ক্যান্ডির আকাশ তখন কাঁদছিল…
১১ মে ২০১৮ ১৪:৪০
মোহসেনা শাওন।।
গল থেকে ট্রেনে চেপে যখন ক্যান্ডিতে পৌছালাম তখন হয়তো আকাশের মন খারাপ ছিলো। আকাশ যেন কষ্টগুলোকে অঝোর ধারায় ক্যান্ডিতে ঝরিয়ে দিতে চাচ্ছিল। মন কিছুটা খারাপ হলো। কিন্তু ট্রেন থেকে নামতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। মনে হলো বৃষ্টি যেন ধুয়ে মুছে অপরূপ রপ দিয়ে গেছে শহরটিকে। যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য দিয়ে ক্যান্ডি আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে। স্বাগত, হে মহান অতিথি।
সৌন্দর্যের পূজারী কবিরা প্রকৃতির সৌন্দর্যকে আরও সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারেন তাদের কবিতায়। ভাবুকের হৃদয়ে অনির্বচনীয় ভাবের ঢেউ জাগায় প্রকৃতি। ঠিক তেমনই সৌন্দর্যের আধারভূমি ক্যান্ডি। শহরটার যে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে যে কোন দিকেই দৃষ্টিপাত করেন না কেন চোখ দুটো প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে ধন্য হবেই, মনপ্রাণ আনন্দে ভরে উঠবে। কি পাহাড় টিলার রমনীয় শোভা, কী গাছপালা ও তৃণমূল শোভিত বনের মনোরম দৃশ্য, শ্রীলংকার সবই সুন্দর ও অনুপম।
কান্ডিতে এমন একটা স্থান নেই যেখানে সৌন্দর্যের এতটুকু ভাটা পড়েছে। পাহাড়ি জনপদটি শ্রীলংকার সাংস্কৃতিক রাজধানী। শহরটা বেশ ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজন্যবর্গের সর্বশেষ রাজধানী এই শহরটার একসময়ের দাপ্তরিক নাম ছিল সেনকান্ডাগালা শ্রীবর্ধনা মহা নুওয়ারা। ঔপনিবেশিক শাসনামলে পর্তুগিজদের ক্যানডিয়া ইংরেজদের হাতে পড়ে সংক্ষেপিত হতে হতে শেষপর্যন্ত ‘ক্যান্ডি’-তে এসে ঠেকেছে।
চারিদিকে সবুজ পাহাড়, পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট ছোট ঝর্নাধারা আর ঘন বন বানানীতে ঘেরা এই শহরের মাঝখান জুড়ে আছে বিশাল কৃত্রিম জলাধার, ক্যান্ডি লেক। বর্তমান রাজধানী কলম্বোর পরে শ্রীলংকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এটি। অতীত ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনের সমৃদ্ধ ভান্ডার ক্যান্ডিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটি’র মর্যাদা এনে দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত অসংখ্য উপসনালয়ের ভাস্কর্য শৈলী যেমন শহরটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে, তেমনি এটিকে দিয়েছে পবিত্র শহরের মর্যাদা। ক্যান্ডির ডালাডা মালিগাওয়া মন্দিরে মহাপুরুষ বৌদ্ধের একটি ‘দাঁত’ সংরক্ষিত আছে।
ক্যান্ডির মানুষ খুবই সাহায্যপ্রবণ। তারা ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়ায় পর্যটকদের জন্য এখানে বেড়ানো খুব সহজ আর ভাষা নিয়ে ঝামলোয় পড়তে হয়না। যেমনটা চীন বা থাইল্যান্ডসহ অন্য আরও কিছু দেশে ভাষার সমস্যায় পড়তে হয়। ক্যান্ডি লেকের চারপাশেজুড়ে পাহাড়ের ওপরে বেশ সুন্দর সুন্দর হোটেল বা কটেজ আছে। সব রকম দামের হোটেল বা কটেজ পাবেন। নিজ সামর্থ্য ও পছন্দমত বেছে নিতে পারবেন আপনি। মূল শহর থেকে ট্রেন স্টেশন, বাস স্টপেজ, শপিংমল খুব কাছাকাছি। ক্যান্ডি লেক ধরে হাঁটলে চারপাশে অনেক কিছু দেখতে দেখতে যেতে পারবেন। লেকের এক পাশে পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি আছে। আছে ওয়াচ টাওয়ার যেখান থেকে পুরো ক্যান্ডি শহরের সৌন্দর্য সহজেই উপভোগ করতে পারবেন।
লেকের পাড় ঘেঁষে শহরের মাঝ দিয়ে পাহাড়ের শরীর বেয়ে বেশ খানিকটা উপরে উঠলে পাবেন ওয়াইএমবিএ হল বা ইয়ং মেনস বুদ্ধিস্ট এ্যাসোসিয়েশান মিলনায়তন। এখানে প্রতি সন্ধ্যায় আয়োজিত হয় ‘কালচারাল শো’। পুরো শ্রীলংকায় একমাত্র ক্যান্ডিতেই আয়োজন হয় এমন কালচারাল শো। এই আয়োজন দেখতে জনপ্রতি ১০০০ রূপি করে টিকিট কাটতে হবে। বিখ্যাত এই শো দেখতে প্রচুর বিদেশী আসেন। শঙ্খনাদ এবং ঢোলের সম্মিলিত স্বাগত সম্ভাষণের মধ্য দিয়ে শো শুরু হয়। স্বর্গীয় আশীর্বাদ কামনায় পরিবেশিত হয় ‘পূজানৃত্য’। এরপর এক এক করে ময়ূর নৃত্য এবং গ্রামের মেয়েদের পরিবেশিত লোকনৃত্যের মতো অনেকটা পরিচিত ধারার নাচের পরিবেশনা থাকে। শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী নাচ গানের ঘণ্টা খানেকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বেশ উপভোগ্য।
ঠিক এখান থেকে লেকের অপর পাশে টুথ টেম্পলের অবস্থান। বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়ানো এই বৌদ্ধ মন্দিরটা অনেক পুরনো আর এখানকার নিরাপত্তা বেশ জোরদার। ভেতরে টিকিট কেটে ঢুকতে হয় তবে মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা মানা। মন্দিরের বাইরে যত চান ছবি তুলতে পারেন। এই টেম্পল দিনে একরম সুন্দর আর রাতে আরেকরকম। রাত হলে এখানে হাজার হাজার মোমবাতি জ্বালানো হয়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মোমের আলোয় সাদা ধবধবে টুথ টেম্পলের অন্যরকম রূপের ছটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় সবার মনে।
ক্যান্ডি থেকে কিছুটা দূরে আরও কিছু আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। চাইলে সারাদিনের জন্য একটি গাড়ি বা টুকটুক ভাড়া করে সময় নিয়ে দেখে আসতে পারেন সেগুলো। প্রথমেই শহরের একদম কাছে চা বাগান ঘুরে দেখতে পারেন। শ্রীলংকার চায়ের বিশ্বজুড়ে বেশ সমাদর রয়েছে। সেখান থেকে সোজা চলে যাবেন পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজে। পাহাড় আর পাহাড়ি নদীর মাঝে খুব সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়েছে এই অরফানেজ। অরফানেজে ঢুকতে টিকেটের দাম পড়বে বিদেশীদের জন্য ১০০০ রুপি আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর পর্যটকদের জন্য ৭৫০ রুপি করে। তবে হ্যা, এই সুবিধা পেতে সাথে পাসপোর্ট রাখতে ভুলবেন না যেন। এখানে গেলে দলবেঁধে হাতিদের গোসল করানোর দৃশ্য দেখতে পাবেন। আপনি চাইলে নিজ হাতে খাইয়েও দিতে পারেন হাতিদের। তবে তার জন্য আপনাকে বাড়তি পয়সা গুনতে হবে।
এখান থেকে ফেরার পথে ঘুরে আসতে পারেন রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন। বিশাল এই গার্ডেনটি ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। পুরো বাগানটি অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এখানে আছে শত বছরের পুরনো বিভিন্ন প্রজাতির ফল, ফুল, ঔষধি গাছ। সম্পূর্ণ গার্ডেনটি ঘুরে দেখতে হলে মোটামুটি ৩ থেকে ৪ ঘন্টা সময় লাগবে। আর হ্যাঁ ঢোকার আগে ১০০০ রুপী দিয়ে টিকিট এবং বাগানের ম্যাপ নিয়ে নিতে ভুলবেন না কিন্তু। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেনের সৌন্দর্যে আপনি মুগ্ধ হবেনই। যদি হাতে সময় নিয়ে যান আর আপনি হন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় তাহলে করতে পারেন রিভার রাফটিং।
সবশেষে বলি, পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বিস্তীর্ণ উপত্যকা, ঝর্ণা, জলপ্রপাত ও লেকের জলধারা আর পাহাড়ের ঢালে সবুজ চায়ের বাগান মিলিয়ে যে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবতারণা ক্যান্ডিতে ঘটেছে তা আপনার মনকে পুলকিত করবেই।
ছবি – লেখক
লেখক – সংবাদ উপস্থাপক
সারাবাংলা/আরএফ