মায়ামুকুট: বিস্ময়কর চরিত্রের অনবদ্য বর্ণনা
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৫:৫৯
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ।।
‘হৃদয়াবেগ ছাড়া কখনও খাঁটি শিল্প সৃষ্টি হয় না। কখনও হয়ওনি।’ রুশ সাহিত্যিক ইলিয়া এরেনবুর্গের এই মন্তব্য যথার্থ। কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের নতুন উপন্যাস ‘মায়ামুকুট’ এই পথেই দাগ কেটেছে। বইটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ।
উপন্যাস রচনায় স্বকৃত নোমান বরাবরই গতানুগতিক ধারার বাইরে হাঁটেন। বিষয় নির্বাচনে ধ্যান-জ্ঞান, বিচার-বিবেচনা, আখ্যানের বয়ান-বয়ন তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। ‘মায়ামুকুট’ সেই সৃষ্টির মুকুটে নতুন পালক। যা প্রতিশ্রুতিশীল এই লেখকের সৃষ্টিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। পৌঁছে দিয়েছে অন্য উচ্চতায়।
পাঠককে হাত ধরে লেখকের কল্পনা জগতে নিয়ে যাওয়ার সুনিপুণ কৌশল রপ্ত করেছেন স্বকৃত নোমান। ‘মায়ামুকুট’ উপন্যাসের বয়ানেও এই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। উপন্যাসের শুরুটা সম্পর্কে না বললেই নয়, ‘আসুন, স্মরণ করি। স্মরণ করি পৌষের সেই হিমরাতের কথা, টানা দেড় ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধের পর মুলুকচানকে যে-রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, তার গ্রেপ্তার সংবাদ ছড়াবার পর পাহাড়ি ঢলের মতো দিকে দিকে নেমেছিল আতঙ্কের ঢল।’
উপন্যাসের শুরুটা শব্দের গতিশীল বুনটের জানান দিচ্ছে। রহস্যের বাউকুড়ানিতে আবিষ্ট করছে পাঠককে। ২২৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ পাঠ ভ্রমণেও যে ঘোর কাটবে না। দ্বীধাহীন বলা যায়।
মোহাম্মদ মুলুক হোসেন গোলদার ওরফে মুলুকচান গোলদার ওরফে মুলুক ডাকাত ‘মায়ামুকুটে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাকে ঘিরে ঘটনার ডালপালা মেলেছে। অবধারিতভাবেই এসেছে মুকুলচানের প্রণয়নী শিউলী, পুলিশ কর্মকর্তা ওমর তাজেল, মতিউর রহমান ভূইয়া ওরফে মতি ভূইয়া। এ ছাড়াও আছে ওয়াস আলী গোলদার, মেহের মেম্বার, রাঁড়িবুড়িসহ অসংখ্য চরিত্র।
আখ্যান বর্ণনায় বিভুরঞ্জন সরকার ওরফে ভুবন সাধু নামে এক সাধকের রচিত গাঁথাকে আশ্রয় করেছেন লেখক। যার রচনার পথ ধরেই মুলুকচানের সলুক সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘপথ। আবার কখনো কখনো কারারক্ষীর বয়ানে ঔপন্যাসিক নিজেই অবতীর্ণ হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর নানা ঘটনা অনুষঙ্গ হয়েছে মায়ামুকুটে। সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন ও ঘটনার পাশাপাশি প্রেম-ভালোবাসা, কাম, ক্রোধ, আবেগ, অনুভূতি, নৃশংসতা আর অ্যাডভেঞ্জারের সন্নিবেশ হয়েছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। যা পাঠককে দেবে গতিশীল ও রোমাঞ্চকর পাঠানুভূতি।
নারীর প্রতি সীমাহীন বিদ্বেষ আর ঘৃণা নিয়ে বেড়ে ওঠা মুলুকচান শিউলীর প্রেমে জড়িয়ে ছেড়ে দেয় সৈনিক জীবন। অহর্নিশ কেবল শিউলীতে তন্ময় হয়ে থাকে সে। কিন্তু কাহিনি নতুন বাঁক নেয়, শিউলীর সঙ্গে মুলুকের মিলনকালে। মুলুকের মনে পড়ে যায় বাবার অভিশাপের কথা। মুহূর্তে উবে যায় যৌনশক্তি। ক্লীব ভেবে তাকে দূরে ঠেলে দেয় শিউলী। শরীরের চাওয়া না মেটায় কর্পূরের মতো উবে যায় মনের টান।
আসে একাত্তরের ২৬ মার্চ। সাবেক সেনা সদস্য মুলুক নিজ গ্রাম পালগিরি ছাড়ে রাতের অন্ধকারে। তারপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসে সে। শিউলীর প্রেম তখনো তার হৃদয়ে। সেই দাবি নিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল শিউলীর সামনে। বলতে চেয়েছিল সে নপুংষক নয়। কিন্তু তা আর হয়নি। কাঠিমারা নদীর জলে নাকানি-চুবানি খাইয়ে সামাজিকভাবে অপমান-অপদস্থ করে গ্রাম ছাড়া করা হয় তাকে।
শিউলীর প্রেমে প্রত্যাখ্যাত মুলুক পা বাড়ায় অন্ধকার জগতে। জড়িয়ে যায় পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির গুপ্ত রাজনীতিতে। হয়ে ওঠে দুর্ধর্ষ ডাকাত, ভয়ংকর খুনি। পুলিশ তাড়া করে তাকে। মুলুকচানকে গ্রেপ্তারে দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশকর্তা ওমর তাজেলকে। মুলুক ডাকুকে ধরতে চলে দুঃসাহসিক অভিযান। কিন্তু তিরাশিবার গ্রেপ্তারের চেষ্টায় ব্যর্থ হয় পুলিশ। এক সময় সংশয় তৈরি হয় মুলুকের অস্তিত্ব নিয়ে। কেউ বলে নিহত হয়েছে। কেউ বলে পালিয়ে গেছে বিদেশে। তবে সাংবাদিকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মুলুক মরেনি। বেঁচেবর্তে আছে।
এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। রাঁড়িবুড়িকে গলা কেটে হত্যার দায়ে মৃত্যুদ- হয় তার। মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আবার পালায় মুলুক। এক পর্যায়ে নিজেই এসে আত্মসমর্পণ করে আইনের কাছে। এর মাঝে ঘটে যায় অনেক ঘটন-অঘটন। খুন হন ভুবন সাধু। আটষট্টিটি মামলায় একশ তেতাল্লিশ বছর কারাদ- হয় মুলুকচানের। পৃথিবীর সর্বোচ্চ দ-প্রাপ্ত আসামি মুলুক হয়ে ওঠে কারাগারের প্রধান জল্লাদ। তার হাতেই কার্যকর হয় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, পঁচাত্তরের খুনি ও জঙ্গিসহ তেত্রিশজন গণশত্রুর ফাঁসি। মুলুক নামটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
মায়ামুকুটের সাবলীল বর্ণনায় উঠে এসেছে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর দৃশ্যপটে আসা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ। গণজাগরণ মঞ্চসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাজনৈতিক ঘটনা।
তেত্রিশজনের ফাঁসি কার্যকর করায় ধীরে ধীরে কমে আসে মুলুকচানের সাজা। কারাজীবন থেকে মুক্তি পায় সে। তাকে একনজর দেখতে মানুষের ঢল নামে কেরাণীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাফটকে। অবরুদ্ধ হয়ে যায় ঢাকা ও আশপাশের নগরী। জীবন্ত এই বর্ণনা পাঠককে অনায়াসে নিয়ে যায় সেই সময়ে। দাঁড় করিয়ে দেয় সেই জনসমাগমের মাঝে।
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পালগিরিতে ফিরে যায় মুলুক। কাঠিমারা ফিরে পায় যৌবন। লেখকের বর্ণনায়, ‘দুই পারের তীর ভেঙে চুরে বইতে থাকে পুনর্জন্মপ্রাপ্ত নদী কাঠিমারা। মুলুক পুবের আকাশে তাকায়। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে ভোরের লাল সূর্য।’
‘মায়ামুকুট’ উপন্যাসটি অমর একুশে বইমেলায় অন্যপ্রকাশের ২০ নম্বর প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাচ্ছে।
সারাবাংলা/পিএম