।। হাসনাত শাহীন, বইমেলা থেকে ।।
সুনসান, নীরব, নিস্তব্ধ পরিবেশ কবি-সাহিত্যিক আর সৃজনশীল মানুষদের কাছে বড়ই প্রিয় এবং প্রয়োজনীয়ও। এই সব মানুষদের কাছে তেমনই প্রিয় মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে অনুষ্ঠিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। উৎসব-প্রিয় জাতি বাঙালির কাছে প্রাণের মেলা ‘বইমেলা’ হিসেবে পরিচিত এবারের মেলার ৫ম দিন মঙ্গলবার ছিল তেমনই পরিবেশ। যে পরিবেশে বইপ্রেমী মানুষেরা স্বচ্ছন্দে ঘুরে-ফিরেছে মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্টল-প্যাভিলিয়নে। নির্ঝঞ্ঝাটে দেখেছে এবং কিনেছে প্রিয় লেখকের পাশাপাশি নতুন লেখকদের নতুন-পুরাতন বই। সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার বইয়ের তালিকা। যে তালিকা দেখে মেলার আগামী দিনগুলোতে কিনবে পছন্দের বই।
মেলার নীতিমালা অনুসারে মঙ্গলবার সাপ্তাহিক কর্ম দিবসের তৃতীয় দিনের বিকেল ৩টায় খুলে দেওয়া হয় প্রবেশ পথ। এই সময়ে মেলায় প্রবেশের জন্য মেলার প্রবেশ পথে তেমন ভিড় না থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মেলায় বাড়তে থাকে বইপ্রেমী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা’র সমাগম। এসেছিলেন অনেক লেখক। ছিল কোলাহল, জমে উঠেছিলো প্রাণবন্ত আড্ডা। শিশু কর্ণারেও ছিল শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকের প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতি। মেলার খাবারের দোকানগুলোতেও ছিল পর্যাপ্ত ভিড়। যে চিত্র ছিল গ্রন্থমেলার অপর প্রান্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও।
মেলার মূল প্রাঙ্গণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থাগুলোর সত্ত্বাধিকারীরাও বলছেন সেই কথা। তারা বলছেন, মেলার যতই দিন বাড়বে ততই বাড়বে বইপ্রেমীদের ভিড়। সে কর্ম দিবস হোক আর ছুটির দিন হোক। কমে যাবে দর্শক। বিক্রি হবে বিভিন্ন ধরনের বই। আর, সামনের ছুটির দিনগুলোতে তো মেলায় উপচে পড়া ভিড় হবে। আশা করছি, এই দিনগুলোতে বেচা-কেনাও অনেক ভালো হবে।
এদিকে, মেলার মাঝামাঝি সময়ে মেলার বড় বড় প্রকাশনাগুলোর প্যাভিলিয়নের সামনে জমে ওঠে ভিড়। প্রকাশনা সংস্থা-পাঞ্জেরী, ঐতিহ্য, কথাপ্রকাশ, অন্বেষা, তাম্রলিপি, ইত্যাদি, অন্যপ্রকাশ, কাকলী, অনিন্দ্য প্রকাশ, অনন্যা, পার্ল, উৎস প্রকাশন, আগামী প্রকাশনী, সময় প্রকাশনসহ বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা সামনে গিয়ে দেখা তেমনি চিত্র। ছোটছোট প্রকাশনাগুলোর সামনে তেমন ভিড় দেখা না গেলেও তাদেরও হতাশ করেনি আগত বইপ্রেমীরা। এসব প্রকাশনার থেকে অনেকেই বই কিনেছেন এবং বইয়ের তালিকাও সংগ্রহ করেছেন।
মেলার এমনই চিত্রের মাঝে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য’র প্যাভিলিয়নের সামনে সন্ধ্যার দিকে কথা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিকা চৌধুরী প্রিয়ন্তি’র সঙ্গে। এবারের মেলার সার্বিক পরিবেশ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এবারের মেলা অনেক গোছালো। বৃহৎ পরিসর, খোলামেলা স্টল বিন্যাস আর মেলা প্রাঙ্গণের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখে ভালো লাগছে। যার ফলে, মেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে স্বচ্ছন্দে যেমন ঘোরা যাচ্ছে তেমনই বই দেখা এবং কেনাও যাচ্ছে। তিনি বলেন, মেলার শুরু থেকে মেলায় অনেক মানুষ এসেছে, কিন্তু মেলার অসাধারণ স্টল বিন্যাস এবং পরিসর বৃদ্ধির কারণে তা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। বইও বিক্রি হচ্ছে। আমিও বেশ কিছু বই কিনেছি। বইয়ের তালিকাও সংগ্রহ করেছি বেশ কিছু প্রকাশনীর। এর মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আবার বই কিনতে আসবো।
তার কথার সাথে কথা শেষ করে একটু হাঁটতেই দেখা হলো প্রকাশনা সংস্থা রোদেলা’র কর্ণধার রিয়াজ খানের সঙ্গে। তিনি নিয়ে গেলেন তার স্টলে। সেখানে মেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, মেলার সবে মাত্র ৫দিন হলো। এসব দিনগুলোতে তেমন বিক্রি হয় না। এসময়ে যারা মেলায় আসে তারা প্রায় সকলেই বইয়ের তালিকা সংগ্রহ করতে আসে। কিছু মানুষ বইও কেনে। কিন্তু এবারের মেলার শুরু থেকেই অন্যরকম। অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের মেলার স্টল বিন্যাস থেকে শুরু করে সার্বিক পরিবেশও অনেক ভালো। বিক্রিও ভালো হচ্ছে। মেলার যত দিন যাবে মেলায় ভিড় যেমন বাড়বে, তেমনই বাড়বে বেচা-কেনাও।
এদিকে, পাঁচদিনের হিসেবে এবারের মেলায় মোট বই এসেছে ৫১৯টি। বিক্রি দিক থেকেও এবারের মেলাকে অন্যান্য বারের তুলনায় এগিয়ে রেখেছেন প্রকাশনা সংস্থা অবসরের ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা। তিনি বলেন, অন্যান্য বছর বিক্রি একটু দেরিতে শুরু হয়, কিন্তু এ বছর শুরু থেকেই ভালো বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরও জানান তাদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে এবারের মেলায় ৪০টি বই প্রকাশ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৫টি বই মেলায় চলে এসেছে বলেও জানান মাসুদ রানা। কথা প্রকাশের ব্যবস্থাপক ইউনুস আলী জানান, এবারের মেলায় তাদের ১৫০টি বইয়ের মধ্যে ৬০টি বই চলে এসেছে। এর মধ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শাকুর মজিদ, সুমন্ত আসলাম, রকিব হাসান ও ইকবাল খন্দকারের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
মেলায় নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্যমতে, মঙ্গলবার মেলার পঞ্চম দিনে নতুন বই এসেছে ১৫২টি। এর মধ্যে গল্প ২০টি, উপন্যাস ৩৩টি, প্রবন্ধ ১৫টি, কবিতা ৪০টি, গবেষণা ২টি, ছড়া ২টি, শিশুসাহিত্য ২টি, জীবনী ৫টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৭টি, বিজ্ঞান বিষয়ক ৩টি, ভ্রমণ বিষয়ক ৩টি, নাটক ২টি, রাজনীতি বিষয়ক ১টি, ধর্মীয় ১টি, অনুবাদ ২টি, সায়েন্স ফিকশন ১টি ও অন্যান্য ১৪টি। মঙ্গলবারের মেলার উল্লেখযোগ্য বই-প্রকাশনা সংস্থা গ্রন্থকুটির থেকে প্রকাশিত হয়েছে মোজাফফর আহমদের ‘বাংলা সাহিত্যের নানাদিক’, অনন্যা এনেছে দিপু মাহমুদের ‘নতুন ডায়েরি-১৯৭১’, এবং মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের ‘সমাজ ও নানা চিন্তা’, তৃণলতা প্রকাশনী এনেছে আহসান হাবীবের ‘বিজ্ঞান কল্প গল্প’ ও অনুপম হায়াতের ‘গণমাধ্যমে নজরুল’, উৎস প্রকাশন এনেছে হাসান শাহরিয়ারের ‘নিউজউইকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় এবং তারপর’, নবযুগ প্রকাশনী এনেছে সনজিদা খাতুনের ‘অগ্রজ জনের সৃষ্টিবীসা’, তরফদার প্রকাশনী এনেছে হায়দার আকবার খান রানোর ‘মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিরা’, কথাপ্রকাশ প্রকাশ করেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই’ ইত্যাদি।
মেলামঞ্চে মঙ্গলবারের আয়োজন : মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘কবি সিকান্দার আবু জাফর : জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি নাসির আহমেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. শিরীণ আখতার এবং কবি বায়তুল্লাহ কাদেরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে একই মঞ্চে সন্ধ্যায় শুরু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি সানাউল হক খান এবং তারিক সুজাত। আবৃত্তি পরিবেশন করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং শাহাদাৎ হোসেন নিপু। সংগীত পরিবেশন করেন মাহমুদ সেলিম, সমর বড়ুয়া, আরিফ রহমান, সুরাইয়া পারভীন এবং স্বর্ণময়ী মণ্ডল।
মেলামঞ্চের বুধবারের আয়োজন : অমর একুশে গ্রন্থমেলার ৬ষ্ঠ দিন আগামীকাল বুধবার গ্রন্থমেলা শুরু হবে বেলা ৩টায় এবং শেষ হবে রাত ৯টায়। এসময়ের মধ্যে বিকেল ৪টায় মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় : জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আবুল হাসনাত। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন বিমল গুহ, গোলাম কিবরিয়া পিনু এবং শোয়াইব জিবরান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন কবি আসাদ চৌধুরী। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সারাবাংলা/এমএ