Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

থামেল, নেপালে

আসিফ কবীর
৮ মার্চ ২০২২ ১৮:১০

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর সলটি এলাকায় পরাপর পাঁচ তারকা হোটেলের সারি। এখানে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার শেষ হলে পরদিন সকালে পাঁচ তারকা হোটেলের পাট চুকিয়ে, রুমের ডোর-কার্ড জমা দিয়ে, চেক-আউট হয়ে বাবুর বেরিয়ে পড়লেন থামেলের দিকে। থামেলের একটি হোটেলে তার রুম বুক করা আছে আজ থেকে। এই সেমিনার সম্পর্কিত একটি দল প্রথম থেকেই আছে থামেলে। তারা সেমিনারটির ইন্টারমিডিয়েট সাপোর্ট টিম বলে শুরু থেকেই এই বিখ্যাত পর্যটন এলাকায় থাকতে পারছেন। তাদেরই একজনের কাছে বাবুরের আটাশ ইঞ্চি স্যুটকেসও দিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকেই। পরিকল্পনামতো দুই দিন সলটিতে থেকে বাবুর চলে আসবেন থামেলে। তখন বড় স্যুটকেসটিও বুঝে নেবেন।

বিজ্ঞাপন

থামেলে পৌঁছে বাবুর নির্ধারিত হোটেলের রিজার্ভ রাখা রুমে উঠলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন। থামেল জায়গাটি আমাদের শাঁখারী বাজার বা লক্ষ্মী বাজারের মতোই। বলা যায় যেকোনো পুরোনো জেলা শহরের বড় বাজার এলাকাটি যেমন, তেমনই। কিন্তু অনেক কালারফুল। পর্যটকে ঠাসা। অধিকাংশই তারা পশ্চিমা। ছোট ছোট দোকানঘর। হরেক রকম পসরা সাজানো। বেশির ভাগ হস্তশিল্পের জিনিস। পিতলের, তামার। পাথর, মাটি, শোলা, কাঠ বিভিন্ন সহজলভ্য উপাদানেরই তৈরি এসব। হাতের নিখুঁত কারুকাজ, রঙের ছটা, তুলির আঁচড়, ঢালাইয়ের পেটা কাজ প্রভৃতি বিভিন্নভাবে শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। আছে পশমিনার দোকান। যেখানে শৈল্পিক বুননে পাহাড়ি ছাগলের পশম সংগ্রহ করে শাল, কম্বল, সোয়েটার, কার্ডিগান তৈরি করে সাজানো। আরও কত কী! বাবুর নানা রকম পসরা দেখতে লাগলেন। নেড়ে-চেড়ে, কয়েকটি তৎক্ষণাৎ কিনে নিয়ে। একটি দোকানের পসরায় তার চোখ আটকালো। ছোট ছোট নীলাভ পাথরকুচি বসিয়ে মেটালে তৈরি পদ্মাসন বুদ্ধদেবের অবয়বকে আরও মোহনীয় করে উপস্থাপন হয়েছে। দোকানটির বেশির ভাগ ঘরের সৌন্দর্যায়ন সামগ্রী এ রকম পাথর বসিয়ে তৈরি করা। অনেকটা ম্যুরালের শিল্পমাধ্যমের মতো। তিনি আরও একটি দোকানে প্রবেশ করলেন।

বিজ্ঞাপন

এর আগেরবারেও এই দোকানে বাবুর এসেছেন। দোকানটিতে বড় আকৃতির গৃহসজ্জা সামগ্রী বিক্রি হয়, সবই পিতলের। কিছু নিকেল করা। আমাদের দেশের এলিফ্যান্ট রোডের পিতলের দোকানগুলোর মতোই। এখানে গেলবার পিতলের চিতা বাঘ দেখেছিলেন; বিশেষত্ব হলো, সারা গায়ে ফুল-পাতার নকশা করা। যেমনটি আবার আমাদের দেশে হয় না। এবার পেলেন না তা আর। কিন্তু বাবুরের মনে গেঁথে ছিল জিনিসটি। স্ট্যান্ড বক (পাখি) দেখলেন। মাটিতেই দাঁড় করিয়ে রাখার মতো। অনেক রকম তৈজসপত্র। একটি প্রমাণ আকৃতিরও অধিক বড় বুদ্ধ মস্তক কেনার দরদাম শুরু করলেন দোকানির সাথে। দোকানি ব্রিটিশদের মতো উচ্চারণে ইংরেজি বলেন। বাবুর শুনে বেশ চমকিত হলেন। ভাবলেন, হয়তো কনভেন্ট স্কুলে পড়ে এমন ইংরেজি আত্মস্থ করেছেন। দোকানির চেহারা টিপিক্যাল নেপালিদের মতো, উচ্চতা গড়পড়তা থেকে বেশ খানিকটা বেশি। পেটা গড়ন, কোঁকড়া চুলের ওপরে চূড়া করে খোঁপা করা, যুবক বয়সী। ছেলেটিকে বাবুর দাম মেটানোর আগে দিয়ে তার ইংরেজির প্রশংসা করলেন। সে-ও খুশি হয়ে আরও কথা বাড়ালেন। বাবুর বুঝলেন, তার ধারণা ভুল। তিনি স্কুলে যানইনি বেশি দিন। থামেলেই ট্যুরিস্টদের সাথে সেই ছোটবেলা থেকেই ওঠাবসায় এমন চোস্ত ইংরেজি রপ্ত করেছে। অবাক বাবুর প্রতিশ্রুতি করলেন- এটা তিনি অনেককেই বলবেন। নেপাল নিয়ে কিছু পোস্ট করলে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেখানেও লিখবেন। এরই মধ্যে পিতলে গড়া বুদ্ধ মাথাটি বাবল পেপার, তারপর পুরোনো খবরের কাগজে প্যাকেট করে দড়ি বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নেওয়ার মতো প্রস্তুত করে তুলে দেওয়া হলো। তিনি বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আরও কিছুক্ষণ তিনি এদিক-সেদিকে ঘুরে বেড়ালেন। হাতে ধরা জিনিসটি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্তিবোধ করায় ফিরলেন হোটেল কক্ষে।

হোটেলে তখনো সফরসঙ্গীদের কাউকে দেখা গেল না। রাতে যে যার মতো ফিরলেই দেখা হবে, এর আগে আর না। দুপুরে খাওয়ার পর্ব সেরে ঘুমিয়ে নিলেন। কারণ, দুদিনের কাজের ধকলে বিশ্রাম চাচ্ছিল শরীর। বিকেলে উঠে আবারও বের হলেন বাইরে। তখন সে এক অন্য থামেল। বিদেশিদের আনাগোনা বাড়ছে। পাব ও নাইট ক্লাব খুলে গেছে। আলো কমে যাচ্ছে, সে ঘাটতি পূরণ করছে বিজলির আলো জ্বলে উঠে। সন্ধ্যা ক্রম আসন্ন। পাহাড়ের উপত্যকার শহর। রাত নামে দ্রুত, শহর ঘুমিয়ে পড়ে আগে আগে। বাবুর একটি ধূপদানি কিনলেন। স্তম্ভের মতো, ভেতরের আগরবাতির বাষ্পায়িত সৌরভ বেরিয়ে আসার জন্য স্তম্ভটির গায়ের নকশা জালিকাট করা। ভেতরের আগরবাতির কাঠি দাঁড় করানোর জন্য ছিদ্রের ঘাট করা আছে। সেখানে রেখে কাঠির শীর্ষে আগুন ধরিয়ে স্তম্ভের সদৃশ লম্বাটে ঢাকনাটি বসিয়ে দিলে নকশার কাটা দিয়ে সুবাসিত ধোঁয়া বাইরে আসে। এর আগেরবার কিনেছিলেন একটি চৌকবাক্স। গায়ে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন পবিত্র চিহ্ন কাঠে নকশা করে তুলি দিয়ে রঙিন করা। বাক্সের ঢাকনাটি খোলা যায়। ঢাকনার গায়ে লম্বালম্বি কাটা। কাটা মুখটি সোনা রঙে রাঙানো। বাক্সের ভেতরে ধাতুর প্লেট বসানো আছে। তার ওপরে ধূপের দড়ির মতো পাকানো সলতে রাখতে হয়। মাথার কাটা ফাঁকটি দিয়ে ধূপের ধোঁয়া প্রজ্বালিত হয়ে বেরিয়ে আসে। পাতলা কাপড়ের মধ্যে ধূপ চূর্ণ দাহ্য তুষের সাথে মিশিয়ে রোল করে দড়ির মতো পাকানো হয়। প্রদীপের সলতের মতো ধূপের পুরিয়া প্যাকেট করে কিনতে পাওয়া যায়। ধর্মীয় আচারের জন্যই এটা তৈরি আর ব্যবহার হয়। বাবুর কিনেছিলেন মশা তাড়ানোর মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে। বাবুর থামেলময় ঘুরতে লাগলেন। থামেল শহরের পুরোনো অংশ। ঘরবাড়ি অধিকাংশই পুরোনো। আমাদের জমিদার বাড়িগুলোর মতো। ভবনগুলোর প্রধান দরজা কাঠের, নকশা করা। মনে হয় একেকটি রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার। এরই রেপ্লিকা স্বর্গের দরজা নামে এখানকার দোকানে বিক্রি হয়। স্থানে স্থানে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের রঙিন কাগজ বা পলিমার দড়িতে ঝুলিয়ে টানানো। কোনো কোনো খানে এর সাথে মরিচবাতি দেওয়া। ছবি বিক্রির দোকানের সামনে গিয়ে বাবুর দাঁড়ালেন। বেশির ভাগ ছবিই হিমালয়, হিমালয়ের পাদদেশে জনজীবন, বুদ্ধদেব ও বুদ্ধচক্রের। হিমালয়ে সূর্যোদয়, পাহাড়ে চমরি গাইয়ের দল, পাহাড়ি পরিশ্রমী মানুষের ঋজু চেহারা, তাদের জীবিকার সুকঠিন সংগ্রামের ছবি…। একটি ছবি দেখে গা ছমছম করে। জনমানবহীন পাহাড়ে একজন মানুষ গবাদিপশু নিয়ে একটি সাঁকো পার হচ্ছেন। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে চলেছেন। নিচে গভীর খাঁড়ি। পাহাড়ের দুই অংশ যুক্ত আছে একটি মোটা গাছকে শুইয়ে দিয়ে। একহারা গাছের, খুব পরিচিত গাছ হয়তো হবে না, পাহাড়ি জঙ্গলের গাছের গুঁড়ি, আবলুস গাছের মতোই অনেকটা, সেটাই সাঁকো। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সূর্যাস্তে হলদে, কমলা ও সিঁদুর রঙের ব্যবহার ছবিতে আলাদা ঔজ্জ্বল্য যোগ করেছে। বুদ্ধচক্রের ছবিতে সোনালি রঙের ব্যবহারের কারণে আলাদা রকম দৃষ্টিনন্দন লাগল বাবুরের কাছে। তিনি একটি বুদ্ধচক্র কিনলেন। কাপড়ের ওপর অঙ্কিত। দোকানি বোর্ডের শক্ত রোলের মধ্যে ছবিটি ঢুকিয়ে সুন্দর প্যাকেট করলেন। একজন শিল্পী পাশে কাজ করছিলেন। ক্যানভাসে তিনি আঠা ব্রাশ করে তাতে একটি ২০-৩০ ইঞ্চি মাপের পাতলা টিস্যুর মতো কাগজ পেস্ট করে শুকিয়ে একটি রাফ টেকচার তৈরি করেছেন আগেই। সেটার ওপরে মাউন্টেইন ট্র্যাকিংয়ের ছবি আঁকছেন। সরল প্রযুক্তিটি এত ভালো লাগল যে বাবুর কোনো প্রয়োজনের তাগিদ ছাড়াই দুটি ফিনফিনে কাগজ কিনলেন। পাশের দোকানে খুরপির বিরাট সম্ভার নেড়েচেড়ে দেখলেন। খুরপি ড্যাগারের মতো ছুরি, শেরপারা পাহাড়ে ওঠার সময় বাধা হওয়া গাছের ডালপালা ছাঁটতে হাতে রাখেন। বাবুর শান্তিপ্রিয় মানুষ। ভাবলেন খুরপি কিনে লাভ নেই, এ পথ আমার নয়। খুরপি নেপালি আইকনিক স্যুভেনির। খুরপি না নিয়ে বরং কাঠের তৈরি ময়ূরের পেখম মেলা নেপালি কারুশিল্পের স্যুভেনির একটি সংগ্রহ করলেন। চমরি গাইয়ের চামড়ার ব্যাগ, জ্যাকেট, পাউচের দেখা পেলেন। সস্তা পেয়ে কয়েকটি টুকটাক পাউচ বা পার্স মতো নিয়ে নিলেন। অ্যারোমার দোকানে ঢুঁ দিলেন। গোট মিল্কের সাবান নিলেন। গোট মিল্কের সাবানে মেঘের মতো অতিমোহনীয় পেলব ফেনা হয় অল্পতেই। সুগন্ধি ক্রিম নিলেন। কিছুটা নতুন ঠেকল এ জিনিসটা। পারফিউম সলিড ফরম্যাটে, ক্রিমের মতো। তাই নেওয়া। যৌন বলবর্ধক নানা মালিশ দেখলেন, দূর থেকে। হাত নিশপিশ করলেও নেড়েচেড়ে দেখা হলো না শেষমেশ। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন পার্সোনালাইজড স্টোন প্লেট। মানে কালো পাথরের প্লেটে নাম, নকশা, ছবি খোদাই করে নেওয়া যায় এসব দোকান থেকে। তিনি আগ্রহ নিয়ে তার মে’র নামটি লিখতে ফরমাশ দিয়ে এলেন, কিছু টাকা অ্যাডভান্স করে। কারিগর বাবুরের মে’র নামটি ইংরেজিতে হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে ব্যাপৃত হয়ে গেলেন। এত দেখে, এত ঘুরেও তখনো বাবুরের মন ভরে না। কিন্তু কিছুটা ক্লান্তিবোধ করায় একটি কফিশপে ঢুকলেন। একজন কফিশপের নাম সাজেস্ট করেছিলেন, খুঁজে পেতে পেতে আরেকটু হয়রান হলেন। বাংলাদেশের টাকার চে’ নেপালি রুপির বিনিময় মূল্য কিছুটা কম। তাই অনেক কিছু কেনাকাটায় খুব কষ্ট মনে হয় না। ফুরফুরে মেজাজেই বাবুর চুমুক দিলেন কফির কাপে। নেপালি কফি, রেগুলারভাবে তৈরি করা। নেসক্যাফের মতো এত মিহি না, তলানিতেও থেকে যায়, সম্পূর্ণটা দ্রবীভূত হয় না। সাথে একটি হাতের তালুর সমান বড় কুকিজ নিলেন। চকলেট চিপ দেওয়া। পেটে অনেকক্ষণ থাকবে বুঝেই নিলেন। ডিনার সকলের সাথে করতে হবে। কতক্ষণে তা নির্দিষ্ট নয়। ময়শ্চার কুকিজই ততক্ষণের ভরসা। খেতে খেতে বাবুরের মনে হলো আমাদের পুরান ঢাকায় এমন একটি থামেলের মতো জায়গা নেই কেন যে? ট্যুরিস্ট আনতে পারলেই তো হয়ে যেত। চকবাজার অথবা ইসলামপুর কিংবা বাংলাবাজার কি শাঁখারীপট্টিÑ এমন তো করাই যায়, ইত্যাদি। স্থাপত্যের বিবেচনায় তো কোনো পার্থক্য নেই। এসব কথা আরকি। কফি শেষ করে বের হলেন। বন্ধুর সাজেস্টেড আরেকটি কাজ করলেন। এক কি দুই প্যাকেট ম্যাংগোপিকো চা কিনলেন। নেপালের পাহাড়ে উৎপন্ন সেরা চা নাকি এটাই।

এখান থেকে বের হয়ে বাবুর থামেলেই ঘুরতে ঘুরতে আরেকটি দিকে চলে এলেন। এখানে পাব, ডান্সবার, নাইট ক্লাব…এর ছড়াছড়ি। সাহেব-মেমদের আনাগোনা বেশি বেশি। নানা ভাষার মানুষের উচ্ছ্বাসভরা আলোচনার টুকরো কানে আসে। জার্মান, সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান ভাষাভাষী অনেক বেশি। এই এলাকাটি অনেক বেশি আলোকোজ্জ্বল, গানের জোর আওয়াজ ভেসে আসে বাইরেও। খোলা রেস্টুরেন্টের ঘেরার ভেতরে সাহেব-মেমরা বিয়ার, টিবোন স্টেক, ম্যাসড পটেটো বা ফিশ অ্যান্ড চিপস খাচ্ছেন। ওই এলাকায়ই বাবুর একটি সুপারস্টোরে ঢুকলেন। সেখানে একটি অংশে অ্যালকোহল বিক্রি হয়। গুর্খা বিয়ারের লিটার বোতলের ছড়াছড়ি, স্থানীয় রেড ওয়াইন খুবই সস্তা। স্যুভেনির অ্যালকোহলও আছে। কাচের বোতলটি খুরপির সদৃশ। বাবুর তুলনা করে দেখলেন, আমাদের দেশের এক বোতল পেরিয়ার কি এভিয়ান এক লিটার পানির সমান দামে লিটার খানেক রেড ওয়াইন মিলছে। খুশিতে চোখ তার চকচক করে উঠল। মুখ ঠোঁটে চুকচুক একটা রেশ শুরু হলো কিনতে কিনতেই। সুপারস্টোর ছেড়ে এসে হাঁটতে লাগলেন। হোটেল অভিমুখী। পথে চোখ আটকাল পিতলের তালায়। বাঘ, হরিণ, সিংহ বা লিও, সূর্যদেবের অবয়বে দরজার তালা, হাতল বিক্রি হচ্ছে। পছন্দ হওয়ায় এর মাঝ থেকে একটি তালা কিনে নিলেন। থামেলের বর্ণিল রাতের জীবনের বাহ্যিক চেহারা অবগাহন করে করে, আয়েশিভাবে হেঁটে হোটেলে ফিরলেন। হঠাৎ একদিন বেশি হাঁটাচলায় পায়ে ব্যথা অনুভব শুরু হয়েছে। তিনি তাতেই সাথের রেড ওয়াইনটি সাবাড় করার একটি মওকা পেয়ে গেলেন।

হোটেলে ঢুকে অপরিসর লবিতে সফরসঙ্গী অনেককেই পেয়ে গেলেন। তিনি তাদের মনে মনে সারা দিনই খুঁজেছেন। কিন্তু এই ইভনিং ওয়াক ফেরত হাতে শপিং-সমেত এভাবে মুখোমুখি হতে চাননি। বুদ্ধি করে হাতের ব্যাগগুলো সাথের সবচেয়ে বড় ব্যাগটিতেই রিঅর্গানাইজ করে রেখেছিলেন। টুক করে নিজের রুমে ফ্রেশ হওয়ার ছলে, ব্যাগ রেখে লবিতে ফিরে, হালকা মেজাজে বন্ধুদের ছোট্ট কংগ্রেসে ঢুকে আমোদিত হলেন। কুশল জিজ্ঞাসা, হালকা আলাপ করতে মত্ত থাকলেন। কিন্তু অল্প পরেই বাবুর বুঝতে পারলেন, সবাই মনমরা হয়ে আছেন। গভীরভাবে বিমর্ষ সবাই। কারও মনে কোনো উচ্ছলতা নেই। বাবুর সংবেদনশীল মানুষ। অপরের দুঃখবোধ, বেদনা বা সংকটকে সব সময় দেখেন সমানুভূতিতে। এখনো কিছু না জেনেই তিনিও দুঃখিত হলেন, এর প্রকাশে তার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে এলো। কী হয়েছে, কেন হয়েছে এসব প্রশ্ন নিয়ে এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। অল্প পরেই তানজিদের কাছে প্রথম শুনলেন, ‘একটি ডান্সবারে আজ মারামারি হয়েছে। টাকাপয়সা কেড়ে রেখেছে বারের লোকেরা। যার যা সাথে ছিল এমনকি গলার চেইন, ঘড়ি, আংটি পর্যন্ত। রোহান ভাই প্রতিবাদ বেশি করায় সবচেয়ে বেশি তাকে মার খেতে হয়েছে। কেটে টেটে গেছে অনেক জায়গায়। সিগারেটের আগুনের ছ্যাঁকা দিয়েছে। আমরা থানায় গিয়েছিলাম। পুলিশ এসে ওদের বার সিল করে একজনকে ধরেও নিয়ে গেছে।’

ডান্সবার বললেও প্রকৃতপক্ষে ছিল পাব। থানার ডায়েরিতে শ্রেণি অনুসারে পাবই উল্লেখ করতে হয়েছে। এর ব্যাখ্যাটি বাবুর নিজের মতো করে ধরে নিয়েছিলেন যে, তানজিদের পর্যবেক্ষণ বা সেখানে হওয়া বিরোধপূর্ব মধুর অভিজ্ঞতায় তিনি ডান্সবারই ধরে নিয়েছেন।

শুনে বাবুরও মর্মাহত ও হতাশ হলেন। নেপালিরা তো অনেক সৎ ও বিশ্বস্ত বলে সুনাম আছে, কেন এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা হলো, ঠিক মানতে পারলেন না। নেপালিদের এমন হঠকারিতা আশা করেননি তিনি। তানজিদ বললেন, তিনি দু-একজনের সাথে কথা বলেছেন। তাদের ধারণা, এসব কারবারে অনেক ভিনদেশি ঢুকে পড়েছে আজকাল। সান্ত¡না দিয়ে বাবুর সবাইকে বললেন, ‘পুলিশ কেস টেকআপ করেছে। আমরা বিচার পাব নিশ্চয়। মন খারাপ করে কী লাভ আর? লেটস্ গো ফর দ্য ডিনার।’ লবিতে বসা সবাইকে সাথে নিয়ে বাবুর একটি রেস্তোরাঁ অভিমুখে গেলেন। অনেকে তখনো আসেননি। তাদের জন্য রেস্তোরাঁর সামনে জটলা করে অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হলে বাবুর একটি পশমিনা শালের দোকানে ঢুকলেন। দোকানি এটা-ওটা দেখাতে দেখাতে একটি ডিসপ্লে করা শালে চোখ আটকালো বাবুরের। ওই মানের কাজের কয়েকটি শাল দেখালেন দোকানি। পুরো জমিনজুড়ে কাজ। একটি ফুলের, একটি পাখির, একটি বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব কাজে ফুটিয়ে তোলা। যেন ফুলেরটিতে পুরো বাগান, পাখিরটিতে গাছের সব পাখী, প্রাণীদের নকশাঙ্কিতটিতে পুরা জঙ্গল তুলে আনা হয়েছে, এমন মনে হলো বাবুরের। দরদাম শুরু করলেন। অনেক দাম চান বিনিময় মূল্য হিসেবে দোকানি। অসঙ্গতও নয়, যেহেতু ভরাট কাজ করা জমিনজুড়ে। পছন্দ হওয়ায় ছাড়াও যায় না, আবার প্রায় সব টাকা এক শালে ব্যয়ও করা যায় না। দরদাম চলতে থাকল, আসলো তার কী বাজেট, কতটুকু সক্ষমতা। বাজেট বেঁঁধে দিয়ে এক লাফে আট-দশ হাজার টাকা কমিয়ে ফেলতে পারলেন। দোকানি এত বেশ কম মেকআপ দিতে বললেন, বাংলাদেশে এই শাল মাত্র তিনটি ঢুকেছে এর আগে। একজন মহিলা উদ্যোক্তা, একজন মেম্বার অব পার্লামেন্ট আর একজন মোবাইল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ নিয়ে গেছেন। বাবুর ব্যাপারটি বুঝলেন। মূলত তিনি শালটি যে নিশ ওয়্যার, সেটিও বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তিনি কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে বুক করলেন। হোটেল থেকে বেশি টাকা নিয়ে বের হননি। কাল ডেলিভারি নেবেন। দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে বাবুরের কেন জানি মনে হলো, একটি শাল নির্ঘাত রুবাবাদৌলা মতিন নিয়েছেন। যদিও তিনি সেই মুহূর্তে সেলফোন কোম্পানির চাকরি বদলে ফেলেছেন। যখন নিয়েছেন, সময়টা আরও আগে হতে পারে চাকরিতে থাকাবস্থায়। আবার তিনি না-ও হতে পারেন। তবু কেন জানি তাঁর নামটিই বাবুরের মনে হলো।

যে রেস্টুরেন্টে ডিনারের কথা, বাবুর তার সামনে মাথা গুনে দেখলেন, সবাই এসে গেছেন। তারা একটি বড় টেবিলে সবাই বসলেন। যার যেমন পছন্দ তেমনি এক:এক মেন্যু অর্ডার করলেন। বাবুর নিলেন নেপালি আমিষ থালি। এক থালাতেই সব অল্প অল্প করে পেয়ে যাবেন। স্বাদবদল ও কম ঝামেলায় বৈচিত্র্যের সুযোগ থাকবে ভেবে। কয়েক দিনে পাহাড়ি গরু বা মহিষের মাংসের স্টেক খেয়ে তানজিদের আসক্তি হয়ে গেছে। তিনি ‘বাফ বাফ’ করে হাঁক দিলেন। যে যার মতো অর্ডার বললেন। নেপালিদের অথেনটিক খাবারের রেস্টুরেন্ট এটি। নেপালিরা ফ্রেশ রান্না করে, বাসি খাবার রাখে না, উচ্ছিষ্ট খায় না একদমই। বেঁচে যাওয়া খাবার ডিশে থেকে গেলে বা হাতের স্পর্শ ছাড়া বেড়ে নেওয়া হলে তা-ও উচ্ছিষ্ট বলে ধরে নেন। এ জন্য খাবার আসতে সবখানেই সময় লাগে একটু বেশি। এই অবকাশে নানা রকম গল্পগুজবে কাটল। একদল পরিকল্পনা করল নাগরকোট যাবে। খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে ধূমপায়ীরা যথারীতি সিগারেট ধরালেন। বাবুর বিকল্পে দুই প্যাকেট পান পরাগের একটি হাতে রেখে অপরটি মুখে ঢাললেন। হাঁটতে হাঁটতে তারা হোটেল ইকোর দিকে এগোচ্ছিলেন। দলের সবকিছুতে তানজিদকে ফোকাল পয়েন্ট করায় এসময় মোশাররফ ক্রুদ্ধ হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। বাবুর তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। হোটেলের সামনে এসে যাদের তখনো ক্লান্তি আসেনি, তারা ঠিক উল্টো দিকেই একটি নাইট ক্লাবে গেলেন। হোটেলের লোক মারফত ওদের ম্যানেজারের সাথে কথা বলানো হয়েছে। গত দিনের মতো অনাকাক্সিক্ষত কিছুই হবে না আর। এই ফাঁকে তানজিদ বাবুরকে একটি নেপালি নম্বরে তার হোয়াটসঅ্যাপে কথাবার্তা দেখালেন। মে’টির ছবি দেওয়া আছে, তার অ্যাকাউন্টে। চশমা পরিহিতা, মিষ্টি চেহারার। গত দু-এক দিনেই ভারি ভাব হয়েছে তানজিদের সাথে। মে’টির নাম আনুশকা। এরই মধ্যে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। জনাকীর্ণ থামেল তখন সুনসান। দোকানি, রেস্টুরেন্ট কর্মী, পর্যটক, ক্রেতা- সবাই ঘরফিরতি। রাস্তায় পাহাড়ি পশমি কুকুর শুয়ে-বসে আছে নির্বিঘ্নে। গাড়িঘোড়া নেই, মানুষজন কমে গেছে সেই সুবিধায়।

পরদিন সকালে নেপালে কর্মসূত্রে অবস্থানকারী কয়েকজন বাংলাদেশির সাথে ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা করা আছে। সকাল সকাল রেডি হয়ে নিতে হবে। বাবুর হোটেলে প্রবেশের আগে রাস্তায় বিদায়বেলায় তানজিদকে বলে নিলেন, ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট মেলে বিদেশে একসাথে ট্রাভেল করলে। এই যে আমি এখন যে হোটেলে সুবোধ বালকের মতো চলে যাচ্ছি, এটা দেশে ফিরে কিন্তু সবাইকে বলা চাই। এটাই আপনার কাছ থেকে আমার পাওয়া চরিত্র সনদ হবে।’ এরপর দুজনেই হাসি বিনিময় করে যে যার পথে চলে গেলেন। রাতের মতো অন্য সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাবুর হোটেল রুমে চলে এলেন।

সকাল সকাল উঠে ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্রে চোখ বোলালেন বাবুর। একটি সংবাদে চোখ আটকাল, ওমানে একটি নির্মাণাধীন স্থাপনায় দুর্ঘটনায় নেপালি শ্রমিকের মৃত্যু। খবরটি বিদেশি এজেন্সির বরাত দিয়ে ছাপা। হেডলাইন ও বডি- সবই প্রলম্বিত বাক্যে লেখা। বেশ অবাক ঠেকল বাবুরের। বাংলাদেশের খবরের কাগজে এভাবে লেখা হয় না আজকাল। বড় পার্থক্য চোখে ধরা পড়ল গদ্যরীতিতে। বাংলাদেশে এজেন্সি সংবাদও সম্পাদকীয় নীতি অনুসারে কেটেকুটে বদলে ফেলে অনেকটা একই রকম করে ফেলা হয়। কাগজের অন্য সংবাদগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে।

ঠিক সময়ে তাকে নিতে এলেন হারুন ও মামুন সাহেব। যাঁরা দুজনই নেপালে প্রবাসী। বাংলাদেশের মানুষ। আরএফএল বা প্রাণ কোম্পানির নেপালের কান্ট্রি ডিরেক্টর হারুন ভাই। মামুন সাহেব ইঞ্জিনিয়ার, টেলিকম সেক্টরে কাজ করেন। নেপালে গত শতাব্দীর নবম দশকের মাঝামাঝি মানে পঁচানব্বই-ছিয়ানব্বই সাল থেকেই ইন্টারনেট সুবিধা ভালো। ছোটখাটো ছাপরা দোকানে তখন ট্যুরিস্টরা সাইবার ক্যাফে পেতেন। উনিশ শ আটানব্বই সালের আশপাশেই স্কাইপেতে কথা বলা যেত পথেঘাটেই, এতই সুলভ্য করা হয়। মূলত ট্যুরিস্ট আকর্ষণ ও তাদের নিজ দেশের সাথে সর্বাবস্থায় যোগাযোগ রক্ষা করতে পারার সুবিধা দিতে দুর্গম পাহাড়েও নেটওয়ার্ক বাড়ানো হয়। বাবুর জেনে অবাক হন, প্রাণের কনজুমার প্রোডাক্ট নেপাল, ভারত, ভুটানে ধুন্ধুমার চলছে। ভারতের বাজারে প্রবেশ ও প্রতিযোগিতা করে চলা এক বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। বাংলাদেশের প্রাণ আর নেপালে কর্মরত হারুন ভাইয়ের জন্য বুকভরা গর্ব হয় বাবুরের। তারা একটি টাটা সুমো জিপ নিয়ে এসেছেন বাবুরকে নিতে। আজ কাঠমান্ডুর আশপাশে ঘুরিয়ে দেখানো হবে তাকে।

গাড়িতে যেতে যেতে কথা হয় মামুন ও হারুন সাহেবের সাথে। তারা যাচ্ছেন বিশ কিলোমিটার দূরে সাঙ্গা নামের স্থানে। মহাদেবের বিশালকায় মূর্তির দর্শনে। এ পথে কাঠমান্ডু ছাড়ানোর পর শহরতলি থেকেই পাহাড়ের শুরু। পাহাড়ের গায়ে বিন্যস্তভাবে ফসলের চাষ হচ্ছে। আমাদের দেশের জুম চাষের মতো। একেক ফসল বা একই ফসলের বয়স এবং বৃদ্ধিভেদে ভিন্ন চেহারা, বর্ণ। তাই স্তরে স্তরে একেকটি রঙের আধিপত্য। শুধু চষে রাখা মাটির কারণেও একটি রঙের টায়্যার। বেশ চমৎকার দেখায় নানা বর্ণিল লেয়ারে শোভিত পাহাড়গুলো।

মামুন বললেন, ‘আমাদের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান কাঠমান্ডু এসেছিলেন। তাঁর জীবনীকার শরৎচন্দ্র দাস অতীশ দীপঙ্করের নেপালে অবস্থান নিয়ে বিশদে লিখেছেন। থামেলে বা থামেলের আশপাশে তিনি একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। নেপালে বৌদ্ধধর্ম চর্চায় অতীশ দীপঙ্কর রীতিগত পরিবর্তনও আনেন। বৌদ্ধধর্মের গুহ্যতত্ত্বের ওপরে নেপাল ও আশপাশের অঞ্চলে বিশেষ আগ্রহ ছিল না। অতীশ দীপঙ্কর নেপালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অনেক উপদেশ দেন বলে জানা যায়। এক বছরের মতো তিনি নেপালে ছিলেন। এ পথেই তিনি তিব্বত গমন করেন। নেপালে তাঁর অনুরোধে রাজা অনন্তকীর্তি থস বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। তিব্বতি ভাষায় লেখা ‘অতীশের জীবনী’র বাংলা অনুবাদে শরৎচন্দ্র দাস তাঁর তিব্বত যাত্রার সুন্দর বর্ণনা দিছেন। নেপালের পালপা থেকে যাত্রা করে তাঁর দলটি তিব্বতে প্রবেশ করে।’

এরপর প্রসঙ্গ বদলে আসে নেটওয়ার্কিং টেলিকম্যুনিকেশন খাতের কথা। তারা গাড়ির আড্ডায় তিনজনই একমত হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় সাহেবের উদ্যোগে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হচ্ছে। এরশাদের আমলে বিনামূল্যে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকে বাংলাদেশের নেটওয়ার্কিংয়ের যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা পুষিয়ে নেওয়া যাচ্ছে।

এরপর আলোচনা উঠল নেপালিদের নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে এলো নেপালে সেটেলার অন্যখানের মানুষজন। হারুন সাহেব বললেন, ‘নেপালিরা সর্বভুক। সবই খায়। এমনকি পশুর চামড়াও। তাই এখানে আমি আমিষ মোমো খাই না। তবে তারা খুবই শান্তিপ্রিয়, বিশ্বস্ত আর সৎ।’

বাবুর বললেন, ‘কিন্তু হারুন ভাই গত পরশু আমাদের দলের কয়েকজনের সাথে একটি পাবে খুব খারাপ একটা ঘটনা ঘটেছে।’

হারুন ভাই সাথে সাথেই বলে ওঠেন, ‘দেখেন খোঁজ নিয়ে এটা নেপালিদের ব্যাপার না। অনেক সেটেলার এখন কাঠমান্ডুতে নানা কারবারে জড়িয়ে পড়েছে।’

বাবুর জানতে চান, ‘বাংলাদেশিরাও কেমন সংখ্যায় আছেন?’

হারুন ভাই জানালেন, ‘বাংলাদেশের অনেক সরকারবিরোধী লোক গত নির্বাচনের আগে-পরে যারা জ্বালাও পোড়াও করে মামলা মোকদ্দমায় পড়েছে, বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে তাদের অনেকেই নেপালে পালিয়ে আসেন। এখানে ইসলামী দলেরও (!) অনেকের ইনভেস্টমেন্ট আছে আরও আগে থেকে। তারা হোটেল, রেস্টুরেন্ট চালায়। আছে কাশ্মীর বিহার- এসব এলাকার লোকও।’ কথায় কথায় তারা পৌঁছে গেলেন গন্তব্যে। দূর থেকেই মহাদেবের শিরস্ত্রাণ মতো পরা মূর্তির মাথা দৃশ্যমান হয়। নিকটে গেলে ভ্রম ভঙ্গ হয়। উন্মুক্ত বক্ষে রুদ্রাক্ষের মালা পরিহিত মাত্র। আবার মূলবেদি থেকে আশপাশের এলাকাটা পাখির চোখে দেখার মতো দেখা হয়। দেখা ও ছবি ক্যাপচারিং শেষে কাঠমান্ডুর দিকে ফেরা।

কাঠমান্ডুর মধ্যেই বোধনাথ বৌদ্ধস্তূপা দেখতে নামলেন তারা। বিরাট এলাকা নিয়ে স্তূপটি। এর চারদিকে বৃত্তাকারভাবে মার্কেট। মার্কেটের সামনের স্থানে স্থানে কবুতরের দল বসে। একটি দোকান থেকে কিছু কেনাও হলো। বাবুরকে একজন কিনে দিলেন হাড়ের চূর্ণ দিয়ে গড়া এক জোড়া ভেড়া। আরেকজন দিলেন বৌদ্ধমন্ত্রের একটি চক্র। কাঠের তৈরি, রঙিন। অনেকটা আমাদের বায়োস্কোপের মতো। চারদিকে ছোট ছোট জানালা করা। এটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মন্ত্র জপ করা হয়। জপযন্ত্র আরকি। আপাতভাবে খেলনা খেলনা দেখতে। এরপর তারা দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্যে গাড়িতে চড়ে বসলেন।

গাড়ি এসে থামল জে ডি এ স্টেনটন রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টটি যে ব্রিটিশ সাহেবের নামে, তিনি নেপালের বনজঙ্গল ঘুরে বিরল সব গাছের পরিচয় উদ্ধার করেছেন। বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেছেন। নেপালের জঙ্গল নিয়ে তার বইও আছে। রেস্টুরেন্টে বাবুরকে তারা দুজন জলকাপুর মাছ দিয়ে আপ্যায়নের ঘোষণা ও অর্ডার করলেন। এ মাছটি পাহাড়ের গায়ে তৈরি প্রাকৃতিক গর্তে জল জমে তৈরি জলাশয়ে হয়। সাধারণত ধরা হয় বর্শায় গেঁথে। পাহাড়ের ধু ধু বুকে এমন স্থানে মাছ কীভাবে আসে, তা অবশ্য বাবুরের মাথায় খেলল না। মাছটি আস্তই রেঁধে আনা হলো। খেতে মন্দ না। সম্ভবত আঁশহীন মাছ। পুরু চামড়ার। তারা লাঞ্চ করে বের হলেন কাঠমান্ডু ভ্যালি নামক শহরের উপকণ্ঠ থেকে পাশের পাহাড়ি এলাকায় বৌদ্ধ টোল দেখতে। এটা অবশ্য মামুন সাহেবের আগ্রহে। মামুন সাহেব বললেন, ‘কাঠমান্ডু একটা ভ্যালি ইট সেলফ। পাহাড়ের ওপরেই শহরটি দাঁড়িয়ে।’

যেতে যেতে পাহাড়ের ঢালে সারি সারি ঘরবাড়ি দেখা গেল। যেন পোস্টারে দেখা পাহাড়ি শহরের ছবি। পাহাড়ে উঠতে উঠতে দেখা হলো অনেক টোলের শিক্ষার্থীদের সাথে। নালক-প্রতিম বালকেরা দলবদ্ধভাবে এক লাইনে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তায়। রাস্তা বেঁকে উঠেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। নিচে লোকালয়, গাছপালা, অপেক্ষাকৃত ছোটাকৃতির পাহাড়। বিকেলের শেষে ধরে আসা সূর্য, একটা ধোঁয়াটে আবেশ চারপাশে। গাড়িতে বাজছে বৌদ্ধধর্মীয় সংগীতের সুর। কিছু মুহূর্তের জন্য যা সকলকে নিয়ে গেল অন্য রকম একটি শুদ্ধাচার ও ভাবনার জগতে।

ফেরার সময়ে একটি হালকা খাবারের রেস্তোরাঁয় তারা গেলেন। এখানে আগেকার দিনের দোকানে ক্যাশ বাক্স সামনে রেখে বসার মতো হাঁটু গেড়ে বসার ব্যবস্থা। ক্যাশ বাক্সের মতো টেবিলে খাবার পরিবেশিত হয়। এ এক অভিনব অভিজ্ঞতা বাবুরের জন্য। বাবুর রেস্তোরাঁটির ওয়াশরুমে গেছিলেন। পানির সমস্যা। বুঝতে পারলেন বালতিতে পানি ধরে রাখা দেখে। লো ডাউন শূন্য। একই কারণে খালি হলেও ভর্তি হয় না। পাহাড়ি দেশে পানির স্তর থাকে ভূগর্ভের বেশি তলদেশে। দিন দিন তা আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। ওয়াশরুম থেকে ফিরে হারুন সাহেবদের ব্যাপারটি বললে আরও জানতে পারলেন, এ দেশে গোসল-টোসলের বালাই একটু কম। পানির সমস্যার জন্য এমনটা হয়ে গেছে। ভালো রেস্তোরাঁর হাত ধোয়ার স্থানেও পানি থাকে না সময় সময়। তারা ভালোই প্রসাধনী, সুগন্ধি ব্যবহার করেন নিয়মিত গোসলের বিকল্প হিসেবে। আজকের মতো এখান থেকেই ঘোরাঘুরি পর্ব শেষ করে বাবুরকে হোটেলে নামালেন তারা। বিদায়ের আগে বলে রাখলেন, কাল অফিস থাকায় দুজনের কেউই আসতে পারবেন না। ড্রাইভারকে বুঝিয়ে গাড়ি পাঠাবেন। কাল ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় দেখাতে নিয়ে যাবেন তাকে।

আরও কিছু সময় মামুন সাহেবদের সাথে থেকে যাবার সুযোগ ছিল অন্যভাবে বাবুরের। কিন্তু তিনি সে পথে গেলেন না। বাবুরকে বলেছিলেন তারা। মন আঁকু-পাঁকু করলেও সংস্কারবোধের বাধায় ‘না’ বলে দেন বাবুর। মামুন সাহেবেরা তাকে নেপালি অ্যারোমা ম্যাসাজে নিতে চে’ছিলেন। বাবুরের ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া হওয়ার পর থেকে গিঁটে গিঁটে যে ব্যথা, তা সারিয়ে দিতে মোক্ষম ছিল অফারটি। তবু কী মনে করে আর গেলেন না।

রাতে ডিনারে আগের দিনের মতো জড়ো হয়ে ঠিক করলেন সকলে মিলে পরের তিন দিনের প্ল্যান। কাল যারা যারা নাগরকোট যাবেন, তাদের টাকা নিয়ে নিচ্ছিলেন তানজিদ। বাবুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন বলে আর নাগরকোট যাচ্ছেন না। পরদিন থামেলেই ঘোরাঘুরি হবে। তার পরদিন দেশে ফেরা। দেশে ফেরার আগে নেপালে শেষ দিনে থানায় একবার যেতে হবে। ঠিক হলো সকলে মিলেই পরশুদিন সকাল সকাল স্থানীয় থানায় যাবেন। বাকি সময়টা থামেলেই ঘোরা, শেষ কেনাকাটা, গোছগাছ- এসবেই ব্যয় হবে।

পরদিন সকালে বাবুরকে নিতে গাড়ি এলো। গাড়িটি তেমন জুতসই নয়। ছোট গাড়ি। পুরোনো না হলেও অধিক ব্যবহার কিংবা মেইনটেন্যান্সের অভাবে লক্কড়ঝক্কড় মার্কা। কিছু পথ গিয়ে বাবুরের মনে হলো, এতে করে দূর পথ যাওয়া যাবে না। একে তো তাপানুকূল নয়, ভাঙা রাস্তায় ধুলার প্রকোপে জানালার কাচ তুলে ভেতরে সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পাহাড়ি রাস্তায় এ গাড়িতে নির্ভর করাও ঠিক হবে না। এসব কারণে অল্প পথ গিয়েই ফিরে এলেন বাবুর। কাঠমান্ডুতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য একদিন জোড় নম্বরপ্লেটের আরেক দিন বেজোড় গাড়ি চলে। গতকালের গাড়িটি আজ রাস্তায় চলতে পারবে না। অগত্যা হোটেলে নেমে থাকলেন বাবুর। আজ আর তেমন ব্যস্ততা নেই। নাগরকোট পার্টি বেরিয়ে গেছে। নিজের সাথে নিজে সময় কাটানো যাবে আজ। নিজের সাথে নিজে আন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগে জড়িয়ে সময় কাটানোর একটা আলাদা আবেশময়তা আছে। অনেক চিন্তাভাবনা আসে মনে, বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করা যায়, কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়, পয়মন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, আত্মোপলব্ধির সুযোগ হয়। হয় নির্ভার হওয়া। নিজের মতো ভাবনাচিন্তা, কথা বলা নিজের সাথে নিজের, আয়নার সামনে দাঁড়ানো এসব করে কাটল কিছু সময়। সোশ্যাল মিডিয়ার আধিপত্যবাদের এ সময়ে একদম একা থাকা, নিজের সাথে খুব বেশি সময় নিয়েÑ সম্ভব হয় না। বাবুরেরও হলো না। বাবুর ফেসবুক দেখলেন কতক্ষণ, হোয়াটসঅ্যাপে একে-ওকে ধরতে চেষ্টা করলেন। একে না পেয়ে তাকে ফোন করলেন। তাকে না পেয়ে অন্যকে। তারপর আরেকজনকে। একজনের সাথে কথা বলতে বলতে একে একে অন্যরা কলব্যাক করতে শুরু করলেন। এতে করে অপরিকল্পিতভাবে অনেকের সাথে কথা বলা হয়ে গেল। অনেকটা সময় নিয়ে নিল প্রস্তুতিহীন ফোনকলগুলো। এরপর লাঞ্চে বের হলেন। একটি রেস্টুরেন্ট দেখে রেখেছিলেন কোনো এক বেলার জন্য। আজ চলে গেলেন।

রিসেপশনের পেছনে একটা ময়ূরের কয়েক ফুট লম্বা একটি উডওয়ার্ক। দেখেই মনে হলো এটা যদি দেশে নিয়ে ড্রয়িং রুমে লাগানো যেত! একটি পিলারে সামনে প্রমাণ আকৃতির পদ্মাসন বুদ্ধ, প্রস্তর নির্মিত। ঠিক সামনে একটি বড় মালসায় জলে ভাসমান পাপড়ি, পত্র আর মাঝখানে একটি জলজ ফুল ভাসিয়ে রাখা। ছিমছাম পরিবেশে মনটা আরও ভালো বোধ হলো। আজ একটি নিরামিষ খালি অর্ডার করলেন। পাঁপড়, আচার, টক দইসহকারে ছোট ছোট খোপ করা থালায় ভাত, ভাজি, তরকারি, বহু মিশালি ডাল দিয়ে পরিবেশন করা হয়। বাবুর নাগরকোট যাওয়া বন্ধুদের ফোন করে একটি খবর নিলেন। কথা শুনে বুঝলেন, সন্ধ্যার আগে আগে সব ঠিক থাকলে তাদের ফেরা হবে। গতবার নাগরকোটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। নাগরকোট থেকে ফিরতি পথে ভক্তপুরে থেমেছিল গাড়ি। সেখানে চত্বরের মধ্যে সাজিয়ে বসা পসরার মধ্যে একটি ওয়াল হ্যাঙ্গিং পিতলের নির্মিত পাহাড়ি ভেড়ার মাথা পেয়েছিলেন। মাথাটি সেন্টার টেবিল বা শোকেসে শুইয়ে রেখে দিলেও ভালো দেখাত। কিন্তু ছয় হাজার নেপালি রুপি বা পঞ্চাশ ডলার দিতে হতো। বাবুরের ছিল না। একজনের কাছে চাইলেন, তেমন সাড়া দিলেন না। পরে অবশ্য তিনি উল্টো বলেছিলেন, ‘কই, আপনি তো পঞ্চাশ ডলার নিলেন না।’ যাহোক, বাবুরের কপাল মন্দ। দেশে ফিরতি সময়ে তিনি লম্বাটে ওয়ালেটের এক পকেটে মিহিভাবে লেগে থাকা পঞ্চাশ ডলারই পেয়ে গেলেন, যা তার ভক্তপুরে প্রয়োজন ছিল। তাড়াতাড়ি করে বাংলাদেশ বিমানের ম্যানেজারকে ধরিয়ে বললেন প্রাণের কান্ট্রি ডিরেক্টর হারুন ভাইকে দিয়ে দিতে। হারুন ভাই-ই কথায় কথায় বলেছিলেন, তিনি আর বাংলাদেশ বিমানের নেপাল স্টেশনের ম্যানেজার একই ফ্ল্যাটমেট। হারুন ভাইকে মোবাইলে বুঝিয়ে দিলেন প্লেনে ওঠার আগেই ভক্তপুরের কোথায় আর্টিফ্যাক্টটা পাবেন। যা হয় আরকি। হারুন ভাই গেছিলেনও ভক্তপুর। দোকানে দোকানে খুঁজলেন। কিন্তু চত্বরে বসা ক্ষুদ্র দোকানিদের কাছে যাননি। বাবুর বলে দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় দোকানির কাছে যেতে। তিনি দ্বিতীয় দোকানসহ সব দোকানেই গেলেন। কিন্তু আমাদের ফুটপাতের বা মেলার বসার মতো যে অংশটা ছিল খোলা স্থানে, সেখানেই গেলেন না। এরপর অনেকভাবে সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন, অনেককেই বলেছেন, যারা পরের কয়েক বছরে নেপালে এসেছেন। কিন্তু আর পাননি ওই জিনিস।

ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে এলো বাবুরের ভারাক্রান্ত বুক থেকে। সত্যি বলতে কি, কেনাকাটা নিয়ে বাবুরের ‘মেয়েলি স্বভাব’ আছে। সব ডিজাইনের যত আছে, সব কয়টি তার লাগবে। কোনো কিছু না কিনে বাজার ছেড়ে আসলে তার জন্য কষ্ট পাওয়া। ছটফট করা পর্যন্ত। ভারাক্রান্ত মনেও পেট ভরে ও পরিতৃপ্তিসহকারে খেলেন। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে এলেন। হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিলেন। ধারণার আগেই নাগরকোট থেকে ফিরে এলেন অন্যরা। তারা ঠিকঠাক হয়ে সন্ধ্যায় থামেল ঘুরতে বের হলেন।

আজকেই প্রথম থামেল ঘুরতে বের হলেন, সকলে একসাথে, দল বেঁধে। নিজের এলাকার বাইরে একা একা ঘুরতে একটা কেমন যেন ভয়, শঙ্কা, দুর্ভাবনাচ্ছন্নতা মতো হয়। যতই নিজের এলাকার সদৃশ হোক না কেন। দলে সেই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিটা থাকে না। ঠকার, পথ হারিয়ে ফেলার, পকেট মার হওয়ার বা মালামাল খোয়ানোর। সকলে তারা ফুরফুরে মেজাজে, হৃষ্ট চিত্তে আজ থামেলের রাস্তায়। থামেলের হাঁটাচলার রাস্তায় বেশ কয়েকটি মন্দির আছে। মন্দিরের পেভমেন্টে নকশাদার টাইলস। ইটে হনুমানজির মুখাবয়বখচিত। দেয়ালে আরও নকশা। একটি মন্দিরের ছাদসংলগ্ন চারদিকে খোদাই করা রামের লঙ্কা জয়ের পরিক্রমা। এসব দেখে হাঁটতে হাঁটতে দলটি ছোট ছোট ভাগে আগেপিছে হয়ে গেল। বাবুরের পাশেই বাংলাদেশ ডেলিগেটের একজন নীল দত্ত হাঁটতে হাঁটতে এটা-ওটা আলাপ করতে লাগলেন। বাবুরকে নীলদত্ত কথায় কথায় বললেন,

– আপনার ওইভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা ঠিক হয়নি। আপনার জায়গা থেকে এমনটা করা মানানসই নয়। দেশে বলি বলি করে বলিনি। শেষ পর্যন্ত বিদেশের মাটিতেই বলতে পারলাম।

– না লিখে কী করতাম। এত চামচামি করবে, এত অশল্লী (অশৈল) করবে, চুপ করে থাকব?

– তবুও। এটা কেমন কথা?

– শোনেন, পৃথিবীর দেশে দেশে একস্ট্রা জুডিশিয়াল কিলিং চলে। কোনো আইন করে সামলানো যায় না। কখনো কখনো কটু কথা না বলে এসব অসহ্য ইতরকে থামানো যায় না।

– আপনি যা-ই বলেন। মানছি কঠোর হাতে দমন করতে হয় কখনো কখনো। তবু আপনি বলে কথা।

এরপর তারা দাঁড়ালেন একটি রাস্তায়। যার দুধারে গোল গলা টি-শার্টের দোকান। এমব্রয়ডারি করে নানা নকশা ফুটিয়ে তোলা। এগুলো আলাদাভাবে তৈরি করে গেঞ্জির বুকে সেলাই করে দেওয়া হয়। আর কিছু গেঞ্জি প্রিন্ট করা। তবে সুতার কাজেরগুলোর দাম বেশি। তারা গেঞ্জি দেখলেন, কিনলেন।

এক স্থানে এক বিক্রেতা একটি ধাতুর বাটিতে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে অদ্ভুত দ্যোতনা তৈরি করছেন। সবাই জড়ো হয়ে দেখতে লাগলেন। ভারী একটি বাটি হাতের তালু খুলে তার ওপর রেখে আঘাত করে যে অনুরণন হয়, সেটিই আবার হাতুড়ির প্রান্ত দিয়ে বাটিটিকে ছুঁয়ে কয়েক গুণ করে তুলছেন। তাতে অদ্ভুত তীক্ষè আবার জোরালো আওয়াজ হচ্ছে। এটা বৌদ্ধধর্মীয় আচারেরই অংশ। একটি সরল যন্ত্রের কৌশলী ব্যবহার। ফাঁকা স্থানে হলে আরও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতো। এসবে সন্ধ্যাটি পার হলো।

পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই আলোচনা করে নিলেন থানায় কী কথা হবে। যদিও সবার মনোযোগ নানা দিকে। টিভিতে একটি পরিস্রুত পানীয় জলের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছিল। দুটি কন্যাশিশু হিমালয় থেকে নেমে আসা হিমবাহ নিঃসৃত পানি পদ্মপাতায় ধরে নিয়ে এগিয়ে আসছে। সে পানিই এর পরপরই পদ্মফুলের লোগো লাগানো বোতলে, বোতলজাত করে টিভি স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে। কেউ কেউ সেটি মনোযোগ নিয়ে দেখছেন। থানায় যাওয়ার আলোচনাও শুনছেন একই সাথে। আর কেউ কেউ আরও নিবিষ্টভাবে দেখছেন হোটেল মালিকের মে’কে। তিনি অবশ্য বিজ্ঞাপনের কন্যাদ্বয়ের কাছাকাছি বয়সেরও নন, বিবাহযোগ্যা। সিঁথিতে সিঁদুর নেই বলে বিবাহিত নন ধারণা করা যায়। উচ্চতা ভালো। সাদা জমিনের শাড়ি পরিহিতা। সদা হাস্য লম্বাটে চেহারার গড়ন, গৌর বর্ণ, আকর্ষণীয়া। চা-কফির সার্ভিস টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ন করছেন। দলের অনেকেই ঘুরেফিরে হয়তো বেশিবারই চা-কফি যে যা পছন্দ করেন, রিফিল করতে যাচ্ছেন কাপ হাতে। তিনি যে হোটেল মালিকের মে’, তা বাবুরকে জানিয়েছে তানজিদই। সন্ধ্যার পর ক্যাশেও বসেন। দুদিন তানজিদ কথাও বলেছেন। তাদের ব্রেকফাস্ট দীর্ঘায়িত হলেও একসময় শেষ হলো। তারা বেরিয়ে পড়লেন থানার উদ্দেশে।

থানা কাছেই। হেঁটেই যাওয়া যাবে। সবার পকেটের অবস্থাই খারাপ। বেহিসেবি খরচে নুইয়ে পড়েছে পকেট। তাই আলোচনার বিষয় হয়ে গেল, খোয়া যাওয়া টাকা আজ উদ্ধার হলে কী কী করা হবে। এ নিয়ে কথা বলতে বলতে দরবার মার্গ এলাকায় থানায় পৌঁছে গেলেন সকলে। থানাটি আধুনিক ভবনে, ছিমছাম, পাবলিক সার্ভিস দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ভালো অবস্থাই পাওয়া গেল। ডিউটি অফিসারের সাথে কথা বললে নিয়ে গেলেন বড় কর্মকর্তার কক্ষে। তিনিও ভালোভাবেই নিলেন সকলকে। সব শুনলেন। রোহান তার কাছে থাকা বিলটি দেখালেন। অভিযোগ ছিল, ‘ভুয়া বিল ধরিয়ে জোরপূর্বক তারচে’ বেশি টাকা, প্রকৃতপক্ষে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া। একজনকে বল প্রয়োগ, মারধর, কিছুটা আহত করা।’ সিগারেটের ছ্যাঁকায় কালো ছোপ ছোপ দাগগুলোও রোহান অফিসারকে দেখালেন। সেদিনের সেই গ্রেফতার হওয়া পাবের কর্মচারী ওই থানায়ই আছেন। মামলার তারিখ হলে কোর্টে নেওয়া হবে। মামলা দায়ের হয়েছে। বাংলাদেশের থেকে নিয়মটা এখানে ভিন্ন দেখা গেল। অফিসার তার সহকারীকে বললেন পাবের ম্যানেজারকে ডেকে পাঠাতে। বাবুর, তানজিদ, রোহান, রেহান, নীল দত্ত, অনিমেষ, তাইমুর, সবুজ- সবাইকে বসতে বললেন অফিসার। চা পান করালেন। এর মধ্যে চলে এলেন ম্যানেজার।

তারা প্রস্তাব দিলেন, অভিযোগটি তুলে নিয়ে তার কর্মচারীকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আর প্রকৃত বিলের বাইরে যার যা কিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তা বিবাদীপক্ষ ফেরত দেবেন। কাল যেহেতু তারা বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। তাই মামলা তুলে খোয়া যাওয়া ডলার, ঘড়ি, আংটি, চেইন, মোবাইল…তালিকা অনুসারে ফেরত নিয়ে যেতে চান।

কিন্তু নেপালের আইন একটু অন্য রকম। আজ থানায় অভিযোগ নেই লিখে দিলেও মামলা উঠবে কোর্টে তারিখ অনুসারে যেদিন, সেদিনই তা প্রত্যাহার হবে। ঐদিন থানা-হাজত থেকে কোর্টে নেওয়া হবে পাব-এর কর্মচারীকে অনেক ক্ষেত্রে কোর্টের আদেশ অন্য রকমও হয়। জনস্বার্থে বা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা চালানোর আদেশ আসতে পারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। আসতে পারে তদন্তের আদেশ। তাই ম্যানেজার বললেন, কোর্টে মিটলেই তারা এগুলো বাংলাদেশ দূতাবাসে জমা দেবেন। দীর্ঘসূত্রতার ঘেরাটোপে সহজ নিষ্পত্তি পরাহত হলো। রোহান ছিলেন মামলার বাদী। অন্যরাও একমত হয়ে তাকে মামলা তুলতে বারণ করেন। রোহানের এসব শুনে সেই একই মত। কাল চলে যাবেন নেপাল ছেড়ে সকলে। একটি মামলা রেখেই যেতে হবে তাদের। যে মামলার রায় পক্ষে-বিপক্ষে যা-ই হোক, কোনো অর্থ তৈরি করবে না তাদের কাছে। কোনো খোঁজ রাখা হবে না, তারিখ পড়লেও জানাই হবে না।

তারা বেরিয়ে এলেন। দরবার মার্গে থানার ঠিক উল্টো দিকের মার্কেটে বড় একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। রালফ লরেন। প্রচলিত নাম পোলো। খুবই জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। আরও অনেক ব্র্যান্ডের দোকান। থানার লাইনেও আরেকটি মার্কেট। এসব দোকানে বিদেশি ব্র্যান্ড পণ্য পাওয়া যায়। তবে কোনো বহুতল ভবন চোখে পড়ল না। তারা চলে এলেন থানার অদূরে রাজবাড়ির গেটে। টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। হিসাব করে দেখা গেল টাকায় পোষাবে না। অগত্যা থামেলমুখী হলেন। থামেল এরিয়ায় ঢুকে যে যার মতো বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরতে লাগলেন। বাবুর গেলেন মোড়ের ওপরে একটি দোকানে। সবাই ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরছে। টাকাপয়সা ফেরত পাওয়া গেলে আজকের দিনটি সবারই ভাগযোগ করে অন্য রকম কাটত। তা আর হলো না। দু-তিনজন চলে গেল দরবার স্কয়ার দেখবে বলে। থামেলেরই অদূরে অনেক রাজবাড়ির সমন্বয়ে এই দরবার ক্ষেত্র। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি হয় দরবার ক্ষেত্রের বেশ কিছু স্থাপনার। বাবুর ঠিক তার আগের বছর ২০১৪ সালে গিয়েছিল সেখানে। মনের ভেতর যে ছবিটি আছে, সেটা নিয়েই বাবুর থাকতে চান। ভগ্নপ্রায় ভবন আর হতে পারে নিশ্চিহ্ন কিংবা ধ্বংসস্তূপ দেখে মন খারাপ করতে সায় পেলেন না মন থেকে। তাই তিনি আর গেলেন না, অনেক সাধাসাধি সত্ত্বেও অন্যদের সাথে। মোড়ের এম. হ্যান্ডিক্রাফট নেপালের তিনতলা ভবনের সামনে বাবুরকে ছেড়ে চলে গেলেন অন্যরা। বাবুর ঢুকে পড়লেন।

সিঁড়িতে বিক্রির অনেক ওয়াল হ্যাঙ্গিং। দুই তলায় হরেক রকমের ধাতব গৃহসজ্জার সামগ্রী। তিনতলায় কাঠের ও মন্ডের সৌন্দর্যবর্ধক গৃহসামগ্রী। বাবুর খুঁজছেন প্রথমবার রেখে যাওয়া সেই ভেড়ার মাথাটির কোনো কপি। পরে আরও জেনেছেন ভেড়ার মাথাটি সুখ-সমৃদ্ধির প্রতীক মনে করে অনেকে ঘরে রাখেন। এর সাথে রাশিচক্রের মেষরাশি চিহ্নের সাদৃশ্য আছে। খুঁজতে খুঁজতে নিচতলায় গোডাউনে আসলেন স্বত্বাধিকারী কৃষ্ণগিরিসহ। কিন্তু পাওয়া গেল না। নিজের টাকাপয়সা খরচ হয়ে গেছে সব। মেষটি সংগ্রহের অভিপ্রায়ে এক শ ডলার অনিমেষ থেকে ধার পেয়েছেন। ধার পেতে ভালোই লেগেছিল বাবুরের। একে তো টাকা ছাড়া এতিম এতিম লাগছিল বিদেশ-বিভূঁইয়ে অবস্থায়। তা ছাড়া মানুষ সেধে ধার দেয় নির্ভর করতে পারলেই। একটা গুডউইল স্থায়ী হলেই বন্ধু সমাজে। না হলে অজুহাত বলে এড়িয়ে যায়। সেখানে যেচে ধার! ভাবাই যায় না। ভালো লাগে ব্যাপারটা বাবুরের। তবু মেষ তো মিলল না। পরে রফা হলো হোয়াটসঅ্যাপে বাবুর জানতে পারবেন, যদি সে রকম কিছু হাতে আসে কৃষ্ণগিরিবাবুর। বাবুরের বর্ণনার কাছাকাছি আরকি। বাবুরকে দোকানের বিজনেস কার্ড দিলেন। বাবুর বেরিয়ে এলেন। তবে পুরোটা আশাহত হলেন না। এত ভালোবাসা তখন মেষটির মস্তকের ওয়াল হ্যাঙ্গিংয়ের জন্য উৎসারিত হলো, তিনি ভাবলেন যেদিনই পাওয়া যাবে সেদিনই কোনো না কোনোভাবে তিনি সংগ্রহ করবেন দেশে থেকেই। হয় কাউকে বলবেন নেপালের, মামুন সাহেব, হারুন সাহেব হতে পারেন। দেশ থেকে কেউ সেই মুহূর্তে নেপালে আসছেন এমন কাউকে পেলে অথবা টাকা পাঠিয়ে ডিএইচএলে পার্সেল সার্ভিসে। কিন্তু করবেনই। এ তিনতলা নিয়ে চালানো কুটিরশিল্পের দোকানটিতে বাবুর ২০১৪ সালেও এসেছিলেন। নভেম্বর মাসে। তারচে’ এবার দরদাম কম পেলেন। মনে হলো, এখন ট্যুরিস্ট সিজন নয়। তাই দামে একটু পড়তি ভাব। তবে সেবারেও এবং এবারেও যেটি অভিন্ন ভাবনা হলো তার, তা হলো রাজধানীর বুকে হট ট্যুরিস্ট স্পটে তিনতলার এক ভবনজুড়ে কুটিরশিল্পের হোলসেল ওয়্যার হাউজ। ভাবাই যায় না।

ওই দিন সন্ধ্যায় বাবুররা আবার দল বেঁধে বের হলেন। আজ থামেলে তাদের শেষ সন্ধ্যা। তাদের দুপুরে খাওয়াটি মানসম্পন্ন হয়নি। টাকায় টান পড়েছে সবারই। বাইরে বেড়িয়েই কলার কেক খেল সকলে। নেপালের পাহাড়ের ঢালে প্রচুর কলা হয়। সেটা দিয়েই সহজপ্রাপ্যতার জন্য কেক তৈরি জনপ্রিয় হয়েছে হয়তো। এটা সস্তাও, পেটেও ধরা থাকে। এই বোধে তারা পেটপুরে বানানা কেক খেলেন। আর নেপালি কফি ডিসপো গ্লাসে ধরে হাঁটাহাঁটি। বাবুর আর যা অর্থাভাবে কিনতে পারলেন না, যদিও মন চাইছিল, সেগুলোর ছবি তুললেন মোবাইলে। একশ ডলার ভাঙিয়েছেন ইতোমধ্যে। তাতেও ভাঙনের সুর ধরেছে। দুপুরে খেলেন, এখন সবাইকে বানানা কেক, কফি খাওয়ালেন। রাতের খাবার, গাড়িভাড়া এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে, এয়ারপোর্টে যদি কিছু লাগে এবং আনুষাঙ্গিকের ব্যাকআপ রাখলেন। বিশ ডলার সমপরিমাণ নেপালি টাকা একজনকে ধারও দিতে হয়েছে। ধারের টাকা থেকে ধার, ভেবেই নিজের মনে হাসলেন বাবুর। শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় তারা থামেলের এক প্রান্তের শেষ দিকে মোস্তফা ভাইয়ের দোকানের সামনে এলেন। পাবে নিঃস্ব রোহান কিছু কিনতে চান পরিবারের জন্য। অ্যারোমার দোকানের পাশের মোস্তফা ভাইয়ের দোকান বাংলাদেশের পর্যটকদের কাছে বেশ পরিচিত। তার ব্যবহার, সেলসম্যানশিপ, খাতির যতœ, মার্জিনাল লাভে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বাবুর আগেও এসেছেন। তাকে ভালো চেনেন মোস্তফা ভাই। রেহান কিনতে চান, মোস্তফা ভাই বেচতে চান, টাকা না থাকা সমস্যা কিছু হলো না। হারুন সাহেবের চেনা লোক হওয়ায় বাবুরের জামিনে সকলেই কিছু না কিছু নিলেন। বিল এলো দশ হাজার নেপালি, তখনকার একশ ডলার সমপরিমাণ। হারুন ভাইকে বিষয়টি ফোনে জানালে তিনি বললেন, কোনো ব্যাপার না, কিছু চিন্তা করার দরকার নেই, তিনি দিয়ে দেবেন। এরপর তো আর কথা থাকে না। গুডউইলের আকাক্সক্ষী বাবুর দেশে এসেই একবার হারুন ভাইকে টাকাটা দিতে চে’ছিলেন। হারুন ভাই জোর দিয়ে না করে দেন। বলেছিলেন, আগামী সপ্তাহে থামেলে গেলেই মিটিয়ে আসবেন। এরপর আর বলা যায়? জিজ্ঞাসা করা যায় আর কিছু? সৌজন্যের ভঙ্গ হয় বলে আর কিছু জানতে পারেননি বাবুর। এরপর অনেক দিন গড়িয়েছিল। তারপর ২০২০ থেকে কোভিড নাইনটিন মহামারির প্রাদুর্ভাব। তখন লকডাউনে বাবুরের মনে বিশেষভাবে আসে মোস্তফা ভাইয়ের দোকানে বকেয়ার কথা। করোনাকালে পর্যটকশূন্য থামেলে হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। মোস্তফা ভাইয়ের অবস্থা খুবই সঙ্গিন বলে আশঙ্কা হয় বাবুরের। তিনি ঠিক করেন, হারুন সাহেব বকেয়া মেটান বা না মেটান, বাবুর একশ ডলার পাঠাবেন কোনো না কোনোভাবে মোস্তফা ভাইকে। মানবিকতার কোনো সীমানা তো থাকতে পারে না। বাবুর করোনার গৃহবন্দি দশায়, মোস্তফা ভাই বিদেশি লোকদের এত টাকা বকেয়া দেওয়া যে নির্বুদ্ধিতা হয়নি ভেবে যে উৎফুল্লটা হবেন, সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটি মনশ্চক্ষুতে দেখতে পেয়েছেন অনেকবার। সেটা অবশ্য অনেক পরের ঘটনাক্রম।

কাশ্মীরি কিছু জিনিস কেনাকাটার ফাঁকে চোখে পড়েছিল বাবুরদের ম- দিয়ে তৈরি ছোট ছোট বাক্স। এর গায়ে প্রশংসনীয়ভাবে তুলির টানে টানে মোগল সম্রাটদের যুদ্ধ, শিকার, মজলিস, বাইজি নাচ, সাকির সংগীত পরিবেশনা, ফুল কিংবা ধূসর মরুর প্রাকৃতিক দৃশ্য, উটের সারি বেঁধে চলাচল, পাহাড়-পর্বতময় অঞ্চল ইত্যাদি আঁকা। জুয়েলারি, ঘড়ি, কলম রাখার জন্য এর ব্যবহার হয়। খুব সাধারণ উপকরণ ও কৌশলে এগুলো তৈরি। তবে শিল্পীর কাজ খুব নিখুঁত, মনে ধরার মতো।

এরপরও কেনাকাটা চলল। কিছু ফ্রিজ ম্যাগনেট কেনার ইচ্ছা ছিল রেহানের। কিন্তু হলো না। এভারেস্ট পর্বতারোহী, নেপালি ত্রিকোণ পতাকা, বুদ্ধস্তূপা, বুদ্ধ প্রভৃতির থ্রিডি ফ্রিজ ম্যাগনেট শেষ দিন কিনে নেবেন এমনই ভেবে রেখেছিলেন রেহান। এক দোকানে এক হাজার রুপি দিয়ে নয়শ ফেরত চাইলে দোকানি বললেন রেহান দিয়েছেনই একশ রুপি। অনেকক্ষণ বচসা করে শেষে রেহানদেরই হার হলো।
এবার থামেলে যেন রেহান, রোহান দুজনেরই কুফা লেগেছে। বাবুর হোটেলে ফেরার আগে আগে একটা মানসিক দ্বন্দ্বে পড়লেন। যে চমরি ষাঁড়টি কিনেছেন, তার বদলে আজকে দেখা কাঠের গ-ারটি কিনলে কি ভালো করতেন কি না? কাঠের রঙের একটি গ-ার পিঠে চট দিয়ে সৌন্দর্যায়ন করা। চটের চারদিকে সোনালি তলোয়ারে ঢালের মতো বড় মাথার পিন মারা। পিনিংয়ের হেড সোনালি। সব মিলিয়ে দেখতে খুবই মনকাড়া। এই দোলাচল নিয়েই হোটেলে ফিরলেন বাবুর। সকালে অ্যালার্ম দিয়ে উঠে সময় ধরে তৈরি হয়ে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়াই বিধেয় হবে। সবাই তা মেনে নিজ নিজ ঘরে চলে এলেন।

সকালে ঘড়ি ধরে তৈরি হতে হলো। বাবুর বিছানা ছাড়ার পর প্রথম এক ঘণ্টা এভাবে বিন্যাস করলেন: প্রথম বিশ মিনিটে ফ্রেশ হবেন, দশ মিনিটে দাঁত ব্রাশ ও সেভ, দশ মিনিটে গোসল, দশ মিনিটে রেডি হওয়া, বাকি দশ মিনিটে স্যুটকেস, হ্যান্ডব্যাগে বদলে ফেলা কাপড়, সেভিং কিট, মোবাইল চার্জার তোলা, ভালো করে লক করা ইত্যাদি করে একেবারে বেরিয়ে ব্রেকফাস্টে যাবেন। এরপর চেকআউট হয়ে অন্যদের সমভিব্যাহারে ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্টে যাবেন।

কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ১৯৯৯ সালে একটি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। শেষমেশ সেই ছিনতাইয়ের জেরে তিনজন দুর্র্ধর্ষ জঙ্গিকে ভারতের জেল থেকে ছাড়িয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এরপর থেকে এখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। নিখুঁত তল্লাশি নেওয়া হয় যাত্রীদের। একাধিকবার করে। তল্লাশির কাজটিও বেশ ঝামেলাপূর্ণ।

চেক-ইন লাগেজ দেওয়ার লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় বাবুর দলের অন্যদের এক এক করে একজন সাড়ে ছয় ফুট দীর্ঘকায় লোকের সাথে ছবি তুলতে দেখলেন। তিনিও গিয়ে একটি ¯œ্যাপ তুললেন। তাড়াহুড়ায় নিজের মোবাইলের পরিবর্তে তোলা হলো সবুজের মোবাইলে। তিনিই সকলের ছবি তুলে দিচ্ছিলেন। সবুজকে বাবুর মনে মনে পছন্দ করেন না। আনপার্টিকুলার বলেই জানেন। এ জন্য চিন্তা হলো কিছুটা, ছবিটা শেষ পর্যন্ত ফরোয়ার্ড করবেন কি না তাকে।

ডিউটি ফ্রিতে সময় কাটাতে কিছু সময় ঘোরাফেরা করলেন। কর্পদকশূন্যভাবে দোকানে দোকানে ঘোরার মানে হয় না। অল্প কটিই দোকান। এর মধ্যে একটি দোকান ব্র্যান্ডশপ নামের। চামড়ার পণ্য বিক্রি হয়। সেখানে টুলড লেদারের ব্যাগ দেখলেন। নিজের জন্য নিতে চাইলেন, দেখেই পছন্দ হলো। অফিস ব্যাগ তাতে টুলড করে নকশা করা। লেদারে এমবুশ আর জালি কাটা করা আরকি। শ ডলার বা আশপাশে দাম। নিজের বা কারও কাছেই নেই সে টাকা। সবাই পকেট ঝাড়া দিলেও হবে না। অগত্যা অনবোর্ড হওয়ার পূর্বাপেক্ষা হলরুমে প্রবেশের জন্য নিরাপত্তা তল্লাশি সেরে নিলেন। হল রুমে বসে একটু নির্ভার লাগল। এরপর শুধু প্লেনে চড়া। আর ঝামেলা নেই। থিতু হয়ে নিয়ে মনে হলো, ব্যাগটার একটা ছবি তুলে আনা যেত। তখন মনে পড়ল তানজিদকে। ও এখনো ডিউটি ফ্রিতে ঘোরাঘুরি করছে। তাকে ফোন করে মোটামুটি বোঝালেন। কিন্তু যা হয় আরকি, তানজিদ সেটা করেই উঠতে পারলেন না। এই প্রথম নেপালের মাটিতে তানজিদের ওপর মেজাজ খারাপ হলো বাবুরের। এরপরও তিনি বহুজনকে এর ফরমাশ দিয়েছেন। ছবি তোলার না, কিনেই আনার। দুর্ভাগ্য হলো ব্র্যান্ডশপ দোকানটিই অল্প দিনের মধ্যে সমূলে উঠে গেছে।

অপেক্ষমাণ বাবুরের পাশে এসে বসলেন রোহান। রোহানের এবারকার নেপাল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। মনটা তার ভালো না সব মিলিয়ে। উন্নাসিকতাও আছে কিছুটা। একথা-সেকথায় তিনি কয়েকটি সিক্রেট বলে ফেললেন একে একে। এমনিতেই তিনি খোলামেলা, প্যাঁচবিবর্জিত মানুষ। রাখঢাক, শঠতা, নাটকবাজি তার ধাত নয়।

– আমাদের নেপালি রুপি আর ডলারই কেড়ে নিছিল ওরা। চেইন, আংটি, ঘড়ি, মোবাইল- এগুলো এর-ওর বুদ্ধিতে জুড়ে দেওয়া।

– আপনার তো অনেক চাপ গেল?

– না। আমি আমার মতো তবু ভালো থাকার চেষ্টা করছি। নাইট ক্লাবে পরিচয় হওয়া এক নেপালি তরুণীকে পরপর দুদিন আমার রুমে মিট করেছিলাম। সময়টা আপনাদের যে কারও চে’ আমার ভালোই কাটছে।

স্মিত হাসিমুখে বললেন।

কথায় কথায় ঢাকায় ব্যক্তিগত জীবনের কথা উঠল। বাবুর ও রোহানের কমন পরিচিতা খুল্লামখুল্লা তরুণী চেতনার কথা উঠল। রোহান তাকে কীভাবে মিট করেছেন, বললেন। বাবুর সম্পূরক প্রশ্ন করে আরও কিছু জমে থাকা কৌতূহল মেটালেন চেতনাকে নিয়ে। প্রতিশ্রুতি আদায় করলেন এরপর তাকেও সঙ্গী করে নেবেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন বা না করুন, সে মুহূর্তে রেহানের সরল স্বীকারোক্তি শুনেই ভালো সময় কাটল বাবুরের। এর কিছুক্ষণ পর অ্যানাউসমেন্ট শুনে প্লেনে ওঠার প্রস্তুতি নিলেন।

প্লেনে চড়ে বসে আবারও থিতু হওয়ার পালা। প্লেনে উড়তে শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হলেন বাবুর। আকাশের ওপর উদাস হয়ে পড়ে মন। আবেগ প্রগলভ হয়ে ওঠে। পুরাতন নানা কথা মনে পড়ে। বাবুরেরও তাই হলো। ১৯৯৮ সালে নেপালে আসার সুযোগ হয়েছিল বাবুরের। কিন্তু তখনকার প্রেমিকার নেকি বাধায় তা হয়নি। তার এক প্রবাসী মামা, যাঁকে নেপালের পাহাড় খুব টানে। বাবুরকে সাথে নিয়ে আসতে চে’ছিলেন। প্রেমিকা তখন কেঁদে কেঁদে বাদ সাধলেন। সেই প্রেম আর প্রেমভঙ্গজনিত বিরহ নিয়ে কতই না ঘটনা বাবুরের জীবনে। একে একে মনে পড়ে গেল। তাদের প্রেম ভাঙনের কিছুদিন পরে ২০০১ সালে প্রেমিকা অন্যত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আবার বিচ্ছেদ নিলেন। পরিবারের সাথে একটা টানাপোড়েন হলো এ নিয়ে। সে সময় নেপালের রাজপ্রাসাদে দুঃখজনক ঘটনায় রাজপরিবারের এগারজন নিহত হলেন। প্রাথমিকভাবে শোনা যাচ্ছিল, রাজপুত্র দীপেন্দ্রদেব প্রেয়সীকে বিবাহে পরিবারের সম্মতি না পেয়ে এমনটা করেছেন। রাজপুত্রই হন্তারক। বাবুর বাংলাদেশের এক মফস্বল শহরে তার জীবনের টানাপোড়েনে মন্তব্য করলেন, ‘এক উইকেট পড়েছ তো কী, আমি দশ উইকেট পড়লেও ওকে বিয়ে করতাম।’ বোঝাতে চে’ছিলেন তার প্রেয়সীর দশবার বিবাহ হলেও তিনি তাকে নির্দ্বিধায় পুনর্বিয়ে করবেন। কিন্তু তার পিতার কানে কথাটি তোলা হলো বাবুর তার পছন্দের মে’কে বিয়ের জন্য পরিবারের দশজনকে হত্যা করবেন প্রয়োজনে, নেপালরাজের পরিবারের মতো। বাবুরের দুর্ভাগ্যই বলা যায় এই হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার স্থান নারায়ণহিতি প্রাসাদের গেট থেকে তিনি ফেরত এসেছেন, টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ না করেই। যে রাজবাড়ির ঘটনা তার জীবনের সাথে একটু হলেও জড়িয়ে আছে, তা ঘুরে দেখায় নিজেকে বঞ্চিত রেখেই ফিরে যাচ্ছেন। এই গভীর আবেগের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয় শিক্ষাজীবনে বাবুরের। আর মে’টির পরিবার এ আবেগকে নিয়ে যথেচ্ছ খেলা খেলে। মে’টির এর পরেও আর সংসার করা হয়নি কোথাও। পরে শুনেছেন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেজায় বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। মে’টির পরিবারের হাতে অন্যায় হেনস্তা হলেও মে’টির বর্তমানের নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে এতটুকুও আনন্দিত নন বাবুর। তার কথা হলো, এসবের কিছুই তো আমার কাম্য ছিল না। এসবের ‘কিচ্ছু চাইনি আমি’।

মনে পড়ে নেপাল নিয়ে ফেলুদা সিরিজের ‘যত কা- কাঠমান্ডুতে’ দেখে ১৯৯৮-তেই আলোড়িত হয়েছিলেন। তীব্র আকাক্সক্ষা হয়েছিল ফেলুদাতে দেখানো সুগার কিউব দিয়ে চা-কফি খাওয়ার। দেখেছিলেন মগনলাল মেঘরাজ, ফেলুদা, তপসে, লালমোহন বাবুকে সুগার কিউব দিয়ে টি-কফি অফার করছেন। আরেকখানে দেখেছিলেন খেলনা ঝুনঝুনির মতো জপযন্ত্র ঘোরাচ্ছেন লালমোহনবাবু শিশুসুলভ উল্লাসে।

শুধু যে ভালো স্মৃতি মনে পড়ে তা নয়। গ্লানিময় স্মৃতিও মনে উঁকি দেয় বাবুরের। আগেরবার নেপাল যাত্রায় অতিশয় গৃধু এক সহকর্মী এসেছিলেন দলে। তিনি নারী সহকর্মীদের সূক্ষ্মভাবে উসকে দিয়ে বেজায় বিরক্তিকর অবস্থার সূত্রপাত করান। এমন একটি পরিস্থিতি, বাবুর বিরক্ত হয়ে উত্তেজনা প্রকাশ করলে বিরাট বিপত্তি হয়ে যায়। না করলে উত্তেজনা প্রশমিত রেখে নিরুত্তাপ থাকা আরও কঠিন হয়। সারাক্ষণই এসব অশল্লী নিয়ে মনঃপীড়া থাকে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পুরো সময়টা কাটাতে হয়। হিউমিলিয়েট করার জন্য কখনো অপ্রস্তুত রেখেই ছবি তোলেন। আবার দলের কাউকে কাউকে নিয়ে বাবুরকে বাদ রেখেই ছবি তোলেন তাকে সামান্য দূরে দাঁড় করিয়ে রেখেই। অন্যদের কাজে-কর্মে, আচরণেই বোঝান- তিনি অফিসার। বাবুর চাপরাশি বা আরদালির সমানও নয়। বাবুরের মনে পড়ে, তার বন্ধু নিরঞ্জন চৌধুরীর স্ত্রী নেপালে এসে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছিলেন। একটা ট্রেনিংয়ে এসেছিলেন বছরব্যাপী। এটা ভারতে হওয়ার কথা ছিলো। ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতায় হয়নি। পরের বছর একই মানের প্রশিক্ষণে নেপালে আসেন বন্ধু স্ত্রী। সেখানেই আউট স্পাউজালে জড়িয়ে পড়া, আগের সংসারে স্বামী-কন্যার কাছে আর না ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া। নিয়তি হয়তো এমনই ব্যাপার। আগের বছর ভারত সরকারের নীতি ডিঙিয়ে এক বছরের ভিসা হলে এমন হয়তো হতোই না। সবকিছুই অন্য রকম হতো তাহলে।

এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে পাশে এক সুশ্রী তরুণী আর কেতাদুরস্ত সহযাত্রী যুবকের সাথে আলাপ হয়। পরিচয়ে জানতে পারেন, তরুণীটি বাংলাদেশের একজন নায়িকা, যুবকটি প্রোডিউসার। শুটিং ইউনিটের অন্য লোকেরাও আছেন একই বিমানে। দুই সপ্তাহের শুটিং শেষে তারা দেশে ফিরছেন। এটা-ওটা কথা হয়। এ দেশে মনোরম রিসোর্ট যে আমাদের দেশ থেকে অনেক সস্তা অফার দেয়, সেকথা হয়। তরুণী বলেন এ আলোচনায় যুক্ত হয়ে, ‘ভাইয়া জানো, আমাদের যে হোটেল প্রথমে রেখেছিল, তেমন ভালো না। আমার তো একদমই পছন্দ না। পরে ইউনিটের ম্যানেজারকে বললে আমাকে একটি রিসোর্টে শিফট করে দেয়। অন্নেক সুন্দর রিসোর্টটা। একা কেমন করে থাকি। ভয় লাগে তো। প্রোডিউসার শারমেন ভাইয়াকেও আসতে বলি। আমরা দুজন ছিলাম রিসোর্টে। আলাদা আলাদা রুম নিয়ে।’ বাবুর এতে যা বোঝার বুঝে নেন। স্ট্রেস কাটাতে বাবুর কখনো কখনো আপন মনে মিষ্টি একটি মানব-মানবীর সঙ্গম দৃশ্য কল্পনা করেন। এবারও হয়তো তাই করতেন। চোখ সটান বন্ধ করে উঠতি নায়িকা আর প্রোডাকশনের প্রোডিউসারকে নিয়ে। একটি মনোরম রিসোর্টের সুনসান কক্ষে…। তার আর দরকার হলো না। তখনই সেকেন্ড পাইলট নাফিদাথ হোসেন অ্যানাউন্স করেন, ‘আজকে আকাশ পরিষ্কার, সুন্দর রোদ উঠেছে। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে হিমালয় পর্বতমালার অন্নপূর্ণা পর্বতশ্রেণির ফিশটেল বা মৎস্যপুচ্ছ পর্বতশৃঙ্গ দেখতে পাব। আপনারা চলন্ত বিমানটির বাম জানালায় চোখ রাখলে এ পর্বতশৃঙ্গ দেখতে পাবেন। সবাইকে ধন্যবাদ।’

হিমালয়ের পাহাড় চূড়ার ঘোষণায় বাবুরের মনে পড়ল তার বন্ধু মোখলেসকে। মোখলেস ১৯৯৬ সালে কলেজের শিক্ষাসফরে গিয়ে সীতাকু- পাহাড়ে সিঁড়ি বেয়ে স্থানটির সর্বোচ্চে গিয়েছিল।…কিছুদিন আগে মাউন্ট ক্লাইম্বিং কোর্স করতে ক্যাপ্টেন রাজীব নামের বাবুরের এক ঘনিষ্ঠ কলেজের ছোট ভাই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার নেপালে আসেন। তার নেপাল আগমন উপলক্ষে বাবুর ও রাজীবের দুই পরিবার ঢাকার ধানমন্ডির একটি রেস্তোরাঁয় সেলিব্রেট করেছিল।…একবার এক পত্রিকার রবিবাসরীয়তে বড় পর্বতারোহীর চোখ-মুখ ঢাকা ছবি দেখে বাবুর পরিকল্পনা করেছিলেন, তার পাহাড়প্রেমী প্রবাসী মামা দেশে এলে তাকে সেটি দেখিয়ে চমকে দেবেন। বলবেন, ওটাই আমি। কিছুদিন পরে অবশ্য সেই ভুল ভাঙে বাবুরের। হিমালয়ে পর্বতশৃঙ্গারোহীর মৃত্যুর ওপর একটি নিবন্ধ পড়ে। পর্বতারোহণ যে মহাকাশযাত্রার মতোই একটি মহাযজ্ঞ, তা বুঝতে পেরে নিজেই লজ্জা পেয়েছিল সেদিন। আজও আরেকবার লজ্জিত হলেন সে কথা ভেবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হিমালয়ের দেখা মিলল। ধূসর পর্বতমালার ওপরে শ্বেত-শুভ্র বরফের আচ্ছাদন। ঠিক ছবিতে দেখার মতো। ঘন বরফে ঢাকা অপরূপ চূড়াটিতে খুবই খাড়া হওয়ার জন্য কেউ উঠতে পারেন না। এ জন্য একে অক্ষতযোনি কন্যা বা ভার্জিন পর্বত বলা হয়। হিমালয়ের ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পর্বতস্তূপকে অন্নপূর্ণা মাউন্ট রেঞ্জ বা পর্বতশ্রেণি বলা হয়। শৃঙ্গের শীর্ষ সন্ধি মাছের লেজের মতো দেখতে বলে এমন নামকরণ হয়েছে। খাড়া পৃষ্ঠের জন্য এই শিখর সুপরিচিত। তুলনামূলক কম উচ্চতার হলেও অতিশয় খাড়া বলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চূড়া হিসেবে সমাদৃত। এমন খাড়া শীর্ষের শৃঙ্গ হিমালয় পর্বতশ্রেণিতে দ্বিতীয়টি নেই। আর পর্বত আরোহণের জন্য অনুমোদিত নয় বলে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ম্লান হবার নয়।

বাবুরের এ মুহূর্তে আরও গভীর উপলব্ধি হয়- বিশালতা, ব্যাপকতা, বিস্তৃতির উপমা কেন হিমালয়। তার মনে পড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন দেয়াল লেখনীর কথা, ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু মুজিবকে দেখেছি।’ উপমেয় ও উপমান যেন সোনায় সোহাগা। তবু এ হিমালয়ের দেশে এসে মানুষ নীচুতা করে কীভাবে, শঠতা করে কেন, হিমালয়কন্যার বুকে মায়ের তার কন্যাকে ত্যাগ করার অভিপ্রায় হয় কেমন করে ইত্যাদি স্মৃতিকাতরতায় বড়ই দুঃখ হয় বাবুরের। বিবমিষা হয়ে যায়। সব কেমন যেন গুলিয়ে যায়।

সুদর্শনীয় হিমালয় দেখে আনুশকাকে ছেড়ে যাওয়ার যুবক বয়সের কাঁচা আবেগ উৎসারিত দুঃখবোধ কেটে যায় তানজিদের। টাকা ঠকার বেদনাবোধ ঘুচে যায় রেহানের। প্রহৃত হওয়ার মর্মপীড়া, লাঞ্ছিত হওয়ার যন্ত্রণা, লুট হওয়ার হতাশা মুছে যায় রোহানের। সূর্যের আলোয় সাদা বরফে আচ্ছাদিত হিমালয়ের আত্মপ্রকাশের মতোই শুভ্র-শুদ্ধ হয়ে ওঠে তাদের অন্তরাত্মা।

বাবুরও দ্বিতীয়বার যখন চাক্ষুষ করেন হিমালয়ের দীপ্তিময় সৌন্দর্য, ঋজু ও ঊর্ধ্বাকাশমুখীন ব্যক্তিত্ব, বুক পেতে তুষার ঝড় থেকে জাগতিক সব ঝঞ্ঝা রুখে দেওয়ার মতো দৃঢ়তা, তখনই নির্বাপিত হয় মনের সব গ্লানিময় ভাবনা। আশা জাগে মনে। আশায় স্ফীত হয় বুক। যাপিত জীবনের সমুদয় জঞ্জাল, জরা-ব্যাধি সত্ত্বেও অন্য রকম এক আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।

লেখক পরিচিতি: আসিফ কবীরের জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৯৮১, খুলনায়। পিতা: একুশে পদকে ভূষিত শহীদ সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু। মাতা: কবি, শিক্ষয়িত্রী আক্তার জাহান রুমা, খুলনা থেকে প্রকাশিত অর্ধশতবর্ষী জন্মভূমি পত্রিকার দৈনিক পর্বের প্রতিষ্ঠাতা। শিক্ষালাভ: পাবনা ক্যাডেট কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায়।

পেশাজীবন: দৈনিক জন্মভূমি ও সান্ধ্য দৈনিক রাজপথের দাবীর ভূতপূর্ব সম্পাদক, এক দশককাল চুক্তিভিত্তিক সরকারি চাকরি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির গণমাধ্যম পরামর্শক। একমাত্র সন্তান আক্তার জাহান প্রকৃতি, সহধর্মিণী সানজিদা আক্তার শিপ্রা, চিত্রশিল্পী। দুই ভাই ও বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। অন্য দুই ভাই-বোন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত।

সারাবাংলা/এসবিডিই

থামেল নেপালে