সেই থেকে সবার কাছে রক্তভিক্ষা শুরু!
৭ মে ২০১৮ ১৮:০৭
এমদাদুল হক তুহিন।।
‘ভাই, রক্ত প্রয়োজন।’
‘আপু, রক্ত লাগবে।’
‘কোথায়, কয় ব্যাগ ও যোগাযোগের ঠিকানা অর্থাৎ যার সঙ্গে যোগাযোগ করবে, তা লিখে টেক্সট করুন।’
কথোপকথনগুলো রক্ত জোগাড়ের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলা। মুঠোফোন অথবা ফেসবুকের ইনবক্সে টেক্সট আসার পর তা নিজের টাইম লাইনে পোস্ট করছে বর্তমান সময়ের হাজারো তরুণ। সঙ্গে সঙ্গেই তার অন্য বন্ধুরাও তা শেয়ার করছে নিজের ওয়ালে। এতে রক্ত সম্পর্কিত জরুরি ওই বার্তাটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকে। আর দ্রুতই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নির্দিষ্ট গ্রুপের এক বা একাধিক রক্তদাতা। কোন কোন ক্ষেত্রে ‘ডোনার ম্যানেজ’ হয়ে যাওয়ার পরও অনেককে নক দিতে দেখা যাচ্ছে।
রক্ত সংগ্রহের কাজে দীর্ঘদিন পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকার পূর্বাপর অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় এমন একটি সময় ছিল যখন বলা হত, নির্দিষ্ট সময়ে রক্ত না পেয়ে অপারেশন পিছিয়ে যাওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। এমনকি বর্তমানেও ধারণা করা হয়, বিরল গ্রুপের রক্ত না পেয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। তবে তথ্য-উপাত্তের চিরচেনা বিশ্লেষণে না গিয়ে তারুণ্যের ‘উৎসাহকে’ পুঁজি করে বর্তমানে এসে বলা যায়- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সংখ্যক ডোনার ম্যানেজ হচ্ছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রক্তদান ও রক্তসংগ্রহের কাজে আগ্রহের শেষ নেই। এমনকি, নিজে রক্ত দেয়া ছাড়াও ‘ডোনার ম্যানেজে’ তারা মহাব্যস্ত। খোদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে মাত্র ১ ঘন্টার ব্যবধানে ৬০ থেকে ৭০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহেরও নজির রয়েছে।
কয়েক দিন আগেই মিরপুরের হার্ট ফাউন্ডেশনে কথা হয় আলিফ নামের এক যুবকের সঙ্গে। সে ৩ থেকে ৪ বছরের এক শিশুকে রক্ত দিতে এসেছিল। তবে রক্ত দিয়ে ফেরার পথে ছেলেটি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ হিসেবে জানা যায়, শিশুটির মায়ের দুরাবস্থার কথা শুনে সে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রক্ত দিতে গিয়েছিল। অর্থাৎ তখনও তার রক্ত দেয়ার সময় হয়নি। ওই মুহূর্তে ছেলেটি এবং তার সঙ্গে রক্ত দেয়া আরও দুই ডোনারের কেউই রক্ত গ্রহীতার কাছ থেকে পানি ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেনি। এমনকি জুস কিংবা তরলজাতীয় অন্য কিছুও! এতে কোন কোন ক্ষেত্রে দূর্বল রক্তদাতারা আরও বেশি দূর্বল হয়ে পড়ে। আলিফের ক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই।
এক সন্তানের জননী ফারহানা ইন্দ্রা। দুই বছরের কন্যা নৈঋতাকে বাসায় রেখে ছোটভাইকে সঙ্গে নিয়ে সম্প্রতি মিরপুরের হার্ট ফাউন্ডেশনে রক্ত দিয়ে এসেছেন তিনি। তবে রক্ত দেয়ার সময় তাকে বেশ উচ্ছ্বল দেখালেও হাসপাতালে থাকা অবস্থায় পানি ছাড়া তরল জাতীয় অন্য কিছু গ্রহণ না করায় বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। কথা বলে জানা গেছে, রক্ত দেয়ার পেছনে উজ্জীবিত শক্তি হিসেবে তিনি ‘রক্তকে রক্ত হিসেবেই’ বোঝেন। তারমতে, রক্ত এমন একটা জিনিষ যেটা বানানো যায় না। তাই পরিবার ও সন্তান সামলানোর মতো বাধাবিপত্তি পেরিয়েও নিয়মিত রক্ত দিচ্ছেন তিনি।
মূলত, রক্ত নিয়ে সংগঠনভিক্তিক কাজ ঐহিত্যগত। দেশে ‘স্বেচ্ছায় রক্ত দিন, জীবন বাঁচান’ স্লোগানকে ধারণ করে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে সন্ধানী, বাঁধন, রেড ক্রিসেন্ট ও কোয়ান্টামের মত সংগঠন। প্রতিযশা এসব সংগঠনের বাইরে বর্তমান সময়ের তরুণরাও সংগঠন গড়ে তুলে কাজ করছে। তবে সংগঠনের বাইরে ব্যক্তি উদ্যোগে রক্ত সংগ্রহের কাজ বেশ প্রশংসনীয়। আর ফেসবুকের কল্যাণে তা আরও বেশি জনপ্রিয়।
ব্যক্তি উদ্যোগে রক্ত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন নুসরাত জাহান লাকী। মুহূর্তেই বিরল গ্রুপের রক্ত ম্যানেজ করে দেয়ার সক্ষমতায় বন্ধুমহলে তিনি রক্তকন্যা নামে পরিচিত। তার ভাষায়, রক্তদানে কাছের মানুষদের নানাভাবে উৎসাহিত করি। কেউ আগ্রহ দেখায়, আবার কেউবা অনীহা। তবে এখন মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। তিনি বলেন, ফেসবুকে এখন পোষ্ট দিলেই মানুষ জেনে যাচ্ছে মূমুর্ষ রোগীর চাহিদার খবর। আগে যেটা মোটেও সম্ভব ছিল না। লাকীর মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রক্ত সংগ্রহের কাজকে আরও সহজ করে দিয়েছে।
ছাত্র মৈত্রীর সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু। লালবিপ্লবের স্বপ্ন দেখে রাজপথ কাঁপানো এই নেতার ফেসবুক পোস্টের বড় অংশই এখন রক্ত নিয়ে। রক্ত নিয়ে কাজের পেছনের কারণ হিসেবে জানালেন, ‘বয়স যখন ১৮ পূর্ণ হয়নি, মাস দুয়েক বাকি, যশোরের রূপদিয়ার অরুণোদয় সাংস্কৃতিক সংস্থার একটা অনুষ্ঠানে রক্তদান ক্যাম্প করেছিলাম। তখন রক্ত দিয়ে শুরু। তারপর থেকে চলছে। তার ভাষায়, একবার আমার রক্তদানের তিনমাসও পূর্ণ হয় নি, এক মায়ের রক্ত লাগবে, আমার গ্রুপ। আমি দিতে পারি নি, বি নেগেটিভের মত বিরল গ্রুপ, রক্ত জোগাড় হয় নি, ওই মা বাঁচেননি। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, কেঁদেছিলাম। তারপর থেকে সবার কাছে রক্তভিক্ষা করা শুরু। সেই থেকে চলছে।
সাবরিনা সিরাজী। কবি হিসেবে পরিচিত। লেখালেখির বাইরে রক্ত নিয়ে তার কাজও দীর্ঘদিনের। তার ফেসবুকের ওয়ালের অধিকাংশ পোস্টও রক্ত নিয়ে। একইভাবে সংগঠক ও কবি অনিমেষ রহমানের ফেসবুক ওয়ালেও রক্ত নিয়ে পোস্ট চোখে পড়ার মত।
পাভেল বাবু। রক্ত নিয়ে তিনিও কাজ করছেন দীর্ঘদিন। গড়ে তুলেছে ‘প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন। বর্তমানে এই সংগঠনটি রক্ত সংগ্রহ ছাড়াও পথশিশু ও ফুড ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করছে। রক্ত সংগ্রহের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানালেন, ব্যক্তিগতভাবে ২০০৭ সাল থেকেই আমি রক্ত দিয়ে আসছি। একটা সময়, ফেসবুকে রক্ত নিয়ে অনেককেই স্ট্যাটাস দিতে দেখেছি। গ্রুপ মিলে গেলে তখন ওইসব নম্বরে কল দিয়ে রক্ত দিয়ে আসতাম। নিজে রক্ত দেয়া ছাড়াও তখন বন্ধুবান্ধবকে কল করে অন্য গ্রুপের রক্তও ম্যানেজ করে দিতাম। তবে ফেসবুকে তখন এসব নিয়ে পোস্ট দিতাম না। বলা চলে আড়ালেই ছিলাম। ২০১২ সালের দিকে ফেসবুক গ্রুপ আমজনতার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার পর রক্ত নিয়ে আরও সক্রিয় হই। ধীরে ধীরে রক্ত নিয়ে আমাদের কাজ আরও প্রসারিত হয়।’
এক সময়ের আমজনতার কর্মী, বর্তমানে প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের সহউদ্যোক্তা পাভেল বাবু সারাবাংলা ডটনেটকে বলেন, আমাদের হাতে প্রায় ৫ হাজার রক্তদাতার তালিকা আছে। কারো রক্ত প্রয়োজন হলে, দাতার রক্ত দেয়ার সময় হলে তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। এতে সহজেই ডোনার ম্যানেজ হয়। এছাড়া ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও দ্রুত সময়ে নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্তদাতা সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে।
রক্ত নিয়ে কাজ করার কারণ হিসেবে এই তরুণ বলেন, দেশে বহু রোগী নির্দিষ্ট সময়ে রক্ত না পেয়ে মৃত্যুবরণ করে। আবার দেখা যায় রোগীর লোকেরা চড়া মূল্যে বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত কিনছে। এমনও হয় কেনা ওই রক্ত ব্যবহার উপযোগী নয়। এখন রক্ত নিয়ে কাজটা বেশি হচ্ছে। এতে করে তরুণরা স্বেচ্ছায় রক্ত দিতেও উৎসাহী হচ্ছে এবং রোগীর স্বজনরাও তাৎক্ষণিকভাবে বিশুদ্ধ রক্ত পাচ্ছে।
জানা গেছে, রক্ত নিয়ে ফেসবুক ভিত্তিক কাজ করা কয়েকটি আলোচিত গ্রুপের মধ্যে রয়েছে- ‘কল ফর ব্লাড’, ‘রক্তের আহ্বান’, ‘স্বপ্ন ব্লাড ব্যাঙ্ক’, ‘প্রচেষ্টা ব্লাড ব্যাঙ্ক’, ও ‘রক্ত দানের অপেক্ষায় বাংলাদেশ।’ তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পরিচিত গ্রুপটি হচ্ছে ‘কল ফর ব্লাড’। দীর্ঘদিন কাজ করছে এমন কয়েক ব্যক্তির ভাষ্যমতে, কল ফর ব্লাড গ্রুপটির কর্মকান্ডকে অনুসরণ করেই ফেসবুকের অন্যান্য গ্রুপ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
ফিচার ফটো- পাভেল বাবু ও মিনান্নুর আক্তার রুমি
সারাবাংলা/ইএইচটি/এসএস