গল সৌন্দর্যের সীমাহীন সীমানায়
২০ জুন ২০১৮ ১৪:৫৪
মোহসেনা শাওন।।
ইট পাথরের এই যান্ত্রিক শহরের ব্যস্ততা ভুলতে মন মাঝেমধ্যেই কিছুটা বৈরাগী হয়ে ওঠে। ছুটে যেতে চায় অজানায়। হুটহাট ঘুরতে যাওয়ার গল্প সবার জীবনেই থাকে। তাই কাজের চাপ থেকে, প্রতিদিনের চেনা পরিবেশ থেকে দূরে মুক্ত আকাশের নিচে সুখ খুঁজে নিতে বেড়াতে যাচ্ছি। গন্তব্য রাবণের দেশ শ্রীলংকা।
শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোর বন্দরানায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সোজা গলে যাবো বলে ঠিক করলাম। গল শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান শহর। কলম্বো থেকে ১১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বাংশে এ শহরের অবস্থান। ষোড়শ শতকে পর্তুগীজরা এখানে আসে। এর আগে চতুর্দশ শতকে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এ শহরটিকে ‘কালি’ নামে উল্লেখ করেছিলেন। এরপর থেকে গল শ্রীলংকার অন্যতম বন্দর হিসেবে পরিচিতি পায়। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সাজানো গোছানো ছিমছাম ছোট একটা শহর গল। পুরো শহরটাই তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে ভারত মহাসাগর।
বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গলের বাস পাবেন না। কলম্বো শহরের শেষ প্রান্তে গিয়ে আপনাকে গলের বাস ধরতে হবে। আর হ্যাঁ কলম্বো থেকে গলের উন্নতমানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস পাবেন। পথে বাসের জানালা দিয়ে একসঙ্গে সাগর, পাহাড়, মেঘমালা, নারিকেল গাছের সারি, স্বল্প বসতি দেখতে দেখতে কখন গলে পৌছে যাবেন বুঝতেই পারবেন না। ট্রেনেও যেতে পারেন। তবে টিকিট পাওয়া সহজ না এবং সময়ও অনেক বেশি লাগবে।
যাই হোক গলে যখন পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। আগে থেকে হোটেল বুকিং করা ছিলো। বাস থেকে নেমে হোটেলের অবস্থান জানতে চাইলে এক শ্রীলংকান বললো, এটি গল ফোর্টের মধ্যেই। আমাদের যেখানে বাস থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিলো সেখান থেকে হাঁটা দূরত্বেই গল ফোর্টের অবস্থান।
ভারত মহাসাগরের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো গল ফোর্ট। সোয়া চারশো বছরের বেশি সময় আগে ১৫৮৮ সালে পর্তুগিজদের গড়া এই দুর্গ স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন। ৫০ বছর পর্তুগিজদের শাসনে ছিল এ দুর্গ। এরপর ওলান্দাজরা এসে এটি দখল করে। তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ১৫৬ বছর। ১৭৯৬ সালে গল দুর্গ দখল করে ব্রিটিশরা। গল দূর্গের মোট আয়তন ৩৬ একর। ৪০০ বছরের গন্ডি পেরিয়ে আজও গল দুর্গকে মনে হয় নতুনের মতো। মহাসাগরের মায়াবী হাতছানি আর মানুষের সৃষ্টি মহিমা গল দূর্গকে করেছে মহিমান্বিত। গল দূর্গ সৃষ্টিকলায় অপূর্ব, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজেকে করেছে অপরূপা, আকর্ষণীয়।
বলে রাখি ঘোরাঘুরির জন্য শ্রীলংকায় টুকটুক নামের যানবাহন অনেক জনপ্রিয়। টুকটুক অনেকটা আমাদের দেশে সিএনজি অটো রিক্সার মতো দেখতে। পরদিন সকালে উনায়োতুনা বিচ যাবো বলে ঠিক করলাম। টুকটুক ভাড়া করলাম উনায়োতুনা যাওয়ার জন্য। আপনি চাইলে লোকাল বাসেও যেতে পারবেন মাত্র ৫ থেকে ১০ রুপী ভাড়া পড়বে।
টুকটুক যাচ্ছে সমুদ্রের পাশ দিয়ে তৈরি রাস্তা ধরে। দেখতে দেখতে যাচ্ছি, জেলেদের বিরাট কর্মযজ্ঞ। সাগর থেকে বিশাল বিশাল মাছ ধরে রাস্তার পাশে এনে রাখছে বিক্রির জন্য। ক্রেতা আর বিক্রেতাদের জটলা লেগে আছে সেখানে। এগোতে থাকলাম রাস্তা ধরে, সে অপূর্ব এক রাস্তা। একপাশে সমুদ্র, অন্যপাশে ঘন জঙ্গল। পৃথিবীর অন্যতম এক সুন্দর সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছি। ক্ষুদ্র জীবনে অনেক সমুদ্র সৈকত দেখেছি। উনায়োতুনা বিচ তাদের মধ্যে অন্যতম সুন্দর। সমুদ্রের পানি সবুজ আর নীলাভ। সমুদ্রের পানি এতো স্বচ্ছ যে তলের প্রবাল, নুড়ি-পাথরও দেখা যায়। আর বালি লালচে রঙের। সূর্য কিংবা সমুদ্রস্নানে নিজেকে বিলীন করে দিন নীলাভ প্রকৃতিতে। সমুদ্রসৈকতে পা দিয়ে সাগরের সৌন্দর্যে অজান্তেই মন নেচে উঠলো।
কী সুন্দর সৈকত! পর্যটকের অতিরিক্ত কোলাহল নেই, সমুদ্র সৈকত কতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ওখানকার এক স্থানীয় জানালো ২০১৬ সালেই নাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছয়টি সমুদ্র সৈকতের মধ্যে এটি অন্যতম ছিলো। মনটাই খারাপ হয়ে গেল আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা ভেবে। এতো বড় সুন্দর সৈকত কিন্তু যত্ন, অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায় আজ বিদেশি পর্যটকশূন্যই বলা যায়।
সে যাই হোক, নরম বালুচরে নেমে দেখবেন লাল রঙের রাজকাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপ, গভীর সাগরে মাছ ধরে জেলেদের ফিরে আসা। এক অন্যরকম ভালোলাগার জগতে ফিরে যাবেন।
উনায়োতুনা বিচ থেকে বেশ কাছেই আরেকটি সমুদ্র সৈকত যেটি জাঙ্গল বিচ নামে পরিচিত- সেখানে গেলাম। আয়তনে উনায়োতুনা বিচের থেকে অনেক ছোট জাঙ্গল বিচ। পাহাড়ের সরু পথ ধরে ঘন জংগলের ভেতর দিয়ে অনেকদূর নিচে নামলে দেখা মিলবে জাঙ্গল বিচের। বেশ বড় বড় পাথর এই বিচের চারপাশে যেটা এই সৈকত কে আলাদা করেছে অন্যগুলোর থেকে। ছোট হলেও অনেক সুন্দর একটা সৈকত। একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম শ্রীলংকায় প্রচুর বিদেশি ভ্রমনে আসেন। এর একটি কারণ হলো এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত ভালো এবং শ্রীলংকানরা অত্যন্ত সাহায্যপ্রবন আর অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতো রয়েছেই।
‘ঐ ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় আমার ইচ্ছে করে, আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায়, তোমার হাতটি ধরে’…। না এখানে আমি একা। তাই একাই জাঙ্গল বিচে মন না ভিজিয়ে সমুদ্রস্নানে নেমে পড়লাম। সমুদ্রস্নান শেষে চলে গেলাম আমাদের থাকার জায়গা গল ফোর্টে।
পাহাড় সমান এই ফোর্টের প্রাচীর যেমন উঁচু তেমনি এর বিস্তৃতি। প্রাচীরগুলো এত চওড়া ও মজবুত যে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে তার উপর দিয়ে দলেবলে হাঁটা যায়, বসা যায়। দেয়ালের উপর থেকে শহরের দিকে তাকালে সহজেই চোখে পড়ে শ্রীলংকার বিখ্যাত গল ক্রিকেট স্টেডিয়াম। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত মাঠটি খুব সহজেই কাছে টানে। এখানেই টেস্টে মুশফিকুর রহিম এক ইনিংসে দুই শতকের মতন রান করেছিলেন।
সুবিশাল এই ফোর্টের ভিতরে আছে জাদুঘর, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, ডাচ হাসপাতাল, মসজিদ, লাইট হাউজ, হীরা জহরতের অনেক দোকান, প্রাচীন লাইব্রেরি, অতি পুরাতন ঘরবাড়ি, প্রশস্ত সড়ক, ঐতিহ্যবাহী হোটেল দুর্গ প্রাচীরের উপর দিয়ে সারাটা দুর্গ হেঁটে হেঁটে দেখা যায়। এর তিনদিকেই ভারত মহাসাগরের নিরবচ্ছিন্ন কোলাহল আর দূর আকাশ শেষে দিগন্তরেখা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। নীল জলরাশির এই মহাসাগরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত ভ্রমণপিপাসু মানুষের ঢল নামে এই গলেই। এখানের নীল জলরাশি আর সাদা ধবধবে বালুতে হেঁটে নোনা বাতাস গায়ে মাখতে কিন্তু বেশ লাগছিল। গলের সৌন্দর্য শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে এই গল ফোর্ট। সাগরের একেবারে কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, মহাকালকে ধরে রেখেছে লাইট হাউজ।
লাইট হাউজের অদূরেই চোখে পড়বে এক প্রাচীন মসজিদ। নির্মাণ কাঠামো ও শৈলী গির্জার মতোই। মসজিদের রঙ সাদা ধবধবে। নাম গল মীরা মসজিদ। পর্তুগিজ আমলে এখানে মসজিদ করতে দেওয়া হয়নি। পর্তুগিজরা মুসলমানদের বিতাড়ন করে গল থেকে। পরবর্তীকালে ১৭৫০-এর দশকে এটি নির্মিত হয়। ১৯০৪ সালে তা সংস্কার করা হয়। ১৮৯২ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও আরবি কলেজ। মুসলিমরা ঐতিহ্য নিয়ে গল ফোর্টে অবস্থান করছেন শত শত বছর ধরেই।
মসজিদের মাথায় চারটি গম্বুজ বসানো আছে। ছোট ছোট কিছু মিনারও দেখতে পাবেন। দুর্গের ভেতর ও আশপাশে অনেক মুসলমান রয়েছে। যতটুকু জেনেছি আরব বণিকদের বংশধর তারা।
গল ফোর্ট প্রাচীরের প্রশস্ত বাঁধ, প্রতিরোধ বা আত্মরার জন্য কালজয়ী কেল্লা। এই ফোর্ট তৈরী করতে সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়েছে অকাতরে। এই মহাযজ্ঞে শ্রম দেয়ার জন্য ওলন্দাজরা নিয়ে এসেছিল ইন্দোনেশিয়া ও মোজাম্বিক থেকে শ্রমিক। সুর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মাঝে নিষ্পেষিত কত যে শ্রমঘণ্টা এখানে উৎসর্গিত হয়েছে, ভাবতে অবাক লাগে।
এখানে আরো দেখা মিলবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্মৃতিসুধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ডাচ মিউজিয়াম। দূর্গের পুরাতন গেটের কাছে রয়েছে ন্যাশনাল ম্যারিটাইম মিউজিয়াম। গল দূর্গের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ দুটি প্রবেশ তোরণ। একটি প্রধান প্রবেশ তোরণ। প্রথম তৈরি পর্তুগিজদের হাতে যা, ওলন্দাজদের হাতে আরো বৃহদাকার রূপ নেয়। তারপর বৃটিশরা একে বর্তমান আঙ্গিকে আনে ১৮৭৩ খিৃষ্টাব্দে। কুইন স্ট্রিটে আছে প্রাচীন প্রবেশ তোরণ, এখানে দেখা মিলবে বিখ্যাত কোর্ট অব আর্মস, একজোড়া সিংহ।
পথে পথে অনেক ভবনের দেখা মিলবে যা আপনাকে অনেক আগের দিনের কথা মনে করিয়ে দেবে। গল ফোর্টের প্রাচীরের উপর হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যায় ইতিহাসের সেই স্বর্ণালি সময়ে যখন এই দুর্গ ছিল জমজমাট ও বহু বৈচিত্র্যের আধারে পূর্ণ। আকাশ, সমুদ্র ও মনুষ্যসৃষ্টির বিশালতা এনে দেবে ভালোলাগার মিষ্টি অনুভূতি।
শেষ বিকেলে উঠি ফোর্টের প্রাচীরে। সামনে বিশাল সমুদ্র, ঊর্মিমালার মুখর কলতান। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা আসছে পৃথিবীতে। আমি তাকিয়ে দেখছি, দূরে সমুদ্রের বুকে নীল জলরাশির ভেতর সূর্য ডুবছে ধীরে ধীরে। স্থিমিত হচ্ছে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের আলো। দেখতে দেখতেই সমুদ্রের অতল জলরাশির ভেতর হারিয়ে গেল সূর্য। কী অপূর্ব দৃশ্য!
আমি গল ফোর্টের যে হোটেলে উঠেছিলাম সেখানকার বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়, দেখা যায় দূরে ভেসে যাওয়া জাহাজ। রাতের খাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে বসলাম। দূর থেকে সাগরের গর্জন শোনা যাচ্ছে। শুক্লপক্ষের রাত্রির প্রায় পূর্ণাঙ্গ চন্দ্রটিকে এক দৃষ্টিতে তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো দেখতে থাকলাম। জ্যোৎস্না রাত্রিতে চাঁদের সৌন্দর্যের রূপ যে এত মোহনীয় হতে পারে তা বোধকরি আজকেই প্রথম উপলব্ধি করলাম।
গলের স্থানীয় মানুষজনকে অনেক শান্তশিষ্ট বলেই মনে হয়েছে। অধিকাংশ মানুষই সিংহলি, তামিল ভাষায় কথা বলেন। তবে ইংরেজিতেও তারা বেশ দক্ষ। নারীদের পোশাকেও রয়েছে ভিন্নতা। তবে এখানকার খাবারের দাম শ্রীলংকার অন্যান্য এলাকার চেয়ে কিছুটা বেশি মনে হলো। কিন্তু গল সৌন্দর্যের যে পসরা সাজিয়ে বসে আছে তার কাছে এই একটু বেশি দাম মেনে নেয়াই যায়।
লেখক: সংবাদ উপস্থাপিকা।