পছন্দ এবং বিক্রির শীর্ষে উপন্যাস
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:১১
।। হাসনাত শাহীন ।।
‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’-বাঙালির প্রাণের বইমেলা। প্রতিবছরই এই মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকে হাজার হাজার সাহিত্যপ্রেমী। অপেক্ষা শেষে মেলার শুরু হলে নতুন বইয়ের মতোই যেন দলে দলে মেলায় এসে মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। এবারও তার ব্যতয় হচ্ছে না। মেলার শুরু থেকেই নতুন বইয়ের সঙ্গে বইপ্রেমীরা যেমন আসছেন, তেমনই প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ-সহ শিশু-কিশোর উপযোগি বই। এবারের এ গ্রন্থমেলার ১৮ দিন পর্যন্ত গ্রন্থমেলার আয়োজন প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্যমতে প্রকাশিত হয়েছে ২৬৮৭টি নতুন বই।
এসব প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে এবারের বইমেলায়ও এগিয়ে আছে কবিতা (৮৩৮টি), আছে গল্পগ্রন্থ (৪৩৭টি), এর পরেই আছে উপন্যাস; যার সংখ্যা ৪২৮টি। তবে অন্যবারের মতো এবারও বিক্রিতে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে-উপন্যাস। মেলার অধিকাংশ প্রকাশনার সঙ্গে কথা বলেই জানা গেছে এমন তথ্য।
এবারের এ প্রাণের বইমেলার ১৮তম দিন সোমবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্টল-প্যাভিলিয়ন ঘুরে ঘুরে এবং প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশকদের কাছে খোঁজ নিয়ে এর সত্যতাও পাওয়া গেছে। তারা বলছেন-সংখ্যাগত দিক থেকে নতুন বইয়ের মধ্যে কবিতার বই বেশি থাকলেও বিক্রির ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে উপন্যাস। এর পরই আছে ছোট গল্প, নাটক, কবিতা, মহীয়সীদের জীবনী ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। সবমিলিয়ে বলা চলে অন্যবারের মতো এবারও ঔপন্যাসিকদেরই জয়জয়কার।
প্রকাশকরা আরও বলছেন, নতুন উপন্যাসের চেয়ে পুরনো ও জনপ্রিয় লেখকদের উপন্যাসেরই কদর বেশি। তাদের ভাষায়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পাঠকের রুচি-চাহিদার কিছুটা পরিবর্তন হলেও এখনও উপন্যাসের প্রতিই পাঠকের ঝোঁক বেশি। আর এই উপন্যাস বিক্রির দৌড়ে এবারও এগিয়ে জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনসহ পরিচিত ঔপন্যাসিকরা। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাসগুলো। বলা যায়, এই দুইজনের উপন্যাস অনেকটা প্রতিযোগিতার সঙ্গেই বাজারে কাটতি হচ্ছে। ভালো বিক্রি হচ্ছে উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের প্রগাঢ়চিন্তা-চেতনা কিংবা দর্শনের উপন্যাসও। এছাড়াও বরাবরের মতো পাঠকের তুমুল ঝোঁক দেখা গেছে-মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, হোসেনউদ্দিন হোসেন, রাবেয়া খাতুন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, নাসরিন জাহান, সুমন্ত আসলাম, মোশতাক আহম্মেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার-সহ প্রমুখের প্রতি।
এই সময়গুলোতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা চত্বর ঘুরে বইপ্রেমীদের এমন আগ্রহের কথাও জানা গেছে। দেখা গেছে-সাহিত্য ও বইপ্রেমীদের সিংহভাগই মেলার স্টলগুলোতে খুঁজে ফিরছেন পাঠকপ্রিয় লেখকদের উপন্যাস। নবীন লেখকদের উপন্যাস ঘিরে যেমন পাঠকদের আগ্রহ বেড়েছে, একইভাবে চিরায়ত উপন্যাসগুলোর প্রতিও আগ্রহ দেখা গেছে।
‘কেন উপন্যাসের দিকে ঝোঁক?’-এমন প্রশ্নের জবাবে বইপ্রেমীরা বলছেন, একটা উপন্যাসে সমাজিক চিত্র বিভিন্ন দিক যেমন উঠে আসে, তেমনই অনেক উপন্যাসে একটি রাষ্টের, কখনও জাতি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন দিকও উঠে আসে। পড়তে গিয়ে কবিতা কিংবা গল্প-প্রবন্ধের মতো বেশি চিন্তা করা লাগে না। অতি সহজে বইটিতে লেখক কি বলতে চাচ্ছেন, তা বোধে যেমন সহজে নেওয়া যায় অন্যকোন বিষয়ের বইয়ে সেইভাবে নেওয়া যাই না।
এদিকে, হালের বেশ কয়েকজন তরুণ কথাসাহিত্যিকও পাঠক প্রিয়তার দিকে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও তাদের উপন্যাস বিক্রি হচ্ছে বেশ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিক হলো-আনিফ রুবেদ, শামস্ সাইদ, স্বকৃত নোমান, অদিতি ফাল্গুনী, সাদাত হোসাইন, হামিম কামরুল হক, হামিম কামাল, বদরুন নাহার এবং খালিদ মারুফ।
এছাড়াও এবারের মেলায় ভালো বিক্রি হচ্ছে কবি শামসউজজোহা’র প্রথম উপন্যাস ‘নয় নম্বর শান্তিকুঞ্জ’। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরের ২৫ বছরের প্রেক্ষাপটে রচিত কবি’র এ প্রথম উপন্যাস বইটি প্রকাশ করেছে ‘শ্রাবণ’ প্রকাশনী। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী মাসুক হেলাল এবং মূল্য ২৫০ টাকা।
এ উপন্যাস নিয়েই কথা হয় কবি শামসউজজোহার সঙ্গে। তিনি বলেন, উপন্যাসে ‘শান্তিকুঞ্জ’ একটি ছোট্ট দোতলা বাড়ির নাম। রাজধানীর কাছাকাছি কিন্তু গ্রামের মতো খোলামেলা ও নিরিবিলি পরিবেশ এ বাড়ির চারপাশে। মাঝবয়সী একজন কবি একাই বাস করেন বাড়িটিতে। ফেইসবুক আর নিজের ব্লগে প্রেমের কবিতা লিখে তরুণদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় তিনি। সবাই চেনেন ‘সূর্য ভাই’ বলে। একটি পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সবার সামনে আসেন। মিডিয়ায় আসেন। ঘোষণা দেন সত্য ঘটনা অবলম্বনে নতুন কওে লেখার। বিপত্তি শুরু হয় সেই থেকে। সামনে আসতে থাকে প্রেমের কবিতার ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা একজন রাজনৈতিক কর্মীর জীবন। সেই আড়াল ছেড়ে বাইরে আসতেই জীবনে দ্বিতীয়বার টার্গেটে পরিণত হন। তাকে যারা একদিন আক্রমণ করেও ছেড়ে দিয়েছিল, তারাই আবার সক্রিয় হয়।
শ্রাবণ প্রকাশনীর সামনে কয়েকজন পাঠকের কাছে ‘বইটি কেন কিনেছেন?’-জানতে চাইলে তারা বলেন, তরুণদের লেখা উপন্যাসই আমরা কিনতে চাই। তাদের উৎসাহ দিতে চাই। উৎসাহ আর প্রেরণা পেলে তাদের মধ্য থেকেই বের হয়ে আসবে এক একজন শরৎচন্দ্র কিংবা হুমায়ূন আহমেদ। তারা আরও বলেন, আমাদের সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ ধারা উপন্যাস। তবে বর্তমানে তেমন জনপ্রিয় উপন্যাস কিংবা ঔপন্যাসিক নেই বললেই চলে। এ শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে আমাদের তরুণ লেখকরা।
এদিকে, মাত্র একদিন আগে মেলার ১৭তম দিনের সকালে প্রকৃতির বৈরিতায় ঝড়-বৃষ্টি মেলাপ্রাঙ্গণের বিভিন্ন প্রকশনার সংস্থার সাজানো স্টল, বই ভিজিয়ে এক বিষাদময় আবহের সৃষ্টি করে। মেলা মাঠের বেশ কিছু স্থানে পানি জমে যায় পানি, মেলার দূর্যোগ মেকাবেলায় নিয়োজিত ফায়ারসার্ভিসের কর্মীদের সেই পানি নিষ্কাশনের পরেও হালকা জমে থাকা পানির সঙ্গে যোগ হয় কাদার উপদ্রুপ। সেসব প্রতিবন্ধকতা ঠেলে এদিন বিকেল ৩টায় মেলার প্রবেশ পথ খুলে দিলে ধীরে ধীরে জমে ওঠে মেলা। দূর্যোগপূর্ণ দিনের সেই জমে ওঠা মেলা আজ দূর্যোগহীন ১৮তম দিনে এসে ফিরে পেল প্রাণ। দেখা মিললো প্রকৃত বইপ্রেমীদের বাঁধভাঙা এ জনস্রোত। যে জনস্রোতে মেলাপ্রাঙ্গণ ঘুরে ঘুরে কিনে নিচ্ছেন মেলার প্রথম দিকে সংগ্রহ করা তালিকা থেকে তাদের পছন্দের সব বই।
এবারের বইমেলার কিছু নতুন উপন্যাস:
কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে সেলিনা হোসেনর ‘সময়ের ফুলে বিষ পিঁপড়া’, লেখক ও সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি’র ‘জিন্দালাশ অথবা রমেশ ডোম’, সুমন্ত আসলামের ‘এক মায়াবতী আমার’, মাহবুব আজীজের ‘এইসব কলহাস্য’ এবং সাংবাদিক ও সংবাদ উপস্থাপক পারমিতা হিমের‘উত্তম ও মানসীর রহস্যময় প্রেম’-সহ বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের নতুন উপন্যাস ‘মায়ামুকুট’-সহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে আফজাল হোসেনের ‘একাকী আকাশ ওখানে’, আফতাব হোসেনের ‘জীবন সায়াহ্নে’ এবং সুহান রিজওয়ানের ‘পদতলে চমকায় মাটি’। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে এসেছে সদ্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের ‘‘লুইপা’র কালসাপ’’ ও জুলফিয়া ইসলামের ‘করাঘাতের শব্দ শুনি’-সহ বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয়েছে হরিশংকর জলদাসের ‘সুখলতার ঘর নেই’, আনিসুল হকে ‘এই পথে আলো জ্বেলে’, জাকির তালুকদারের উপন্যাস ‘মৃত্যুগন্ধী’ ও মাসরুর আরেফিনের ‘আগস্ট আবছায়া’ ইত্যাদি। অন্যনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের ‘একাত্তর ও একজন মা’, পরিতোষ বাড়ৈ’র ‘একাত্তরের আকাশে কালোমেঘ’, ড. নাসরীন জেবিনের ‘অব্যক্ত’ এবং রীনা গুলশানের ‘নিভৃতে’-সহ বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে হাসনাত আবদুল হাই’য়ের ‘ফেসবুকে কয়েকদিন’, চিত্তরঞ্জন দাসের ‘কপোতাক্ষের হাসিকান্না’, তাশরিক-ই-হাবিবের ‘নাইয়র’-সহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস।
অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে সাংবাদিক নঈম নিজামের ‘অন্ধকার জগতের কাহিনি’, পিয়ারা বেগমের ‘শেষ প্রহরের আলোয়’ কিঙ্কর আহ্সানের ‘বিবিয়ানা’ ও মালিহা তাবাসসুমের ‘বৃত্তবন্দি’-সহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। তাম্রলিপি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তরুণ উপন্যাসিক মাজহার সরকারের ‘নেমক হারাম’ সহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ইশিতা জেরীনের ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’, আবুল ফাতাহ’র ‘প্রযতেœ অভ্র’ ও বাদশাহ্ সৈকতের ‘পলায়ন’ সহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে লেখক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের ‘অগ্নি মানুষ’, দীপু মাহমুদের ‘আলমপনা’ ও তৌহিদুর রহমানের ‘অতসী’-সহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘হটলাইন’, ফারাহানা হোসেনের ‘বারো গলি তেরো জাত’ ও কনক আচার্যী’র ‘গার্ণ’-সহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস। এবং সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে এ.এন.এম নূরুল হকের ‘বৃহন্নলার অবগুন্ঠন’, হাবীবুল্লাহ ফাহাদের ‘জলপাই রঙের দিনরাত’ ও জোহরা বেগমের ‘উষসী’ সহ আরও বেশ কয়েকজন লেখকের উপন্যাস।
সারাবাংলা/এমআরপি