ঈদ উৎসবে সুতিতে সুন্দর
২৮ মে ২০১৮ ১৬:০০
সাবরিনা শারমিন বাঁধন।।
শাড়ি। বাঙালির হৃদয়ে, ঐতিহ্যে, পরিচয়ে মিশে আছে অহংকার হয়ে। উপমহাদেশের প্রাচীনতম পরিধেয় শাড়ি, যার ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা আজও আকাশছোঁয়া। কবে কখন শাড়ির প্রচলন শুরু হয়েছিল তার তা স্পষ্ট নয় কিন্তু আবহমান বাংলার নারীর রূপ আর অবয়বে শাড়িই মিশে আছে।
‘শাটী’ থেকে শাড়ি শব্দটি এসেছে যার অর্থ পরিধেয় বস্ত্র। যুগে যুগে বদলেছে শাড়ির বুনন,পাড়, আঁচল, এমনকি পরার ধরন। অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি ছিল প্রচলিত পোশাক। সেলাইবিহীন অখন্ড পোশাককে পুরুষদের জন্য ধুতি এবং নারীদের জন্য শাড়ি নামে অভিহিত করা হয়। সম্ভবত মোঘল আমলে শাড়ির সাথে ব্লাউজ পরার রীতি শুরু হয়।
উনিশ শতকের চল্লিশ দশক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগ। এ যুগে ফ্যাশনের মূল কথাই ছিল কাপড়ে সারা শরীর ঢাকতে হবে। ব্রিটিশদের সংষ্পর্শে থাকা জমিদার ও স্থানীয় ধনীদের পোশাক পরিচ্ছদেও ছিল ভিক্টোরিয়ান ফ্যাশন। এ সময়েই শাড়ির সাথে ফুলহাতা ব্লাউজ ও পেটিকোট পরার চল শুরু হয়। এই রীতিতে শাড়ি পরাটা বাঙ্গালি নারীর চিরায়ত ধরণ প্যাচে শাড়ি পরার ধারণাকে পুরো পাল্টে দেয়।
ভারত ভাগের পর এদেশে নারীরা আধুনিক শাড়ি পরার চলন বলন শিখেছে মূলত ঠাকুরবাড়ির কল্যাণে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদাননন্দিনী দেবীর অবদানের কথা স্মরণ করতে হয়।
ভারত ভাগের পর পাকিস্তানি আমল শুরু হলেও শাড়ির আবেদন কিন্তু কমেনি মোটেই! এ সময়ে তাঁতের সুতি শাড়ির আধিপত্যটা বেশি ছিল। শাড়ির স্টাইলিশ রূপটি আমরা মূলত দেখতে পাই ষাটের দশকে। কেননা ফ্যাশন কিংবা সাজগোজ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয় এ সময়েই। সুতির শাড়ির পাশাপাশি সিল্কের শাড়িও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তখন। সত্তরের দশককে বলা হয় ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ যুগ। মসলিন, কাতান, জামদানির পাশাপাশি সুতি নিয়ে শুরু হয় এক্সপেরিমেন্ট। এরপরে আসে হ্যান্ডপেইন্ট, ব্লক, স্প্রে, বাটিক। এরও পরে আসে এপ্লিক, কারচুপি, ফ্লোরাল মোটিফ।
যে কোন উৎসব কিংবা প্রতিদিনের কাজেকর্মে এখন অনেক নারীর প্রিয় পোশাক শাড়ি। হ্যাঁ মাঝে একটা সময় গেছে যখন নারীদের শাড়ির প্রতি ঝোঁক কিছুটা কমে গিয়েছিল। শুধু কিছু সীমিত উৎসবে শাড়ি বেছে নেবার চল এসেছিল, তাও কেবল ঝকমকে জবরজঙ শাড়ি। অর্থাৎ চুমকি পুঁথির কাজ করা সিল্ক বা জর্জেট শাড়ি যা মূলত ভারত বা পাকিস্তান থেকে আসত। কিন্তু এখন সে ধারা বদলেছে।
এখন নারীদের কাছে শাড়িতে প্রথম পছন্দ তাঁত, সুতির উপরে নানা মোটিফের ডিজাইন। সাথে ফ্যাশনাবেল ব্লাউজ, উৎসব কিংবা অনুষ্ঠান ভেদে হাল্কা বা ভারি গহনা এবং মেকাপ।
কর্মস্থলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসেও মেয়েরা শাড়িতে হয়ে উঠছে অপরূপা। স্বচ্ছন্দ্যেই তারা শাড়ি পরে ঘুরছে। সুতি শাড়িতেই নিজেদের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলছে এবং নিজেদের ফ্যাশনের স্বকীয়তা তৈরি করছে। আজকাল বিয়েবাড়িতেও মেয়েরা সুতিটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে এমনকি দৈনন্দিন কাজ, বাচ্চার স্কুল কিংবা কর্মক্ষেত্রে পরছে সুতি বা তাঁতের শাড়ি কেবল ব্লাউজের ডিজাইন বদলে।
গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সুতিই সবচেয়ে আরামের। এই ঈদে সুতি বা তাঁতের শাড়ি প্রাধান্য পাচ্ছে তাই। এমনকি গরমের দিনে বিবাহ উৎসবে কনেও বেছে নিচ্ছেন সুতির জামদানি কিংবা তাঁতের ডিজাইন করা শাড়ি।
এ বিষয়ে ফ্যাশন হাউস বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী বিপ্লব সাহা বলেন, শাড়ি বাঙালি নারীদের প্রথম পোশাক। স্যাটেলাইটের যুগে আমরা পাশের দেশের দেখাদেখি একটু আধুনিক হতে চেষ্টা করি। কিংবা ব্যস্ততা, যান্ত্রিক জীবনের চাপে প্যান্ট, টপ পরে শাড়িটাকে একটু আভয়েড করে মেয়েরা। এসব তো হবেই। তারপরও বাঙালি নারীদের সবচেয়ে ভালো লাগে শাড়িতে।
তিনি আরো বলেন, এখন সুতি শাড়ি নিয়ে এত রকম এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে আর শাড়ি বলতে তো কেবল শাড়িই নয়, সাথে আছে ব্লাউজের ডিজাইন, গয়না। আজকাল ব্লাউজের মেটিরিয়াল নিয়েও এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। মেয়েদের মধ্যে অনেকবেশী ম্যাচুরেটি আসছে। একটা সময় ছিল যখন বাবা মা পছন্দ করে দিত পোশাক কিন্তু এখন মেয়েরা নিজেরা নিজেদের কমফোর্ট জোন তৈরি করে এবং সে অনুযায়ী পোশাক পরে এবং শাড়িই বেছে নেয় প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা।
বিপ্লব সাহা জানান, এবারের ঈদে শাড়ির ক্ষেত্রে তিনি সুতিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। সাথে সিল্ক কাতান আছে। তিনি বলেন, আসলে সুতিতে যতটা এক্সপেরিমেন্ট করা যায় অন্য মেটিরিয়ালে সে সুযোগটা কম।
বলা যায় অনলাইনে শাড়ি বেচাবিক্রির কারণেও শাড়ির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে মেয়েদের। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাবিলা বলেন, ‘আমি শাড়ি পরতে দারুণ ভালোবাসি। আগে ক্লাসে শাড়ি পরলে অনেকেই প্রশ্ন করত কেন শাড়ি পরেছি কিন্তু এখন অনেকেই ক্লাসে শাড়ি পরে আসে এবং এই প্রশ্ন কেউ করেনা। মন ভাল হোক বা মন খারাপ, শাড়ি ছাড়া আমার ভাল লাগেনা। যেকোন উৎসবে শাড়িই আমার প্রথম পছন্দ আর এখন প্রতিদিন অনলাইনে বিভিন্নরকম শাড়ি দেখি, পছন্দ হয়, অর্ডার দেই। কোন ঝামেলা ঝক্কি ছাড়াই ঘরে বসে মনের মত শাড়ি পেয়ে যাই একইভাবে গয়না, ব্লাউজও পাই অনলাইনে। আর সেগুলোতে নিজেকে সাজাই। এই ঈদেও শাড়ি পরব বলে ঠিক করেছি।’
এ নিয়ে অনলাইন শাড়ি শপ পটের বিবি’র স্বত্বাধিকারী ফোয়ারা ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা অনেকেই মনে করি জিন্স, ফতুয়া কেবল আরামদায়ক পোশাক। সেই ট্রেন্ড ভাঙ্গার জন্যই আমি শাড়ির কমফোর্ট জোন তৈরি করতে চেয়েছি এবং আরামদায়ক শাড়ি বানাতে চেয়েছি যেগুলো মেয়েরা যে কোন আড্ডা, কনসার্ট, বিয়েবাড়িতে সমানতালে পরতে পারে।
তবে ফোয়ারা মনে করেন না যে সুতি শাড়ির বিজনেস এখন খুব রমরমা হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, কমন বন্ধুদের একটা বিরাট সার্কেল তৈরি হয়েছে, ঘুরেফিরে তারাই সুতি শাড়ি পরেন।
এবার ঈদকে কেন্দ্র করে পটের বিবিও বেশ কিছু নতুন ডিজাইনের সুতি শাড়ি আনছে, যা সবার পছন্দ হবে বলে বিশ্বাস করেন ফোয়ারা।
অনলাইন শপ তাঁতি আর তাঁত’র স্বত্বাধিকারী ইসরাত জাহান তাতিয়া বলেন, ‘আমার বাড়ি টাঙ্গাইল হবার কারনে তাঁতের শাড়ির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তাঁতের কারিগর, মহাজনদের সম্পর্কে ধারণা হয়। এসবই আমার তাঁত নিয়ে কাজ শুরুর কথা।’
তাতিয়া আরো বলেন, অনলাইনে সোস্যাল মিডিয়ার বিরাট ভুমিকা আছে তাঁতের শাড়ির জনপ্রিয়তার পিছনে। এখন অল্পবয়সী মেয়েরা সানন্দে তাঁত পরে। প্রথাগত ফ্যাশনের বাইরে এখন মেয়েরা সাজসজ্জা করে। একসময়ের প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া তাঁত শিল্প অনলাইন, ই-কমার্সের কারনে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে এবং প্রতিযোগিতাও বেড়েছে প্রস্তুতকারকদের মাঝে। শুধু নিজেদের জন্যই নয় মানুষ উপহারের জন্যও বেছে নিচ্ছে তাঁতের শাড়ি।
শাড়ি ফিরে আসছে। শাড়ি হয়ে উঠছে বাঙালি নারীর সজ্জার প্রথম ও প্রধান পছন্দ। শাড়ির আবেদন নতুন করে ধরা দিচ্ছে আমাদের চোখে। এটি একটি সুসংবাদ। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল, বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁত আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তাঁতের শাড়ি এদেশের নারীকে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেই অতুলনীয় রূপের ভাণ্ডার আর অনিন্দ্য সৌন্দর্য। উৎসবে আয়োজনে তাই সুতি আর একপাশে ফেলে রাখার নয়। সুতি তাঁতের শাড়ি হয়ে উঠছে ঈদসহ সব উৎসবের প্রথম পছন্দ।
মডেল- বীথি সপ্তর্ষী ও আত্রলিতা
শাড়ি- নন্দিনী টাঙ্গােইল শাড়ি
সারাবাংলা/এসএস