Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সৌন্দর্যের স্বর্গ লামায়

ফাতেমা সুলতানা
৪ মে ২০২৪ ১৬:৩২

ছোটবেলা থেকে খুব বেশি দূরে কখনো ভ্রমণ করা হয়নি। অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় শেখ রাসেল স্মৃতি পার্ক, রাঙ্গুনিয়া যাওয়া হয়েছিলো। ভ্রমণ বলতে শুধু এই স্মৃতিটুকু নিয়েই বড় হচ্ছিলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বান্দরবানের ভিডিও বা বিভিন্ন ভ্লগ প্রায়ই দেখতাম আর আফসোস করতাম। ইশ্, যদি যেতে পারতাম! তাই যখন বান্দরবান যাওয়ার সুযোগ আসলো কালক্ষেপণ না করেই রাজি হয়ে যাই। সাথে কিছু সদস্য যোগাড় করে নিই (আমার মেজভাবি, ভাই, ভাগ্নে ও আমি)।

বিজ্ঞাপন

মূলত আমরা ভাবির বোনের চাকরির স্থল লামায় যাবো বলে ঠিক করেছিলাম। ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পরিকল্পনা করি যাওয়ার। যেই ভাবা সেই কাজ। সন্ধ্যায় টিউশন সেরে, রাতে একটি অনলাইন ক্লাস করে ১২ টার দিকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেই। পরদিন ১২ জানুয়ারি সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে, সকালের নাস্তা করে, ৭টায় বাস স্টেশনের দিকে রওনা দিই, বাস স্টেশনে সাড়ে ৭ টায় পৌঁছাই। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় বাসের টিকিট মোটামুটি শেষ হয়ে যায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সকাল ৮টা ১০ মিনিটের সৌদিয়া বাসের শেষ চারটি টিকিট পেয়ে যাই, বাসটি যথাসময়ে ছেড়ে দেয়। কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে যাওয়ার রাস্তা উপভোগ করতে থাকি। সাড়ে ৯টার দিকে বাসটি লোহাগড়া একটি হোটেলের সামনে ১৫ মিনিটের বিরতি দেয়। ১৫ মিনিট পর আবার বাসটি রওনা দেয় এবং ১১টায় চকরিয়ায় নেমে যায়। চকরিয়া থেকে মাতামুহুরি বাসের টিকিট কেটে (জনপ্রতি ৭০ টাকা) আমরা লামার উদ্দেশ্য রওনা দেই। মূলত মাতামুহুরি ব্রীজের প্রবেশপথ থেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে উপভোগ করা শুরু করি। উঁচু নিচু সব পাহাড়; প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যে উপভোগ করতে করতে আজিজনগর, পাইতং, হাসির দিঘী, ইয়াংছা, লাইনজিরি স্থানসমূহ অতিক্রম করে দুপুর ১২টায় লামা পৌঁছালাম।

বিজ্ঞাপন

সেদিন জুমার দিন ছিলো বিধায় মেজভাই এবং ভাগ্নে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে গেলো। ভাবি আর তার বোন মিলে দুপুরের খাবারের আয়োজন করেছিল, সাথে আমি ছিলাম তাদের বিনোদন দানকারী হিসেবে। দুপুরের খাবার শেষে আমাদেরকে (আমি এবং ভাগ্নেকে) বলা হলো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে, কিন্তু আমরা মানতে নারাজ। আমাদের যুক্তি হচ্ছে, আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি, ঘুমাতে আসিনি। আমি আর আমার ভাগ্নে মিলে চলে গেলাম লামা থানা এবং আশেপাশের জায়গাসমূহ দেখতে। লামা থানার পিছনে চেয়ারম্যান পাড়া ও টিএনটি পাড়া গিয়ে দেখি সেখানে বেশ কয়েক রকমের ফসলি জমি। সেখানে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ভুট্টা, মরিচ এবং টমেটোর চাষ করা হয়েছে। একটু সামনের দিকে এগিয়ে টিএনটি পাড়ার কিছু মহিলা বাসিন্দার সাথে কুশল বিনিময় করলাম। তাদের সাথে আলাপের এক পর্যায়ে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে সংগঠিত ৫ দিনব্যাপি বন্যায় তাদের মানবেতর জীবন সম্পর্কে জানতে পারি। ওই এলাকার বাড়িগুলো পাহাড়ের ঢিবির উপরে ছিল। বন্যার প্রথম দিকে তারা মনে করেছিলো পানি একটু পর নেমে যাবে তাই তারা আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি। পরবর্তীতে যখন পানির পরিমাণ বেড়ে যায় তখন তারা আর আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেনি। তাদের পাশেই ছিল একটি খাল যা মাতামুহুরি নদীর সাথে সংযুক্ত। খালটি দিয়ে মাঝে মাঝে নৌকা চলাচল করলেও তারা কোনো সাহায্য পায়নি। যদিও এটি পাহাড়ি এলাকা ছিল, তারা তিনদিন শুকনো খাবার খেয়ে বাচ্চাদের নিয়ে একটি খাটের উপর উঁচু তক্তায় দিন যাপন করেছিলো।

এরপর মহিলাদের জীবন ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন গল্পও শুনলাম। টিএনটি পাড়ায় ঘন্টা খানেক ব্যয় করে আবার ফিরে আসলাম। এবার ভ্রমনসঙ্গীদের সাথে বিকাল ৪টায় রওনা দিলাম বীর বাহাদুর কাননে। স্থানীয়রা এটিকে এটিকে পৌরসভা নামে চিনেন। এখানের ৩০০ আসনের এমপি বীর বাহাদুরের নামানুসারে বীর বাহাদুর কানন নাম রাখা হয়েছে। বিকালে নিজের পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর উপযুক্ত একটি স্থান। সেখানে বেশ অনেকক্ষণ সময় কাটানো হয়েছিলো। সৌভাগ্যবশত সেখানে কিছু পরিচিত এবং এলাকার মানুষের সাথে দেখা হয়ে যার ফলে আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠে। অবশেষে সাড়ে সাতটায় আমরা স্থানটি ত্যাগ করে ফিরে আসি।

বলে রাখি, লামায় অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ছিল। মোটা মোটা সোয়েটার পরেও ঠাণ্ডাকে দমাতে পারছিলাম না। চট্টগ্রামে বিশেষ তেমন ঠাণ্ডা অনুভব হয় না। তাই লামার ঠাণ্ডা আমাদের জন্য একটু কষ্টকর ছিলো বটে।

১৩ জানুযারি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ৭টার মধ্যে নাস্তা সেরে আমি, আমার মেজ ভাই ও আমার ভাগ্নে মিলে স্থানীয়দের সাপ্তাহিক বাজার দেখার জন্য বের হই। কুয়াশার জন্য রাস্তায় কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। লামা থানা থেকে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্বে বাজার বসে থাকে। প্রতি শনিবার বড় আকারের বাজার বসে। যেহেতু লামায় আদিবাসীদের বসবাস বেশি তাই তাদের পণ্যই ছিলো বেশি। আমরা পেঁপে, কলা কিনে নিলাম। অন্যান্য দ্রব্যের দাম শহরের দামের মতো হওয়ায় কেনা হয়নি। একটি গলিতে আদিবাসীদের বাড়ি দেখা যাচ্ছিলো। আদিবাসীদের বাড়ি দেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিলো, দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বলে ভাইয়া যেতে দেয়নি। আদিবাসিদের বিশেষ খাদ্য ভ্রব্য নাপ্পি, মুন্ডি আলাদা একটি গলিতে বিক্রি করছিলো। আদিবাসীদের জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভাস নিয়ে আমার কৌতূহল একটু বেশি, তাই গলিটির দিকে আমার দৃষ্টি ছিল। ভাইয়ারা হাটা ধরলেই তাদের অগোচরে আমি গলিটিতে ঢুকতে যাওয়ার সময় একজন আদিবাসী (মারমা) আমাকে পরামর্শ দেন যে, আমি সেখানে না গেলেই ভালো হবে কারণ নাপ্পির গন্ধ আমি সহ্য করতে পারবো না। তাই সেদিকে আর যাওয়া হলো না। আদিবাসীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানার কৌতূহল মনের কোণে রেখে ভাইয়াদের সাথে হাঁটা ধরলাম।

আমরা সকাল ১০টায় তৈরি হয়ে আলিকদমের উদ্দেশ্য রওনা দিই। আগের দিন রাতেই একটি স্থানীয় সিএনজি ঠিক করা হয়। লামা ফেলে আলিকদমের রাস্তায় প্রবেশ করার পর আমি অভিভূত হয়ে যাই। এমন সৌন্দর্য্য আমি কেবল স্বপ্নেই দেখতাম। ছোটবেলায় সামান্য মাটির স্তূপ দেখলেই পাহাড় পাহাড় বলে চিৎকার দিতাম। সেখানে এ যেন পাহাড়ের বিচিত্র মেলা! আল্লাহ তায়ালায় সৃষ্টির সৌন্দর্য্য অবলোকন করার অন্যতম স্থান হচ্ছে বান্দরবান। আলিকদমের রাস্তাসমূহ ছিল বেশ উঁচু-নিচু। ওখানে ক্যান্টমেন্টের পরে ছিলো বাংলাদেশ আর্মির চেকপোস্ট। ওখানে স্থানীয় ছাড়া অন্যদের সহজে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না, আমাদের যাওয়ার জন্য প্রথম দিকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। ৩০ মিনিট মিনতির পর অনুমতি দেওয়া হয়। তারপর আমরা উচুঁতে উঠতে থাকি। আমি কেন জানি বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। আমি ভয়ে শুধু সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছিলাম। তবে ভয়ের মাঝেও আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলাম। গাড়ি বেশি গতিতে চলার কারণে পাহাড়ি রাস্তায় একটি অদ্ভুদ রকমের শব্দ হচ্ছিলো।

অবশেষে আমরা কুরুক পাতা ভিউ পয়েন্ট গিয়ে পৌঁছাই। কুরুক পাতা ভিউ পয়েন্ট সমতল থেকে প্রায় ৪৫ মিটার (প্রায় ১৪৭ ফুট) উঁচু।

কুরুক পাতা ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে পাহাড়গুলো সব আমার থেকে খাটো। এখান থেকে পাহাড়ি আকা-বাঁকা রাস্তা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। আমরা পৌঁছেছিলাম দুপুর ১২টার দিকে। সেই সময় রোদের তীব্রতা বেশি ছিল। যদিও শীতকাল, তাই গরম তেমন অনুভব করিনি। তবে আমার মতে বিকালের দিকে গেলে সূর্যাস্তটা প্রাণভরে উপভোগ করা যেত।কুরুক পাতা ভিউ পয়েন্টের পর পোয়ামুহুরি রাস্তা। সেখানে সিএনজি নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণভাবে নিষেধ হওয়ায় যেতে পারিনি। তবে শুনেছিলাম বাইকে পোয়ামুহুরি বাস্তাটিতে যাওয়া যায় । ইচ্ছে হচ্ছিলো পোয়ামুহুরি যাওয়ার। তবে মনের ইচ্ছেটাকে দমাতেই হলো!

সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এখানে নাস্তা করার মতো দোকান পাওয়া যায়নি। আমরা বাসা থেকে কিছু নাস্তা নিয়ে গিয়েছিলাম তবে ভুলবশত পানি নেওয়া হয়নি। তাই পানি ছাড়াই নাস্তা করে নিতে হলো। কুরুক পাতা ভিউ পয়েন্ট থেকে ফেরার সময় রাস্তায় আমরা জুমঘর দেখতে পাই। গাড়ি থামিয়ে পাহাড়িদের থেকে ঝাড়ু কিনে নেই। একই সময় দেখতে পাই কয়েকজন মানুষ ক্ষেত থেকে বাদাম সংগ্রহ করছে। বাদামগুলো দেখতে লোভনীয় লাগছিল। বাদামের আসল মালিক না থাকায় আমরা বাদাম কিনতে পারিনি। দুপুর আড়াইটায় লোকালয়ে পৌঁছে আলিকদম বাজারের পাশে একটি হোটেলে মধ্যহ্নভোজের পর আমরা যাত্রা দিলাম আলীর গুহার উদ্দেশ্য। এটি প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট, ঝিরি থেকে দেড়শত ফুট উপরে একটি গুহা। প্রকৃতির অপরূহ এই গুহাকে ঘিরে রহস্যের শেষ নেই। গুহার প্রবেশ পথ দেখতে আশ্চর্য সুন্দর! ঘড়িতে বাজছিলো ৩টা, তবু গুহার ভেতর দিয়ে যেন সন্ধ্যা বয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিলো! আমরা সামনের দিকে যাচ্ছিলাম। ওখানে বাঁশ ছাড়া গেলে পিচ্ছিল থাকার কারনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গুহার কাছাকাছি একজন স্থানীয় লোককে দেখলাম বোতলে করে ভেতর থেকে পানি এনেছিলেন । তাদের বিশ্বাস এই পানি খেলে নাকি রোগমুক্তি পাওয়া যাবে। কাছাকাছি আসার পর দেখলাম ঢাকা থেকে একটি গ্রুপ এসেছিলো গুহার ভেতর যাবার জন্য, তারা ফিরে যাচ্ছে। তাদের ফিরে আসতে দেখে ভাইয়া আমাদের গুহার ভিতর যেতে দেয়নি। তবে আমি জেদ করেছিলাম যাওয়ার জন্য। কিন্তু কী আর করা!

আমাদের কাপড়ে কাদা মাখামাখি অবস্থা হয়েছিলো। গুহার রাস্তা থেকে বের হয়ে পাশে একটি নদীর পানিতে হাত, পা এবং কাপড়ের ময়লা অংশ ধুয়ে আবার লামার উদ্দেশ্য রওনা দেই। সিএনজি চালক ডিম পাহাড় যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলো। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে বিধায় আমরা ডিমপাহাড় না গিয়ে লামায় ফিরে যাই। আলিকদম ও লামায় সম্পূর্ণ রাস্তায় শুধু তামাকের চাষ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। অনেকে এটিকে তামাকের রাজধানী বলে থাকেন। এখান থেকে তামাক সারা দেশে যোগান দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় হোটেলে পৌঁছে একটি অপরিচিত খাবার খেলাম। বাকরখানির সাথে দুধের সর মিশিয়ে প্লেট প্রতি ২০ টাকা করে বিক্রি করছিলো । এটি লামার ইসলামি ব্যাংকের পাশে একটি দোকানে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় বিক্রি করা হয়।

বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেয়ে গল্প শেষে ব্যাগপত্র গুছিয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

১৪ ই জানুয়ারি (রোববার)

সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে সকলে চটজলদি তৈরি হয়ে আমাদের বস্তাপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলাম বাসার উদ্দেশ্যে। ইতি টানলাম লামা উপাখ্যানের। এই ভ্রমণটা আমার জীবনের একটি বিশেষ সুখস্মৃতি হিসেবে আজীবন সংরক্ষিত থাকবে। ভ্রমণ মানুষকে সজীব করে, প্রাণবন্ত করে। বান্দরবান, হয়তো আবারো দেখা হবে। রচিত হবে নতুন আরেকটি গল্প।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এজেডএস

ফাতেমা সুলতানা সৌন্দর্যের স্বর্গ লামায়