[পর্ব-২১] ছাদবাগানে রবির প্রিয় ঝুমকোলতা আর নীলচিতার বাহার
৮ মে ২০১৮ ১৫:৫১
‘‘আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল সে
বসন্তের বাতাস টুকুর মতো
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুঁয়ে গেল না রে
ফুল ফু্টিয়ে গেল শত শত
সে চলে গেল, বলে গেল না
সে কোথায় গেল ফিরে এল না
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল
কী যেন গেয়ে গেল
তাই আপন মনে বসে আছি
কুসুমবনেতে….”
এই গানের সাথে চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই সফেদ বেশে রবিকবি সবুজ বনের ঘাসে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। প্রতিটা বৃক্ষ, লতা, ফুলের দিকে লক্ষ্য করছেন। প্রিয়জনদের হারানো সময়কে পিছে ফেলে, নিজের মনকে সান্তনা দিচ্ছেন। হয়তোবা নিজের একাকী জন্মতিথিতে প্রিয় স্বজনদের খুঁজে ফিরছেন। ফুলের মাঝে, বনের ভেতর।
তাঁর হাহাকারের নিস্তব্দতার গভীরতা, শুধু কুসুমবনেরা জানে। নীল চিতার নীলাভ রঙ জানে। ঝুমকোর বেগুনী সাদা কেশড়ের বাঁকগুলো জানে।
‘‘সে চাঁদের চোখে
বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর
সে প্রাণের কোথায়
দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর
কুসুমবনের উপর দিয়ে
কী কথা সে বলে গেল
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে
সঙ্গে তারি চলে গেল
হৃদয় আমার আকুল হল
নয়ন আমার মুদে এল রে
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে”
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ফুলগুলোর মাঝে দুটি ফুল আমার ছাদবাগানে আছে। একটি প্যাশন ফ্লাওয়ার নামে পরিচিত। রবীকবি ঝুমকোলতা নামে ডাকতেন। আরেকটি ফুল হচ্ছে নীল চিতা লতা। অনেকে নীলমণি ফুলের সাথে এর তুলনা করলেও, নীল চিতা একেবারেই অনন্য এবং অদ্বিতীয় এক ফুল। খুব কাছ থেকে দেখলে নীল চিতার আলাদা সৌন্দর্য আরো বেশি করে চোখে ধরা পড়ে। অবাক কান্ড এই যে ঝুমকো এবং নীল চিতা দুটো ফুলই পাহাড়, বন বা জঙ্গলে বেশি দেখা যায়।
একটি লতানো আরেকটি ঝোপ ধরে থাকা গাছ। সারা বছর একটা দুটো ফুল ফুটতেই থাকে। তবে বৈশাখে তাদের বারবাড়ন্ত থাকে। প্রচুর ফুল ফোটে। নতুন লতা আর ডালে ভরে যায় গাছ। এই মাসে রবিকবির জন্মদিন। হয়তো বা সে কারণেই তাঁর প্রিয় ফুল এরা। বনের মাঝে প্রিয়জনের মুখ হয়ে তাঁর সামনে আসতো তারা, বারবার। প্যাশন ফ্লাওয়ার, ঝুমকো বা শঙ্খচক্রগদাপদ্ম।
প্রতিদিনই আমি স্রষ্টার সৃষ্টিশীলতায় বিস্মিত হই। ছোট্ট এই ফুলটাতে শঙ্খ, চক্র, গদা সবই আছে। কী নিপুণ শৈল্পিক কারুকাজ! আমার ছাদবাগানে ঝুমকো লতার দুটো রঙ আছে। বেগুনী আর কালচে লাল। আরেকটা রঙ পাওয়া যায়, যা কিনা সাদা অপরাজিতার মতন দূর্লভ, সাদা ঝুমকো। খোঁজে রেখেছি যদি ভবিষ্যতে কোথায় পাওয়া যায়, তার ছবিও সবার জন্য তুলে দেব। নীল চিতা এবং ঝুমকোলতা পোক্ত ডাল থেকে বংশ বিস্তার করে। তার মানে আপনাকে এগুলোকে পেতে হলে তেমন কষ্ট পোহাতে হবে না। শুধু খোঁজ রাখতে হবে কোথায় বা কার কাছে এই গাছ দুটি আছে। শুধু শক্ত পোক্ত ডাল হলেই হয়ে যাবে।
ছোট দুটো মাটির আলাদা টবে বুনে দিয়ে একটু চোখে চোখে রাখতে হবে। বৃষ্টি হলে অবশ্যই গোঁড়ার জল নামিয়ে দিতে হবে। হালকা রোদে রাখলে ভালো। এক দেড়মাসের মাঝেই শুকিয়ে যাওয়া পাতার ফাঁকে নতুন পাতা চলে আসে এদের। তখন তাদের বাসস্থান একটু বড় টবে করে দিলে ভালো। ছয় মাস অন্তর গোঁড়ার কিছু মাটি সরিয়ে জৈবসার দিলে, ফুল হয় অনেক বেশি।
অপরাজিতা ফুলের মতন ঝুমকোলতা প্রথমে কাঁধ খুঁজলেও বড় হবার সাথে সাথে ছোট মাচাং বা বারান্দার গ্রিলে নিজেরাই গুছিয়ে বসবাস করে। ঝুমকো অত্যন্ত সুঠাম লতার অধিকারী হওয়ায় যে কোন কিছু আঁকড়ে ধরে শক্ত করে। নীল চিতা লতানো গাছ মনে হলেও বেশ শক্ত ডাল তার, তাই সহজে লতায় না। প্রতি বছর একবার সামান্য ছেটে দিলে ঝাঁকড়া হয়ে বড় হয়। লতা হয়ে বেয়ে চলার চেয়ে একসাথে ঝোপ ঝোপ হয়ে থাকতে পছন্দ করে।
আমার ভালোবাসার চাষাবাদে যেমন আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া প্রিয় মানুষদের নামে গাছ আছে ঠিক তেমনই প্রিয় মানুষদের প্রিয় গাছও আছে। প্রিয় মানুষদের প্রিয় ফুল ফুটাবার মাঝে এক অপার্থিব আনন্দ আছে, আমার কাছে। যখন ফুলগুলো ছাদবাগানে ফোটে আর মাথা উঁচু করে আমায় দেখে তখন মনে হয় সেই প্রিয় মানুষটি সেই ফুলের রূপ নিয়ে আমাকে দেখছে। ঠিক রবিকবির মতন আমিও ফুলের মাঝে আত্মহাহাকারের নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে দেই।
চাষী পরিবার, সুখী পরিবার।
সারাবাংলা/এসএস