Saturday 10 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সর্বজনীন নতুন ঠিকানা একুশে গ্রন্থমেলা


৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:৩১ | আপডেট: ১০ মে ২০২২ ১৫:২৯

এসএম মুন্না 

এটাইতো স্বাভাবিক। গ্রন্থমেলায় বই নিয়ে রাজ্যের সব কায়-কারবার হবে। থাকবে বইমনস্ক মানুষের ভিড়। আড্ডা কিংবা তর্কের বিষয়বস্তুও হবে বই। মেলা আগতদের হাতে থাকবে সদ্য কেনা বই। বাড়তি পাওনা ঘুরতে ঘুরতে সামনে পড়ে যায় যদি অনেক দিন ধরে না দেখা কোনো প্রিয়জনকে। তাকে জড়িয়ে বলা ‘বন্ধু কী খবর বল’-ঠিক এমনটাই হয় গ্রন্থমেলায়।

ফেব্রুয়ারি এলেই উৎসবপ্রিয় বাঙালির উচ্ছ্বাস বেড়ে যায়। সবার মাঝেই দেখা দেয় দেশ, ভাষা ও স্বাধীনতার জন্য টান। নানা কারণে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সবাই। আর এর সূচনাটা হয় অমর বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলার মধ্য দিয়ে। তখন বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে উঠে সবার নতুন ঠিকানা। আড্ডা দেয়ার জন্য হোক আর প্রয়োজনীয় কাজের জন্য হোক কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়ানোর জন্য হোক-এ স্থানটিকেই এ সময় বেছে নেন সবাই। প্রতিদিনই নানা বয়সী নানা মানুষের সমাগমে পরিণত হয় এক মিলনমেলায়। এবারকার গ্রন্থমেলার প্রথম দিন থেকেই লোক সমাগম বেড়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন সর্বজনীন নতুন ঠিকানা।

নির্ধারিত সময়ে মেলার দুয়ার খুলে দেয়ার পর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ভিড়। সন্ধ্যায় মেলার দুই প্রাঙ্গণ পরিনত হয় জনারণ্যে। প্রাথমিক নানা রকম ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর স্টলে তাকে তাকে এখন নতুন বই। সেসব বই থেকে বের হচ্ছে কাঁচা রঙের ঘ্রাণ। মেলা এবার আরও গোছালো। তাই মেলায় কোথাও কোনো হুড়োগুড়ি নেই। একা কিংবা দল বেঁধে মেলা ঘুরে বেড়াতে পারছেন নানা বয়সী পাঠক-ক্রেতা। অন্যবারের তুলনায় এবার শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তার কারণ এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্র হওয়ায় অনেক স্কুলে ছুটি চলছে। এ কারণে কিছুটা অবসর পেয়েছে ছোট্টমনিরা। তাই অভিভাবকের হাত ধরে আসছে মেলায়।

বিজ্ঞাপন

বইমেলার বয়স মোটে পাঁচ দিনে পড়লো। প্রকাশকরা বলছেন, ‘অচিরেই জমে উঠবে মেলা। পাঠক-দর্শনার্থীরা এখন নতুন বইয়ের খোঁজ নিচ্ছেন। পছন্দের বইটি কিনেও নিচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকে প্রিয় লেখকের কি কি বই আসছে এবং আগামীতে কি কি আসবে সেই তালিকাও সংগ্রহ করছেন। বই কেনার চেয়ে মেলায় একটু ঘুরে-ফিরে বিকেল কিংবা সন্ধ্যাটি কাটিয়ে আসাই প্রধান উদ্দেশ বেশিরভাগেরই।’

প্রকাশনী সংস্থা আগামী প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী ওসমান গনি বলেন, ‘লোক সমাগম ভালো। তবে কেনাকাটা শুরু করেনি সেভাবে। পাঠকরা খোঁজখবর নিচ্ছেন, কী কী বই এলো। আগামী দিনগুলো ভালো বিকিকিনি আশা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মেলার পরিসর বেড়েছে কিন্তু স্টল বিন্যাসের কোনো সৃজনশীলতা নেই। আরও সুন্দর করে মেলা সাজানো যেতো পারতো। মেলা একটি অংশে হওয়া উচিত বলে মনে করি। দুই নৌকায় পা দিলে যেমন সর্বনাশ হয়। তেমনিটা হচ্ছে মেলাকে দুই ভাগ করে আয়োজন করায় কেউ লাভবান হচ্ছে আবার কেউ লোকসান গুণছেন। এটাতো হতে পারে না।’

রাজধানীর উত্তরা আজমপুরের ৩ নং সেক্টর থেকে স্ত্রী রুশনে আরাকে নিয়ে মেলা এসেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। সময় প্রকাশনের প্যাভেলিয়নে খোঁজ করছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রবন্ধের বই ‘সংকট ও সুযোগ’। পেয়েও যান। উপন্যাসের চাইতে সাবেক এই আমলার বেশি আগ্রহ অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রবন্ধের। জানতে চাইলে তিনি এ কথা বলেন। আর তার অধ্যাপিকা স্ত্রীর পছন্দ চিরায়ত সাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস-গল্প। এ নিয়ে দু’জনের বেশ টানাটানি হলো কে কোন স্টলে আগে যাবেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করতে রুশনে আরা বললেন, ‘বয়স হয়েছে। অধ্যাপনা করার প্রয়োজনে অনেক কাঠখোট্টা বই পড়েছি। কিন্তু আমার বরাবর পছন্দ চিরায়ত উপন্যাস-গল্প। তাই এবারও বাসা থেকে পরিকল্পনা করে এসেছি চিরায়ত উপন্যাস-গল্পের বই কিনবো। স্টলে স্টলে ঘুরছি। পছন্দের বই পেলে কিনছি। মেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গতবার শেষ দিকে মেলায় এসেছিলাম। তখন ভিড় ছিল। এবার মেলার পরিবেশ ভালো লাগছে। গাদাগাদি ভীড় নেই। স্বচ্ছন্দে বই দেখা ও কেনা যাচ্ছে। পরিসর বাড়ায় আমাদের মতো বয়স্ক মানুষের বইয়ের প্রতি টান তৈরি হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

অনেকেই সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন এই মেলার জন্য। কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। কাফরুলের বেসরকারি চাকুরে জাহাঙ্গীর আলম রসূলের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘প্রাণের উচ্ছ্বাসে এবারও তিনি মেলায় এসেছেন। অন্যপ্রকাশের স্টল থেকে কিনেছেন হুমায়ূন আহমেদের একগুচ্ছ বই। এখন তিনি মেলা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। রসূলের মতো শত শত বইপ্রেমী ছুটে আসছেন মেলায়। মেলা বৃহৎ পরিসরে সম্প্রসারিত হওয়ায় অনেকেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজানা হাসানের প্রতিক্রিয়া, মেলার পরিসর বাড়ায় স্বচ্ছন্দে ঘুরে ফিরে বই দেখা-কেনার সুযোগ মিললো।’ একাডেমির প্রাঙ্গণও মুখরিত হয়ে উঠছে ছিল নানা বয়সী মানুষের পদচারণায়। পুকুড়পাড়, ভাষাশহীদের ভাস্কর্য, ফুলের বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত মেলায় আগতরা।

তবে মেলা পুরোপুরি গোছানো হয়নি এখনো। মেলা কমিটির পক্ষ থেকে এখনও স্টল বা প্যাভিলিয়নের নম্বর বোর্ড লাগায়নি। বাঁশ-কাঠের টুকরো, রাশি রাশি কাগজের টুকরোসহ হরেক রকমের আবর্জনায় মেলা প্রাঙ্গণের নাজুক অবস্থা। চলতে গিয়ে এসব আবর্জনা আর নির্মাণবর্জ্যে পদে পদে ঠোক্কর খেয়েছেন মেলা আগত বইপ্রেমী-দর্শনার্থীরা। বহুজনে পথ চলায় ধুলোয় ধূসর পরিবেশ। কাজেই ধুলো এড়াতে নাকে রুমাল চাপা।

একাডেমির দেয়া তথ্যমতে মেলার প্রথম চার দিনে নতুন বই এসেছে ২৮৫টি। ২০১৭ সালে মেলার তুলনায় ৭৬টি বই কম। গতবার মেলার প্রথম চার দিনে নতুন বই এসেছিল ৩৬১টি। রোববার মেলার চর্তুথ দিনে নতুন বই এসেছে ১১১টি। গতবার এসেছিল ১৩৯টি। চার দিনে নতুন আসা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছেÑঅর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘সংকট ও সুযোগ’, সেলিনা হোসেনের ‘আপন আলোয় দেখা, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘অ্যাতিনা’, আনিসুল হকের ‘ও বন্ধু কাজল ভোমরা’ (সময় প্রকাশন), হারুন হাবীবের ‘গণমাধ্যম ১৯৭১ : বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ (অন্যপ্রকাশ), মারুফুল ইসলামের ‘নতুন কার পাব বলে’, মোস্তফা কামালের ‘চন্দ্রমুখীর সুইসাইড নোট’ (অন্যপ্রকাশ), পলাশ মাহবুবের ‘না ঘুমানোর দল’, পিয়াস মজিদের ‘নাচ মারবেল ও গোধূলী (পাঞ্জেরী), হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি এবং অন্যান্য’, দেবাশীষ ঘোষের ‘ক্ষোভ’ (আগামী), মোশতাক আহমেদের ‘আত্মা সমগ্র’ ও ‘অমর মানব’ (অনিন্দ্য প্রকাশ), মহাদেব সাহার ‘অনন্তের বাঁশি’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘ভূতে নিল ইলিশ মাছ’, মুহাম্মদ ইব্রাহীমের ‘আমি কে’ (অনন্যা), হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘সময় অসময়’ (আদর্শ), হাসান আজিজুল হকের ‘আমার ইলিয়াস’ (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ), নাসির আহমেদের ‘প্রতীক্ষা তোমার জন্য’ ও ‘ভালো থাকার নির্দেশ আছে’, সোহরাব পাশার ‘চোখ ফেরালেই মাধবী নেই’ (রয়েল পাবলিশার্স), নির্মলেন্দু গুণের ‘একটি সন্তান সম্ভবা পাখির গল্প (অবসর), পলাশ মাহবুবের ‘ম্যানেজ মকবুল’ (উৎস প্রকাশন), সব্যসাচী হাজরার ‘রঙতুলিতে ছোপছাপ’ (কথাপ্রকাশ) অন্যতম। এদিকে সোহরাওয়াদী উদ্যানে শুরু হয়েছে নতুন বইয়ে মোড়ক উন্মোচন। রোববার এই মঞ্চে ১০টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে।

মেলার পঞ্চম দিন আজ সোমবার মেলার দ্বার খোলে যাবে বিকেল ৩টা। চলবে টানা রাত ৯টায় পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘আ জ ম তকীয়ূল্লাহ : জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আলী ইমাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন রতন সিদ্দিকী ও শান্তা মারিয়া। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সারাবাংলা/পিএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর