আয়ুর্বেদিক ওষুধের গুণাগুন ও দাম কেমন
৯ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৫৯
ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি ‘আয়ুর্বেদ’ নামে পরিচিত। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভেষজ উদ্ভিদ, গাছের পাতা, ফল, নানা ধরনের বীজের তেল আর ছাল বাকল হয়ে ওঠে এই চিকিৎসাধারার মূল উপকরণ। হরিতকি, বহেরা, তুলসী, আমলকি, নিম, পানপাতা, কালোজিরা, বাসক, অর্জুনের ছাল, মধু ইত্যাদি প্রকৃতিক উপাদানগুলোই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মূল উপকরণ।
আয়ুর্বেদের গুণাগুণ
আয়ুর্বেদ পঞ্চকর্মার মধ্য দিয়ে শরীরের ভেতরে থাকা জটিল রোগের কারণ অনুসন্ধান করা যায়। বোমেটিং থেরাপি (ওয়ানামা), লুজ মোশন (ভিরেচানম), এনিমা (ভাস্তি), নেজল থেরাপি (নাস্বিয়াম), ব্লাড লেটিং থেরাপি (রক্তমুখ সানামা) এগুলোই হল আয়ুর্বেদের পঞ্চকর্মা। যেকোন দূষিত পদার্থ শরীর থেকে বের করার জন্য পঞ্চকর্মা ব্যবহৃত হয়। অর্থ্যাৎ শরীরকে শুদ্ধি করার এক ধরনের প্রক্রিয়া এটি। রোগের সঠিক কারণ নির্ধারণের পর চিকিৎসা শুরু হয়। কোন রাসায়নিক পদার্থের ছোঁয়া নেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায়। যে কারণে ফলাফল পেতে একটু বেশি সময় লাগে। তবে এর সুফল দীর্ঘস্থায়ী। শুধুমাত্র ওষুধ খেলেই ভাল ফল পাওয়া যায় না। ওষুধের পাশাপাশি কিছু নিয়মও মেনে চলতে হয়। সকালে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম, খাদ্য গ্রহণ ও নিয়ম-কানুন পালন করতে হয়।
সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডা. মো. নাজমুল হুদা বলেন, ‘আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মূলত দুটি উদ্দেশ্য আছে। দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও রোগীকে আয়ুর্বেদিক ওষুধে সারিয়ে তোলা। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় প্রথম উদ্দেশ্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে এই চিকিৎসায় এখনও সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। এতে গবেষণার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে না।’
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কেরালা, কর্ণাটক, ব্যাঙ্গালুরসহ নানা প্রদেশে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে ওই দেশের আয়ুর্বেদিক রিসার্চ সেন্টারগুলোতে গবেষণা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশের পরিস্থিতি অনেকটা বিপরীত। জটিল রোগগুলোর আয়ুর্বেদিক ওষুধ এখনও এদেশে আবিষ্কৃত হয়নি। এই বিষয়ে গবেষণার জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ নেই। একটি মাত্র সরকারি আয়ুর্বেদিক হাসপাতালের বেহাল দশা। পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স, ঔষধ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, অপারেশন থিয়েটার নেই বললেই চলে। ওয়ার্ডগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। সেখানে মূলত গরীব বা নিম্নবিত্ত মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে ব্যর্থ মানুষগুলোর বাঁচার এটাই যেন শেষ সম্বল!
ওষুধের দাম
আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুত হয় উদ্ভিজ্জ, প্রাণীজ ও খনিজ- এই তিনটি উৎস থেকে। উদ্ভিদ ও প্রাণীজ উৎস থেকে প্রস্তুতকৃত আয়ুর্বেদিক ওষুধের দাম কম। বেশিরভাগ ওষুধ সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই আছে। সাধারণত ৪৫০ এমএল আয়ুর্বেদিক ওষুধ ১০০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। অথচ একই পরিমাণ অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কিনতে দুই বা তিনগুণ টাকা বেশি গুনতে হয়- জানালেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডা. নাজমুল হুদা। তবে খনিজ উৎস যেমন তামা, রুপা, সোনা ইত্যাদি ধাতু থেকে তৈরি ওষুধগুলোর দাম একটু বেশি।
আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির জন্য আমাদের দেশের সরকারের নিজস্ব কোন প্রতিষ্ঠান বা কাঠামো নেই। চট্টগ্রামের শ্রীকুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়, আয়ুর্বেদিক ফার্মেসি, মোজাহের ঔষধালয়, বেক্সিমকো, একনি, স্কয়ার, হামদর্দসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আয়ুর্বেদিক ওষুধ বানায়। তবে সরকারিভাবে ওষুধ তৈরি করলে দাম আরও অনেক কম হত।
বেসরকারিভাবে পরিচালিত কিছু প্রতিষ্ঠান
কোন কোন শারীরিক সমস্যা ছোট হলেও যেন পিছু ছাড়ে না। সেইসব ক্ষেত্রে অন্য সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মানুষ যায় প্রকৃতির কাছে। বেসরকারি আয়ুর্বেদিক সেন্টারগুলোর ব্যয় একটু বেশি, ফলে নিম্নবিত্ত মানুষের নাগালের বাইরেই থাকে। যেমন বনানীতে অবস্থিত আয়ুর্বেদিক রিসার্চ এন্ড হেলথ সেন্টারের কথা অনেকের জানা আছে। ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, ওজন কমানো, ব্যথা উপশম- সাধারণত এ জাতীয় সমস্যার চিকিৎসা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে আয়ুর্বেদিক ওষুধগুলো ভারত থেকে আনা হয়। ফলে দাম কিছুটা বেশি।
বনানীর আয়ুর্বেদিক রিসার্চ সেন্টারের চিকিৎসক শালীন ভাট্টি বলেন, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে সাধারণ ক্রনিক অসুখগুলোর চিকিৎসা এখানে করানো হয়। তবে খরচ একটু বেশি। তাই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা এখানে চিকিৎসা করতে পারেন।
এই আয়ুর্বেদিক সেন্টারের ঔষধের দাম ২০০০ টাকা থেকে শুরু হয়। একেকটা রোগের ক্ষেত্রে একেক রকম খরচ হয়ে থাকে। এখানে প্রতিবার ফেসিয়াল করাতে ত্বকের ধরন ও সমস্যাভেদে ২,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা লাগে। যেকোন থেরাপি ধরনভেদে ১৫০০ থেকে ৭০০০ টাকার মধ্যেই হয়। ওজন কমানোর জন্য এখানে চিকিৎসা নেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে প্র্রথম ৩ দিনে শরীর থেকে টক্সিন বের করা হয়। ৩ দিনে লাগে ১২ হাজার টাকা। এরপর ৭ দিনের প্রোগ্রাম আছে, যাতে খরচ হবে ১২ হাজার। এরপর ডাক্তারের পরামর্শমত আরও কিছুদিন ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। ঢাকা শহরে বেসরকারিভাবে পরিচালিত বেশ কিছু আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা কেন্দ্র আছে।
চিকিৎসার নামে প্রতারণা
সত্যিকার অর্থে ‘আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা’ বলতে যা বোঝায় তার সাথে আমাদের পরিচয় ঘটেনি। উপরন্তু এর বিকৃত রূপটিই আমরা দেখছি। চিকিৎসার নামে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ইদানিং। রাস্তায় কিংবা বাসে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার নামে অনেক ধরনের দেখা যায়। ‘মাত্র ১০ দিনে মোটা হউন’, ‘গোপন অঙ্গের সমস্যায় ১০০% সমাধান’ ইত্যাদি। আবার, পাবলিক বাসগুলোতে লিফলেট বিলি করানো হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে একদল প্রতারক ব্যবসায়ী। তারা নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করছে। দুঃখের বিষয় হল, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোন আইন নেই এদেশে। ফলে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা বেড়েই যাচ্ছে। এ কারনে শিক্ষিত ও বড় অংশের মানুষ এই চিকিৎসায় আস্থা পাচ্ছে না।
দিনশেষে মানুষ প্রকৃতির কাছেই ফিরে আসে। প্রকৃতির নির্যাসে দেহ ও মনের রোগ সারিয়ে তুলতে চায়। সেক্ষেত্রে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার বিকল্প নাই। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের অভাবে আমরা এই চিকিৎসাব্যবস্থায় তেমন উন্নতি করতে পারিনি। সেই সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
সারাবাংলা/এসবিডিই