Thursday 10 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাকারিয়া মন্ডলের তিনটি বইই হোক ভ্রমণপিয়াসীর পূর্বপাঠ্য


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৬:১৯ | আপডেট: ১০ মে ২০২২ ১৮:৩৬
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কবি বা সাহিত্যিক কিছু নন, এমন যে ক’জন তাদের লেখায় মন কেড়েছেন তাদের একজন জাকারিয়া মন্ডল। মন্ডল নিউজ লেখেন। দীর্ঘসময় তার রিপোর্টিং ক্যারিয়ার ফলে রিপোর্টই বোধ হয় জীবনে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন। পলিটিক্যাল রিপোর্টিংয়ের একটা কাইট ফ্লাইং ধরণ আছে। ঘুড়িটি উড়িয়ে দেবেন, কিন্তু নাটাইয়ে বাাঁধা মাঞ্জাসূতো নিজের হাতে রাখবেন, যাতে নিয়ন্ত্রণটা ধরে রাখা যায়, এই ধরনের লেখায় সিদ্ধহস্ত তিনি। তবে সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে এখন একটা বড় সময় কেটে যাচ্ছে নিউজ এডিটিং টেবিলে। যেসব রিপোর্টার তার সঙ্গে কাজ করেছেন এবং রিপোর্ট এডিট করিয়ে নিয়েছেন, তারা জানেন রদ্দি কপিটাও কীভাবে তার হাতে একটা কাঠামোবদ্ধ খবরে রূপ নেয়। ঝরঝরে কপি এডিটিংয়ের টিপসগুলোও জাকারিয়া মন্ডলের জানা। ফলে লেখক না থেকেও জাকারিয়া মন্ডল একজন লিখিয়েই ছিলেন তাতে সন্দেহমাত্র নেই। তবে জাকারিয়া মন্ডল সম্ভবত তার সবচেয়ে বেশি পারঙ্গমতা, কিংবা একনিষ্ঠতাও বলা চলে, দেখিয়েছেন প্রত্নতাত্বিক গবেষণা ও আবিষ্কারে। দেশের নানাস্থান ঘুরে, বিশেষ করে ঢাকার প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন খোঁড়াখুঁড়িতেও সময় দিয়েছেন অনেক। এর বাইরে তিনি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। এই ঘুরে বেড়ানোকে কেবল ট্রাভেলার বা ভ্রমণকারী বলা যাবে না। পরিব্রাজক বলাটা হয়তো বেশি হয়ে যাবে, তবে তার ঘোরাঘুরির একটা লক্ষ্য থাকে। তিনি কেবল দেখেন না, অনুধাবনও করেন। আর ভ্রমণ পরবর্তিতে তা নিয়ে লেখেন। তো এই ভ্রমণ নিয়ে লেখালেখি ও তার মধ্য দিয়ে এরই মধ্যে তিনখানা বই বাজারে আসা নিয়ে কথা বলতেই এই দীর্ঘ সূচনাংশ।

বিজ্ঞাপন

জাকারিয়া মন্ডলের তৃতীয় ভ্রমণ বইটি হাতে এসেছে ১৮ ফেব্রুয়ারি। বইটির নাম নদী অঞ্চলের ইতিবৃত্ত। বের হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা সামনে রেখে। তবে এর আগে বাড়ির পাশে তীর্থ ও পাহাড়ের ভাঁজে মহাকাব্য নামের দুটি বই বের হয়েছে। যার কপি লেখক আগেই নিজে এসে পৌঁছে দিয়েছেন। সে হয়তো আমি তার লেখার ভক্ত বলেই। জাকারিয়া মন্ডলের তিনটি বইই ভ্রমণ বিষয়ক। এর মধ্যে নদী অঞ্চলের ইতিবৃত্ত ও পাহাড়ের ভাঁজে মহাকাব্য নাম দুটি থেকে আন্দাজ করা যায় একটি দেশের নদনদী নিয়ে, অন্যটি পাহাড় নিয়ে। আর তৃতীয়টি- বাড়ির পাশে তীর্থ একটি ভিন্ন ধরনের ভ্রমণের বই। দেশের ছোট-বড় বিভিন্ন তীর্থস্থান নিয়ে রচিত এই বইটি, যার মধ্যে প্রত্নতাত্তিক দিকগুলোরও কিছুটা ছোঁয়া রয়েছে। কারণ তীর্থস্থানের ধর্মীয় দিক নয়, এগুলোর সৌন্দর্য ও স্থাপনাগুলোর প্রাচীন প্রত্নতাত্তিক দিকগুলো তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্য।

ভালো লেখেন জাকারিয়া মন্ডল, তা আগেই বলেছি। তবে এটুকু বলে শেষ করা যাবে না। কারণ তার লেখার পন্ডিতিটা হচ্ছে, লেখাটি পড়লে পাঠক নিজেকে ঘটনাস্থলে আবিষ্কার করতে পারবেন। নদী অঞ্চলের ইতিবৃত্ত থেকে একটু উদ্ধৃত করা যায় উদাহরণ হিসেবে-
ভরদুপুরে সুনসান গোশিংগা বাজার। ঘাটে নোঙর ফেলা নৌকাটা দুলছে। বৈঠা হাতে দোল খাচ্ছে মাঝিও। রোদে পুড়ছে যাত্রীর অপেক্ষায়। এখানে বেশ প্রশস্ত নদীটা। ক্রমশ সরু হয়ে এগিয়েছে দক্ষিণে। পানির কিনারে আপনমনে চরে বেড়াচ্ছে গরুর পাল। দুপাড়ের গাছপালায় ছাওয়া সড়ক। ফাঁকে ফাঁকে বসতি, বাজার। জলপ্রবাহ বেশ নিচে। মন্থর। ভরা বর্ষাতেও উপচে পড়ে না স্রোত। প্লাবিত হয় না অববাহিকা। তাই পাড় ভাঙার দুর্নামও নেই। এমন শান্ত নদী সচারচর দেখা যায় না।

সোশিংগা বাজার যাদের চেনা, এই বর্ণনায় তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে শীতলক্ষ্যা। শান্ত সুন্দরী স্বচ্ছসলিলা একটি নদীর চেহারা। এটাই জাকারিয়া মন্ডলের লেখার পাণ্ডিত্য। ভ্রমণপিয়াসীরা এতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আর না হলেও বর্ণনা থেকে দেখে নিতে পারবেন পছন্দের নদীটিকে।

কিংবা- পাহাড়ি ঝরনাটা গজরাচ্ছে যেনো। গাছপালার ফাঁকে উঁকি মেরেই আছড়ে পড়ছে নিচের পাথরে। গহীন বনজুড়ে তার উচ্চকিত গান। আর সব আওয়াজ চাপা পড়েছে উন্মাতাল ঝরনার নিচে। পতন স্থান থেকে ঝরনাটা এগিয়েছে ছড়ার মতো। ছোট ছোট অসংখ্য প্রপাতে ছন্দ তুলে ভাটিতে নেমেছে। ছড়ার ওপরে একটা ঝুলন্ত সেতু। বাঁশ, কাঠ আর দড়ির। পাহাড়ি ঝরনার এর চেয়ে আর ভালো বর্ণনা কীই হতে পারে।

এমনি পাহাড় নদী দেখার বর্ণা উঠে এসেছে দুটি বইয়ে। সাথে সাথে প্রতিটি ভ্রমণের কাহিনীতে তুলে ধরা হয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এবং তার সঙ্গে নদী কিংবা পাহাড়ের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক দিকগুলোও প্রাধান্য পেয়েছে। আর সবকিছু ছাপিয়ে বই দুটিতে উঠে এসেছে নদী ও পাহাড়ের সৌন্দর্য্য। পাহাড়ের ভাঁজে মহাকাব্য অবশ্য সবগুলোই দেশের বাইরে কোনও না কোনও পাহাড়ের কাব্য রচিত হয়েছে। তবে নদী অঞ্চলের ইতিবৃত্ত কেবলই দেশীয় নদনদীর কথা বলেছে।

লেখক-সাংবাদিক জাকারিয়া মন্ডলের গবেষক মনের পরিচয় এইসবগুলো লেখাতেই পাওয়া যায়। তবে তার ‘বাড়ির পাশে তীর্থ’ বইটি একটু ভিন্ন ধাচের। এটিও ভ্রমণভিত্তিক। তবে বইয়ে স্থান পাওয়া প্রতিটি রচনায় কোনও না কোনও তীর্থস্থানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এসব তীর্থ কেবল যে ধর্মীয় গন্তব্য তা নয়, প্রাকৃতিকভাবে, ঐতিহ্যগতভাবে এবং প্রত্নতাত্তিক দিক থেকেও যে তার অনেক গুরুত্ব, সেটাই উঠে এসেছে এই বইয়ে। একটি অংশের বর্ণনা এমন: অক্ষয় বটের পাশে ভৈরব মন্দির। পূর্ব দিকে সুবিশাল দিঘি। নাম ব্যাসকুণ্ড। পৌরাণিক আখ্যানে মহামুনি ব্যাসদেব এখানে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন বলে এই নাম। বিষয়ের সৌন্দর্য্যই কেবল নয়, তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ধর্মীয় বিশ্বাসের উৎস্যস্থল এগুলো জানাতে ভোলেননি লেখক।

আরও একটি কাজ এই লেখকের তিনটি বইয়েই বারবার মিলেছে- তা হচ্ছে ওই সংক্রান্ত যা কিছু সাহিত্য চর্চা কিংবা কোনও পূর্ব গবেষণার ফল সেগুলোও তুলে ধরা হয়েছে এই বইগুলোয়। তাই ধলেশ্বরী নদীর কথা লিখতে গিয়ে-

‘এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলিলগ্নে
যেই খানে
বহি চলে ধলেশ্বরী;
তীরে তমালের ছায়া;
আঙ্গিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর

রবি ঠাকুর থেকে এই উদ্ধৃতি কেবল নদীটিকেই চেনায় না। লেখক হিসেবে জাকারিয়া মন্ডলের পরিপক্কতাও তুলে ধরে।

এসব থেকে বলতে পারি ভ্রমণপিয়াসী যেকোন পাঠকের জন্য তিনটি বইই হতে পারে পূর্বপাঠ্য। জাকারিয়া মন্ডলকে ধন্যবাদ এমন সুখপাঠ্য ভ্রমণ কাহিনী পাঠকের সামনে হাজির করার জন্য। বাড়ির পাশে তীর্থ প্রকাশ করেছে বাঙালি প্রকাশনা, পাহাড়ের ভাঁজে মহাকাব্য এনেছে শুদ্ধপ্রকাশ আর নদী অঞ্চলের ইতিবৃত্ত এনেছে ঐতিহ্য। পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়।

সারাবাংলা/এমএম

জাকারিয়া মন্ডল নদী পাহাড় প্রাণেরমেলা বইমেলা ভ্রমণকাহিনী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর