায়! রে জাদু ধন মরিলে কান্দিনস না আমার দায়! সুরা ইয়াসিন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়! যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায় রে জাদু ধন মরিলে কান্দিনস না আমার দায়! প্রিয় লেখক আপনি শান্তিতে ঘুমান, ৭৪তম জন্মদিনে আপনাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। কে বলেছে তুমি নেই। তুমি আছ মোর হৃদয়ে নীরবে নিভৃতে !
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি