আনন্দ ভ্রমণে মহাস্থানগড়ে একদিন
১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:৫০
শীতকাল আসলে ভ্রমণ পিপাসুদের মাঝে ভ্রমনের এক প্রকার নেশা জমে। ভ্রমণ যেন তাদের মনের প্রশান্তি জোগায়। তাদের চিন্তার জগতকে একটু শানিত করে। এবার আমাদের ভ্রমণের জায়গা ছিলো মহাস্থানগড়। করতোয়া নদীর তীরঘেষা এক কালের বাংলার রাজধানী এই মহাস্থানগড়। যাহ পুণ্ড্রনগর নামেও পরিচিত। বর্তমানে এ পুণ্ড্রনগর সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষিত।
এবার ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে ছিলো দশম শ্রেণীর কয়েকজন উদ্যমী শিক্ষার্থী। জিসান, সামিউল, মোরসালিন, ফাহিম। নব্য দশম শ্রেণীতে উঠে এদের মহাস্থানগড় সম্পর্কে তীব্র আগ্রহ জন্মে। মুলত এদের ভ্রমনের পুর্নতা দানেই আমি, বড় ভাই লাবলু এবং আঙ্কেল তিতুকে নিয়ে আমাদের এ যাত্রা শুরু হয়৷ লাবলু ভাই ছিলেন এদের শিক্ষক।
সকালে কুয়াশাজড়ানো দিনে সকলকে নিয়ে বাসে চড়ে আমাদের মহাস্থানগড়ের দিকে যাত্রা শুরু হয়। যাত্রাপথে সকলের মাঝে যেন এক আনন্দের ঝলকানির শুরু হয়। জিসান, সামিউল, মোরসালিন, ফাহিম এদের সবার পরিবারের বাহিরে এটি প্রথম ভ্রমণ। শিক্ষকের সাথে ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান নিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম শুরু হয়৷ কুয়াশা-মাখানো দিনে প্রায় সকালের মাঝেই আমারা মহাস্থানগড়ে পৌঁছে যাই।
আহমেদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ের আব্দুর রাজ্জাক স্যারের নতুন জায়গা ভ্রমনের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদেরও ভ্রমনের সূচনা হয় কাঁচা বাজার দিয়ে। আমারা জানার চেষ্টা করতেছিলাম এই আশেপাশের মানুষ কি খায় এবং কি রকম বই পড়ে। প্রবেশের পথে আমাদের অতিক্রম করতে হলো বিশাল এক বাজার। বাজারে যেন তিল ঠাই জায়গা নাই। মিস্টি কুমড়া, ফুলকপি, বাধাঁকপি, মূলা, আলু, গাজরের বিশাল রকমের গাদি। জমি থেকে তুলে আনা ঝকঝকে পরিস্কার সব কাঁচাবাজার এখানে বিক্রি হচ্ছিলো। ফুলকপির সৌন্দর্যে মনে হচ্ছিলো এমনই বুঝি খাওয়া শুরু করি৷ এত ঝকঝকে একটুও দাগ নেই। তবে আমাদের চোখে কোন লাইব্রেরি পড়লো না। হয়ত আলাদা কোন জায়গায় আছে।
বাজারের ভিড় ঠেলে রং চা খেয়ে শুরু হয় আমাদের মহাস্থানগড় ভ্রমন। বিশাল উচু প্রাচীর পার হয়ে আমরা মহাস্থানগড়ের দিকে এগোনো শুরু করলাম। লাল রংয়ের প্রাচীন দিয়ে উঠে আমাদের চোখে পড়লো মানকালীর কুন্ড।
পাশে সাইনবোর্ডে মানকালীর কুন্ডের বিবরণ অনুযায়ী মানকালীর ঢিবির পাশে একটি ছোট জলাশয় রয়েছে এই জলাশয় থেকে ঢিবিটি দেখতে উচুঁ মনে হয়। তাই একে কুন্ড বা (কূপ) বলে। দুটি মিলে এই স্থাপনাকে মানকালীর কুন্ডধাপ নামে ডাকা হয়। কিংবদন্তী অনুসারে, এই স্থানে প্রথমে একটি মন্দির নির্মাণ করেন রাজা মানসিংহ ও তার ভাই তানসিংহ। অন্যান্য কিংবদন্তী অনুসারে, এখানে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন ঘোড়াঘাটের জমিদারগণ এছাড়াও এখানে পাওয়া জৈন প্রতিমা দেখে অনেকেই মনে করেন পূর্বে জৈন ধর্মগুরুদের আবাসস্থল ছিলো স্থানটি। মানকালীর কুন্ডের ধ্বংসশেষ দেখে আমাদের মসজিদের মতই মনে হচ্ছিলো। সকলেই কল্পনার একটা মসজিদ কল্পনা করতে ছিলাম আর ভাবতে ছিলাম কিভাবে তারা নামাজ পড়ত৷ এছাড়া এ কুন্ডের সম্মুখ ছিল পশ্চিমদিকে যেটা আমাদের কল্পনা আরো নিশ্চিত করেছিলো।
হেঁটে হেঁটে খোদার পাথর ভিটা দেখতে পাই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর লোকেরা এর ওপর দুধ এবং রং ঢেলেছে বলে কল্পনা করা যায়। গ্রানাইট পাথরের একটি বিশাল পাথরের জায়গাটার নাম ঢিবি দেখে একটু অবাকই হওয়া লাগলো।
মাজারের পাশের বাজার দিয়ে সরাসরি রওনা করলাম গোকুল মেধের দিকে। গোকুল মেধ বেহুলার বাসরঘর নামে পরিচিত। বেহুলার বাসর ঘর বগুড়া সদর থানাধীন গোকুল গ্রামে অবস্থিত যা গোকুল মেধ নামে পরিচিত। মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। প্রত্নস্থলটি লোকগাঁথার নায়ক-নায়িকা বেহুলা-লক্ষ্মিন্দরের বাসর ঘর বলে জনসাধারণের কাছে পরিচিত। কল্পনা করা হয় এটি শিব মন্দির ছিলো। বেহুলার বাসরঘরে ১৭২টি কুঠুরি বিভিন্ন তলে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। নিচ থেকে উপরের দিকে ক্রমহ্রাসমান করে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে সেটা দেখতে সুউচ্চ মন্দির বা স্তূপের ভিত্তি হিসেবে কল্পনা করা হয়।
মেধ মন্দির ভ্রমন শেষ করে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ভাসু বিহারে। ভাসু বিহার স্থানীয়ভাবে নরপতির ধাপ নামে পরিচিত। দুটি মধ্যম আকৃতির সংঘারাম ও একটি মন্দিরের স্থাপত্য কাঠামোসহ প্রচুর পরিমাণ প্রত্নবস্তু উন্মোচিত হয়। অপেক্ষাকৃত ছোট সংঘারামটির আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪৯ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ৪৬ মিটার। এর চার বাহুতে ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ২৬ টি কক্ষ ও কক্ষগুলির সামনে চতুর্পার্শ্বে ঘোরানো বারান্দা এবং পূর্ব বাহুর কেন্দ্রস্থলে প্রবেশপথ রয়েছে। বিহারের অদূরে উত্তরমুখী মন্দিরটির আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৩৮ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৭ মিটার। মন্দিরের (কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি বর্গাকার মন্ডপ। এর চতুর্দিকে রয়েছে ধাপে ধাপে উন্নিত প্রদক্ষিণপথ। উৎখননে প্রাপ্ত প্রায় ৮০০ প্রত্নবস্তুর মধ্যে ব্রোঞ্জের ক্ষুদ্রাকৃতির মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক এবং পোড়ামাটির সীল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সংগৃহীত হয়েছে মূল্যবান পাথরের গুটিকা, লোহার পেরেক, মাটির গুটিকা, নকশাকৃত ইট, মাটির প্রদীপ ও অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যাদি এবং প্রচুর মৃৎপাত্রের টুকরা। এ সমস্ত বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তু থেকে ভাসু বিহারের শেষ যুগের (দশ/একাদশ শতক) শিল্পকর্ম ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায়।
ভাসুবিহার ভ্রমন শেষ করে আমরা আবার আসি বিহার ধাপ। প্রত্নস্থণটি স্থানীয়ভাবে তোতারাম পন্ডিতের ধাপ নামে পরিচিত। খনন কাজ পরিচালনা করে ১টি বৌদ্ধ বিহার এবং ২টি বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষসহ প্রচুর হস্তান্তরযোগ্য প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নস্থলের উত্তর-পশ্চিমাংশে উৎখনন কাজ পরিচালনা করে ৫৭০৬১ মি. পরিমাণের একটি বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্যিক কাঠামো উন্মোচিত হয়। এর মধ্যবর্তী আঙ্গিনার চারপাশে। মোট ৩৭টি ভিক্ষুকক্ষ আছে। ‘বিহারটির দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে আরো একটি বৌদ্ধ বিহারের অংশবিশেষ (পূর্ব দেওয়াল ০.৩৪মি.) উন্মোচিত হয়েছে। প্রত্নস্থলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে খননকাজ পরিচালনা করে ২টি বৌদ্ধ মন্দিরের স্থাপত্যিক কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ উম্মোচিত হয়েছে। মন্দির দু’টি উত্তর বাহুর কেন্দ্রস্থলে চমৎকার সিড়িসহ প্রধান প্রবেশ পথ উন্মোচিত হয়েছে। উৎখননের ফলে এখানে ৩টি নির্মাণ আমলের স্থাপত্য কাঠামোর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
এরপরে দর্শনীয় স্থান ছিলো আমাদের গোবিন্দ ভিটা। রোববার জাদুঘর বন্ধ থাকায় আমাদের ভ্রমন হলো না। প্রতিজন ১০ টাকা টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম গোবিন্দ ভিটায়। গোবিন্দ ভিটা মহাস্থানগড় দুর্গ নগরীর প্রাচীরের অদূরে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। গোবিন্দ ভিটা নামক একটি অসমতল ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে ২০০/১২৫’ পরিমাপের একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে প্রাপ্ত বিভিন্ন হস্তান্তরযোগ্য প্রত্ননিদর্শণ, ইটের মাপ ব্যবহৃত মসল্লা, স্থাপত্যিক বির্নাস ইত্যাদির ভিত্তিতে অনুমিত হয় যে, মন্দিরটি খ্রীষ্টীয় আনুমানিক সাত শতকে নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটিতে একাধিকবার পুনঃনির্মানের নিদর্শণ লক্ষ্য করা যায়। এটি গোবিন্দ বা বিষ্ণু মন্দির নামে পরিচিত হলেও এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যাইনি যার ওপর ভিত্তি করে এটিকে বৈষ্ণব মন্দিরও কল্পনা করা হয়।
দুপুর পেরিয়ে গেলে আমাদের দুপুরের খাবারের কথা মনে পড়ে। গোবিন্দ ভিটা থেকে হাটতে হাটতে খাবার সন্ধান করতে থাকি কিন্তু রবিবার সব কিছু বন্ধ থাকায় আমাদের আসতে হলো বাজারে। ভাতের হোটেলে গরুর মাংসে হলো আমাদের তৃপ্তিদায়ক মধ্যাহ্নভোজ। খাওয়া শেষে আমরা আবার ফিরলাম মহাস্থানগড়ের দিকে। এবার চোখে পড়লো আমাদের জিয়ৎ কুন্ডে।
জিয়ৎ কুন্ড নামে পরিচিত এ কুপটির উপরিভাগের ব্যাস ৩.৮৬মিঃ এবং নিচের দিকে ক্রমহ্রস্বমান। একটি চতুষ্কোন গ্রানাইট পাথর কুন্সের পূর্ব ধারে স্থাগিত। খুব সম্ভব পানি উত্তোলনের সুবিধার্থে এর অংশবিশেষ কুলের পূর্ব ভিতরে প্রসারিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। কূপ নির্মাণের প্রথম পর্যায়েই এটিকে ব্যবহার করা হত। কূপটির তলদেশ পর্যন্ত দুই সারিতে আরও অনেকগুলো প্রস্তরখন্ড আংশিক বাহিরে রেখে দেয়।
কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, শাহ সুলতান বলখী মাহীসওয়াবের সঙ্গে যুদ্ধের সময় পরশুরাম এ কুপের পানির সাহায্যে মৃত সৈনিকদেরকে পূনর্জীবিত করতে পারতেন। শাহ সুলতান কুপটির পানির জীবন দানের ক্ষমতার কথা জানতে পেরে একটি চিলের সাহায্যে এর মধ্য এক টুকরো মাংস নিক্ষেপ করেন। এতে কুপটির অলৌকিক ক্ষমতা নষ্ট হয়। এর ফলে পরশুরাম পরাজিত হন। তবে এ প্রবাদের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
এরপর আমরা যাই পাশেই পশুরাম প্রসাদে। সীমানা প্রাচীর বেষ্টিত ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ের ভিতরে যে সব প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিস্কৃত হয়েছে পরশুরাম প্রাসাদ তার মধ্যে অন্যতম। জনশ্রুতিতে এ প্রত্নস্থলটি মহাস্থানগড়ের তথাকথিত হিন্দু নৃপতি পরশুরামের প্রাসাদ নামে পরিচিত। অন্দর মহলে অবস্থিত ছোট একটি অঙ্গনের দিকে মুখ করে নির্মিত পৃথক পৃথক ৪টি মহল বা অংশের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মহলগুলোতে প্রবেশপথসহ বেশ কিছু কক্ষ, সোপান শ্রেণী, সীমানা প্রাচীর এবং পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি প্রবেশদ্বার আবিস্কৃত হয়েছে। পূর্ব পাশের প্রবেশদ্বারটি মূল প্রবেশদ্বার। এ প্রবেশদ্বারের দুই পাশে ২টি প্রহরী কক্ষের চিহ্ন বিদ্যামান। উপরিভাগে মোঘল ও বৃটিশ আমলে ব্যবহৃত ছোট আকারের ইট, চুন সুরকীর আস্তর, চুন কামের ব্যবহার, গঠন শৈলী ইত্যাদি দেখে সহজেই ধারণা করা যায় যে, এ ইমারত অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে নির্মিত হয়েছিল।
বেলা প্রায় শেষ এবার বাড়ি ফিরতে হবে। আমরা দলবেঁধে আসলাম মাজারের পথ বেয়ে। মাজারের পাশে ঘিরে বসেছে বিভিন্ন দোকান। মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে পেলাম কটকটি। স্বাদে অতুলনীয় এ খাবার কেউ এড়াতে পারলাম না। কাটকটি কিনে রওনা করলাম মহাস্থানগড় বাস স্টান্ডে। সূর্য প্রায় ডোবা ডোবা অবস্থা। ভ্রমন শেষে ক্লান্ত নিয়ে আমরা গাড়িতে চড়ে রওনা করলাম বাড়ির উদ্দেশ্য। আনন্দমুখর এ ভ্রমনে এতদুর পথ পাড়ি দিলেও কারো মুখে কোন ক্লান্তির ছাপ ছিলো না। আনন্দে হাসি দিয়েই শেষ হলো আমাদের ভ্রমন তবে অতৃপ্তি রয়ে গেল অনেকগুলো জায়গা এখনো দেখা বাকি। আর একবার এসে বাকিগুলো দেখতে হবে। যদিও এটা ছিলো আমার চতুর্থ তম ভ্রমন। মহাস্থানগড় দেখা তবুও যেন শেষ হয়েও হচ্ছে না। বাকি জায়গায়গুলো পরবর্তীবার দেখার জন্য রেখে দিলাম।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
আনন্দ ভ্রমণে মহাস্থানগড়ে একদিন আবু সুফিয়ান সরকার শুভ বেড়ানো লাইফস্টাইল