সিটিং ডিজিজ কী? ক্ষতিকর প্রভাব এড়াবেন যেভাবে
৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:২২
সামিহা অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় টিউশনি করতে শুরু করে। বাসে করে বিশ্ববিদ্যালয় যেতে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা, সেখানে গিয়ে চারঘণ্টা ক্লাসে বসে থাকা এরপর আবার দেড় থেকে দুই ঘন্টা বাসে বসে টিউশনিতে যাওয়া। টিউশনিতে আবার ঘন্টাদুই বসে থাকা। এরপর বাসায় ফেরার পথে আবার আধাঘন্টা বা চল্লিশ মিনিট রিকশা বা অটোতে বসে থাকা। রাতে টেবিলে বসে পড়া বা টিভি দেখা সব মিলিয়ে দিনের মাঝে দীর্ঘসময় সে বসেই কাটায়।
এভাবে বেশ কয়েকমাস চলার পরে তার পেটের চারপাশে চর্বি জমে যায়। তাছাড়া মাঝেমধ্যেই রাতে প্রচন্ড ব্যাকপেইন হতে শুরু করে। একজন পরিচিত চিকিৎসক তাকে বলেন, কোমরের চারপাশে চর্বি জমা কিংবা ব্যাকপেইনের জন্য দায়ী দিনের বেশিরভাগ সময় বসে কাটানোর অভ্যাস।
সারাদিন বসে থাকা ক্ষতিকর তা আমরা অনেকেই জানি, কিন্তু এই বসে থাকা যে এক ধরণের রোগ তা হয়তো জানি না। বিশেষজ্ঞরা একে ‘সিটিং ডিজিজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তারা বলছেন, এই রোগ নির্ণয়যোগ্য কোন ব্যাধি না কিন্তু একনাগাড়ে দীর্ঘসময় বসে থাকার ফলে ব্যাকপেইন ছাড়াও ক্যানসার, হার্ট ডিজিজ, ডায়াবেটিসের মত রোগ ডেকে আনছে। একনাগাড়ে বসে থাকার ফলে মানুষের আয়ু কমে যাচ্ছে বলেও জানাচ্ছেন গবেষকরা। টরেন্টো ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্ক বসা ও মৃত্যুর সাথে সম্পর্ক সংক্রান্ত ৪৭ টি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখেছে। দীর্ঘসময় ধরে বিরতিহীন বসে থাকার ফলে আয়ু কমে যায় বলে জানাচ্ছে তারা।
সিটিং ডিজিজ কী?
অস্ট্রেলিয়ান এক সমীক্ষা বলছে, যখন আমরা দীর্ঘক্ষণ বসে কাটাই তখন আমাদের দেহের পেশিগুলো নড়াচড়া করার সুযোগ পায়না। এতে স্বাভাবিকভাবে রক্ত চলাচল বাধা পায়। এ ব্যাপারে কথা হয় হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক লেনিন চৌধুরীর সাথে। তিনি বলেন, আমাদের আধুনিক সেডেনটারি বা অলস জীবনযাপনের ফলে নানারকম অসংক্রামক রোগ দেখা দিচ্ছে। এসব রোগ জীবাণুঘটিত নয়, শুধুমাত্র অলস বসে থাকার ফলে দেখা দিচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি জানান, দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে শরীরের রক্ত চলাচল কম হওয়া ও স্বাভাবিক বিপাকক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হওয়া এর মূল কারণ।
বসে থাকার ফলে কী ঘটছে?
কর্মক্লান্ত দিনের শেষে বাড়িতে ফিরে শুয়ে কিংবা বসে বিশ্রাম করতে কে না চায়। আপনিও হয়ত সারাদিন অফিস করে বাড়ি ফিরেই টিভি ছেড়ে সোফায় গা এলিয়ে দিচ্ছেন। ভাবছেন, সারাদিন কাজ করেছি, এখন বসে বসে বিশ্রাম নেই। বসে বসে এই বিশ্রামটুকু না নিলে পরদিন কাজ করা সম্ভব না বলে ভাবি আমরা অনেকেই। তাই বাসায় ফিরেই হয়ত এক কাপ চা বা কফি হাতে সোফায় গা এলিয়ে টিভির সামনে বা মোবাইল নিয়ে বসে পড়ি। অফিসে, যানবাহনে তারপর বাড়িতে ফিরেও বসে থাকার এই অভ্যাস ডেকে আনছে প্রাণঘাতী রোগ।
বসে থাকতে আমাদের অনেক আরাম লাগে ঠিকই কিন্তু অতিরিক্ত আরাম অতিরিক্ত মিষ্টির মতই ক্ষতিকর। ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, সুস্থ থাকার জন্য সবরকম শারীরিক অবস্থানের প্রয়োজন। তাই একটানা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। উভয় ক্ষেত্রেই কোমরে ব্যথা হওয়ার পাশাপাশি মাংসপেশিতে বৈকল্য তৈরি হয় বলে জানান তিনি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ সারাদিনে ছয় ঘন্টার মত বসে কাটায়। ২০১২ সালে লৌবরো বিশ্ববিদ্যালয় ও লেইচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সেডেনটারি লাইফস্টাইল বা অলস জীবনযাপনের প্রভাব সংক্রান্ত একটি নীরিক্ষা চালায় নানা দেশের প্রায় আটলক্ষ মানুষের উপর। এই পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের চিত্র। যারা বেশি সময় চেয়ারে বসে কাটায় তারা, তুলনামূলক কম সময় বসে কাটায় এমন লোকের চাইতে ১১২ শতাংশ বেশি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে। ১৪৭ শতাংশ বেশি আছেন হৃদরোগের ঝুঁকিতে। আর ৪৯ শতাংশ বেশি আছেন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে।
এগুলো ছাড়াও উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, লোয়ার ব্যাক পেইন, কোলন ক্যানসার ও রক্তচলাচলে ধীরগতির মত সমস্যা দেখা দিচ্ছে দীর্ঘসময় বিরতিহীন বসে থাকার অভ্যাসের উপসর্গ হিসেবে।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত ‘উইসকনসিন ডিসকভারি’ জানাচ্ছে এমনকি যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে তারাও যদি দীর্ঘক্ষন বিরতিহীন বসে কাটায়, তারাও একই রকম স্বাস্থঝুঁকিতে আছে। অলস জীবনাযপনের নেতিনাচক প্রতিক্রিয়ার উপর পরিচালিত নানা গবেষণা গবেষকদের মাঝে নতুন শব্দ চালু হয়েছে ‘একটিভ কাউচ পটেটো’ অর্থাৎ যারা দীর্ঘসময় অফিসে বা বাড়িতে চেয়ারে বসে কাটায়। ভেবে দেখুন, আপনি নিজেও একজন ‘কাউচ পটেটো’ কিনা।
কারণ, আলবার্টা হেলথ সার্ভিসের গবেষক ক্রিস্টিন ফ্রেডেনরিক বলেন, কাউচ পটেটো হওয়ার বা বসে থাকার বদভ্যাস বাড়াচ্ছে ক্যানসারের ঝুঁকি। বিশেষত ব্রেস্ট ক্যানসার ও কোলন ক্যানসার। নির্দিষ্ট বিরতিতে শারীরিক গতিবিধি ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই কমায় বলেও জানান তিনি। আর ক্যানসারের ঝুঁকি নারীদের ক্ষেত্রে ৯৪ শতাংশ আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ নারীদের নিজেদের জীবনযাপন নিয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
বাঁচার উপায় কী?
আধুনিক জীবনযাপনে আমরা না চাইলেও দীর্ঘসময় বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। তাহলে কি প্রাণঘাতী এসব রোগের ঝুঁকি থেকে বাঁচার কোন উপায় নাই? ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, যারা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কাজ করেন, তারা যেন প্রতি ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পরপর উঠে দাঁড়ান বা হাঁটাহাঁটি করেন। অফিসে থাকাকালীন ফাইল আনা নেওয়া, চা বা পানি আনা নেওয়া ইত্যাদি কাজ নিজে করলে কিছুক্ষণ পরপর ওঠা হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি। তাছাড়া অফিসের আগে ও পরে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা ৩৫ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করার কথাও বলেন তিনি। তবে অফিসের আগে বা পরে হাঁটা কোনই কাজে লাগবেনা যদি কেউ একটানা তিরিশ বা চল্লিশ মিনিটের বেশি বসে কাটায় বলে জানান তিনি।
এছাড়াও তিনি বলেন, দীর্ঘসময় বসে থাকার কারণে আমাদের স্বাভাবিক বিপাকক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। তাই নিজেদের শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত ক্যালরি গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন তিনি।
আন্তর্জাতিক গবেষকরা বলছেন, শুধুই অফিসে না টিভির সামনে বসে থাকার কারণেও আমরা মারাত্মক স্বাস্থঝুকিতে আছি। ২০১০ এ অস্ট্রেলিয়ায় ডায়াবেটিস, ওবেসিটি ও জীবনযাপনের উপর পরিচালিত এক জরিপে আতঙ্কিত হওয়ার মত তথ্য উঠে এসেছে। এ জরিপে দেখে গিয়েছে যেসব এডাল্ট বা প্রাপ্তবয়স্করা দীর্ঘসময় টিভির সামনে বসে কাটায় তাদের মৃত্যুর হার অন্যদের চাইতে বেশি। এই সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছে প্রত্যেক ঘন্টা টিভির সামনে কাটানোর ফলে শীঘ্রমৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। এসব ছাড়াও যেকোন কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে এগারো শতাংশ, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে আঠারো শতাংশ আর নয় শতাংশ ক্যানসারে মৃত্যুর হার বাড়ে প্রতি এক ঘন্টা একটানা টিভির সামনে বসে কাটানোর ফলে। তাই শুধু অফিসেই নয়, গবেষকরা বলছেন বাড়িতে ফিরেও আমাদের একটানা বসে থাকার সময় কমাতে হবে।
সারাবাংলা/এসবিডিই
লাইফস্টাইল সিটিং ডিজিজ কী? ক্ষতিকর প্রভাব এড়াবেন যেভাবে স্বাস্থ্য