মেনোপজ, নারীর জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়
১৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:০৭
অক্টোবরের ১৮ তারিখে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ওয়ার্ল্ড মেনোপজ ডে বা রজঃনিবৃত্তি দিবস। নারীর জীবনের এই এক বিশেষ অধ্যায় নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সচেতনতাই দিবসটি পালনের প্রাথমিক উদেশ্য। মেনোপজ; অর্থাৎ নারীর বয়স ৪৫ থেকে ৫০, কি ৫৫ এর পর পুরোপুরি মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। নারীর একটি নির্দিষ্ট বয়সের বাস্তবতা হচ্ছে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি। পৃথিবীর সকল নারীর জীবনে একটি বয়সে এসে এটি ঘটে কিন্তু বাংলাদেশে শব্দটি নিয়ে আলোচনাই যেন ট্যাবু।
একটা বয়সে যখন নারীদের মেনস্ট্রুয়েশন বন্ধ হয়ে যায় তাকে মেনোপজ বলে। এই সময় ওভারিতে ডিম্বাণুর সংখ্যা একদম কমে যায়, ফলে নিয়মিত পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। জন্মের সময় মেয়েদের ওভারিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বাণু থাকে আর পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর প্রতি মাসে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়। বয়স ৫০ পার হলে ওভারিতে ডিম্বাণু শেষ হয়ে যায় ফলে মেনস্ট্রুয়েশন বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণভাবে এটাই হলো মেনোপজ।
চিকিৎসকদের মতে মেনোপজের বয়স প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রে ভিন্ন। একটানা ১২ মাস যখন ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে, তখন সেটিকে চিকিৎসকেরা মেনোপজ বলে থাকেন। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে নারীদের মেনোপজ হয়ে থাকে। বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটির তথ্যমতে এদেশে নারীদের মনোপজের গড় বয়স ৫১ বছর। অনেক সময় এই বয়সের মধ্যে থেমে থেমে কয়েক মাস পরপর ঋতুস্রাব হতে পারে। মেনোপজের প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে ঘটে।
এমনিতেই একটা বয়সের পর শারীরিক নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন নারীরা। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে গেলে নারীদের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। খিটখিটে মেজাজ, ক্লান্তি যেন এই বয়সী নারীদের নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। আর এর মূল কারণ এই বয়সেই সাধারণ জীবনের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে রজঃনিবৃত্তি। রাতে ঠিক মতো ঘুম না হওয়া, কাজে আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত না থাকা আর অবসাদ তো আছেই। এছাড়া ঘুম না হওয়া, উদ্বেগ, মনমরা ভাব এবং যৌন মিলনে আগ্রহ কমে যাওয়া মেনোপজ পরবর্তী কয়েকটি অভিজ্ঞতা। সকল নারীর অভিজ্ঞতা অবশ্য একরকম নয়। শরীরের এমন পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে হিমশিম খান বেশিরভাগ নারী। মনে করেন ‘এইতো বুড়ি হয়ে গেলাম, জীবন এখানেই শেষ’ ।
চিকিৎসকদের মতে, মেনোপজের ফলে নারীর শরীরে যে পরিবর্তনগুলো হয় তার পেছনে মূল কারণ ইস্ট্রোজেন নামের একটি হরমোন। যা নারীর শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইস্ট্রোজেন নারীদের নানাভাবে সুরক্ষা দেয়। যেমন নারীর মেনোপজের আগে পুরুষের চেয়ে হার্টের অসুখ কম হয় এবং সেটা হয় ইস্ট্রোজেনের জন্যেই। কিন্তু যখনই তার মেনোপজ হয় তখন কিন্তু নারী ও পুরুষ হার্ট ডিজিজের সমান সমান ঝুঁকিতে থাকে। ইস্ট্রোজেন হরমোন নারীর প্রজনন গ্রন্থিকে তো প্রোটেকশন দেয়ই, ইস্ট্রোজেন নারীর মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে। তাছাড়া ইস্ট্রোজেন নারীর হাড়ের জন্য ভাল। ইস্ট্রোজেন হরমোন নারীর শরীরে আরও অনেক কাজ করে।
সাধারণত বাংলাদেশে নারীরা মেনোপজের প্রভাব নিয়ে কথা বলেন না, এর জন্য কোন প্রস্তুতি নেন না এবং নীরবে মানিয়ে নেন। অথচ মেনোপজ নারীর শরীরে প্রচুর পরিবর্তন নিয়ে আসে। সঠিক যত্ন না নিলে অনেক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। মেনোপজ পরবর্তী সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলোর একটি অস্টিওপোরোসিস। এটি হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ। নারীর শরীরে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম এবং কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস না থাকলে মেনোপজ পরবর্তী সময়ে অস্টিওপোরোসিস জটিল আকার ধারণ করতে পারে। মেনোপজ পরবর্তী সময়ে নারীরা অস্টিওপোরোসিসের বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। এর কারণ পুরুষের চেয়ে নারীর হাড়ের পুরুত্ব কম। ইস্ট্রোজেন তাকে এ থেকে নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু শরীরে মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের নিরাপত্তা কমে যায়। এর কোন উপসর্গ থাকে না কিন্তু খুব অল্পতেই হাড় ভেঙে যেতে পারে।
চিকিৎসকদের মতে মেনোপজের জন্য আগেভাগে একজন নারীর প্রস্তুতি দরকার। বয়ঃসন্ধিকালে একটা সময় হলে মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হওয়াটাই যেমন স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি একটি বয়সের পর পুরোপুরি মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়াও নারীর শরীরের জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু বাংলাদেশে নারীদের মেনোপজের প্রভাব নিয়ে কথা বলতে যেমন দেখা যায় না, এর জন্য কোন প্রস্তুতিও তারা নেন না এবং কোন সমস্যা হলে নীরবেই তা সহ্য করেন। এছাড়া বাংলাদেশে মেনোপজ বিষয়ে অনেক নারীর জ্ঞান বেশ সীমিত বলে মনে হয়। মেনোপজ মানে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া এর বাইরে তেমন কোন তথ্য তাদের জানা নেই।
তবে এটা সত্যি যে, আধুনিক নারীদের মেনোপজের কারণে প্রতিদিনের কাজ ফেলে বিলাপ করার সময় নেই। তাই এ সময়ের শারীরিক পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের। নিজেকে ব্যস্ত রাখা আর বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানো এই সময় মানসিক শান্তি দিতে পারে। আর তাদের জন্যই এ সময় কি ধরনের পরিবর্তন এবং সমস্যা হতে পারে আর এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো জানা থাকা জরুরি।
প্রতিটি নারীর মেনোপজ সম্পর্ক সচেতন থাকা প্রয়োজন। মেনোপজ হলে যদি নিচের বিষয়গুলো নারীরা খেয়াল করেন তাহলে সুস্বাস্থ্য পাওয়া সম্ভব। যেমন- ব্যালেন্সড ডায়েট বা ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খাওয়া। চর্বিযুক্ত খাবার না খাওয়া। হৃৎপিণ্ড ও হাড়কে সুরক্ষা দিতে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। দুশ্চিন্তা, চাপ ও হৃদরোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করা। হার্টের অসুখ ও হঠাৎ গরম লাগা কমাতে ধূমপান ও অ্যালকোহল পান বন্ধ করা।
মেনোপজের নানা দিক নিয়ে কথা বলে, সঠিক তথ্য জেনে নিলে যে কোন ক্ষতি নেই। আশংকাজনক হলেও সত্য যে সেই বিষয়টি এখনো বাংলাদেশে গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ কিছুটা সচেতন থাকলে, মেনোপজ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে এবং পরিবারের সহায়তা পেলে, এই সময়ের মানসিক অবস্থা থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও যে কোনো নারী সুস্থ রাখতে পারবেন।
– বিবিসি ও ব্রাইটসাইড অবলম্বনে
সারাবাংলা/এসবিডিই
তামান্না সুলতানা মেনোপজ- নারীর জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় লাইফস্টাইল সুস্থ থাকুন