রয় অঞ্জনের ‘খেউরি ঘর’
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:৩১
স্তর বৈষম্যতাকে বলা চলে বাঙ্গালি সমাজের এক ঘুণ পোকা। যা যুগ যুগ ধরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসবাস করে আসছে, ঘাপটি মেরে আছে আজও। বর্তমানে এই বৈষম্যতার বড়ো মাপকাঠি হচ্ছে অর্থ। কিন্তু আমরা যদি আরো অনেকটা পেছন ফিরে তাকাই। তখন বৈষম্যতার মাপকাঠিতে অর্থ যেমন জাঁকিয়ে বসে ছিল, বসে ছিল আরো একটা মোটা দাগ। সেটা ছিল গোত্র বা উপাধি। গোত্র ভেদেই নির্ধারিত হতো পেশা অথবা পেশা ভেদে গোত্র। পেশা ভেদেই মেপে ফেলা যেত গোত্রের অর্থনৈতিক অবস্থা। এই অর্থনৈতিক অবস্থা বা পেশা-গোত্র থেকেই বাছ বিচার করা হতো উঁচু-নিচু স্তর। এই দুই ধরণের স্তরের সমতলকরণের একটা প্রচ্ছন্ন দৃশ্যপটই তুলে আনা হয়েছে এই বইতে।
‘সমতলকরণ’ এই শব্দটার উপরে বিশেষ খেয়াল রাখা হয়েছে পুরো বইটা জুড়ে। যেখানে নিজেদের অধিকার আদায় করতে অথবা কাউকে যোগ্য মর্যাদা দিতে সবার আগে শুরু হতো এবং হয় সংঘাত, আন্দোলন নিদেন পক্ষে দর কষাকষি, সেখানে এই সমতলকরণে কোত্থাও কোন ঘাত- প্রতিঘাত যেমন রাখা হয়নি, রাখা হয়নি কোন গোষ্ঠী কোন্দল বা সংঘাতকেও । বরং মানুষে মানুষে ভালবাসা, শ্রদ্ধা, অপরের হিত চিন্তা দিয়েও যে একটা সমাজকে পাল্টে দেওয়া যায় তার একটা ব্যবস্থাপত্র হচ্ছে এই বই। ছো্টোখাটো হিংসা, কুসংস্কার, পরশ্রীকাতরতাকে যেমন তুলে আনা হয়েছে আর সময়ের প্রবাহের সাথে সেই সবকে মুছেও দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত হৃদ্যতার সাথে । এখানে মূখ্য ভূমিকায় ছিলেন তখনকার সমাজপতিরা।
ধর্মে ধর্মে বিভেদের রেখা ভালবাসা আর সম্প্রীতির মাধ্যমে মুছে ফেলা সম্ভব হলেও , সেইসময়ে বর্ণ বৈষম্যতার পাঁচিল টপকানো ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। সেই দুরূহ কাজটাই মমতা আর মহানুভবতার জলে ধুইয়ে সাহ সুতোর করে ফেলার গল্পের নায়ক – বনমালী।
বনমালী একজন নিম্নবর্গীয় তথা পিছিয়ে পড়া জনজাতি শ্রেণীর মানুষ, পর্যায়ক্রমে সে ছেলে থেকে যুবক হয়েছে, যুবক থেকে পিতা । অন্য সে অর্থে দলিত শ্রেণীরও। সেই সময়ে নাপিত বলতেই অনাচার রূপে আচারের দৌরাত্ম্য ছিল ভীষণ! সমাজের চোখে তারা ছিলেন অচ্ছুৎ – অস্পৃশ্য। আবার এই নাপিতরাই জীবনের অতি প্রয়োজনীয় কাজ যেমন জন্ম-মৃত্যু- বিয়েতে সর্বাগ্রে ডাক পেতেন। যা সমাজপতি বা উচ্চবর্গীয়রা বেমালুম ভুলে যেতেন, স্বীকার করতেন না তাঁদের অপরিহার্যতার কথা।
পেশা বা গোত্র বদলে ফেলা এখন যেমন সকাল- বিকেলের ঘটনা। এমনটা আগেও ছিল। নিজেদের সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক স্বচ্ছলতা পরিবর্তনে এখন পেশা বা গোত্র পাল্টানো হামেশাই দেখা যায়। তখনো দেখা যেত, তবে তা আজকের দিনের মতো এতো সহজ ছিল না। সেই কঠিন কাজটাও এই বইয়ে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে ।
গল্পের পতিত জমিদার শশীবাবু, বারেক চেয়ারম্যান, মতিস্যার, দুবাই ফেরত কাদেরগংরা আবির্ভূত হয়েছেন সেই সমাজের ঘুণ সারানো প্রতিষেধক হিসেবে। যাদের মহান হাত এগিয়ে এসেছিল বনমালীর দিকে। যে হাত জগদ্বন্ধু চক্কোত্তি, পরিতোষ শীলদের পরশ্রীকাতরতায় ফস্কে যায় বার বার। তেমনি এক উত্থান- পতনের গল্প এই ‘খেউরি ঘর’।
লেখক রয় অঞ্জনের লেখা উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে ভাষাচিত্র প্রকাশনী। অমর একুশে বইমেলার ৩২ নং প্যাভেলিয়নে পাওয়া যাচ্ছে।
সারাবাংলা/এজেডএস