ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায়ও গল্প মেলে
৩০ মে ২০১৯ ২২:২৭
সড়ক নম্বর ৭/এ
ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে লেকের পাস দিয়ে বা দিকে চলে গেছে ৭/এ আর ডান দিকে লেক ঘেঁষে ১২/এ; ৭/এ তে লেকমুখি বাড়ি হাতে গোণা ক’টা মাত্র। এই গল্পটা এমন একটা বাড়ির পাঁচ তলার পশ্চিম পার্শ্বের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উঠে এসেছে।
পেনশন ও প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকাইতো শেষ ভরসা-এই টাকাটা ভাঙ্গতে হয়নি। নিজের কিছু সঞ্চয়, লাইলুন নাহারের রেখে যাওয়া টাকার অর্ধেকটা আর ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাঙ্কের একটা ডিপোজিট ভাঙ্গানো আর এটা ওটা মিলিয়ে নগদ টাকা দিয়েই রেডি অ্যাপার্টমেন্ট উঠেছেন। লাইলুনের টাকাটা আসলে বাবার সম্পত্তির হিস্যা। বিক্রি করেননি, ভাইয়েরাই দখল নিয়ে নিয়েছে, টাকাটা তাদেরই দেওয়া। হিস্যাটা বিক্রি করতে পারলে বাজারমূল্যে দ্বিগুণ পেত। ভাইয়েরা বোনদের ঠকিয়েই থাকে। তাও স্বামী জজ সাহেব বলে পেয়েছে, নতুবা বাজার দামের সিঁকিটাও পেত না।
রেডি অ্যাপার্টমেন্ট মানে একেবারে নতুন মনে করার কারণ নেই। আবার তেমন পুরোনোও নয়। ব্যবহৃত বাড়ি, বিক্রেতাই প্রথম বাসিন্দা। স্ত্রী বিয়োগের আগেই অ্যালজিমার্স ধরা পড়েছিল, স্ত্রী বিদায় হবার পর প্রকোপটা বেড়ে যায়, কেবলই ভুল করতে থাকেন হুমায়ুন খান।
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ছেলে শাকিল এসে বলল, বাবা যথেষ্ট হয়েছে আর নয়, তোমাকে নিয়ে আমাদের খুব টেনশন হয়, রাতে ভালো ঘুমাতে পারি না। রাতে ঘুম না হলেই তো বোঝোই, দিনটা কাটে ঝিমিয়ে, ঠিকমতো ক্যাব চালাতে পারি না। সিগন্যাল ভুল করে, ঠিকমতো পার্কিং না করে এর মধ্যে চারটা স্ট্রিকচার খেয়েছি। ওদের পুলিশ তো দশ-পাঁচ টাকার জন্য রাস্তায় বসে থাকে না। আর একটা এক্সিডেন্ট করলে ড্রাইভিং লাইসেন্সটাই বাতিল করে দেবে। তুমি এবারই আমার সাথে যাচ্ছ, এটাই ফাইনাল কথা ।
ছেলের এই আলটিমেটাম হুমায়ুন খানকে হঠাৎ স্বাভাবিক করে তোলে। তিনি বলেন, অসুস্থ মানুষের জন্য নিজের দেশই উত্তম। নতুবা কবর দেবার জন্য আবার তো এখানেই পাঠাতে হবে। আপার্টমেন্টটার কি হবে? তোরা কেউ ফিরলে একটা কথা ছিল।শাকিল বলল, বাবা আমেরিকাতে কবর দেওয়া যায় না এমন শুনেছ নাকি? আমাদের ওখানে অ্যালজিমার্সের একজন ভিআইপি প্যাশেন্ট আছেন। এক সময়ের নায়ক, এক সময়ের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান। লস অ্যাঞ্জেলেস শহরেই থাকেন। তুমি যাবার পর ভিআইপি প্যাশেন্ট একজন বাড়বে।
শাকিলের টেনশনে ঘুম না হবার কারণ ইভনিং ওয়াক করতে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হুমায়ুন খান কোথায় যে চলে গেলেন। পরদিন বিকেল বেলায় যে জায়গাটাতে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন তার নাম পাকিস্তান মাঠ। কেউ একজন বুঝতে পেরে অনেক খাটাখাটনি করে বাসায় নিয়ে এসেছেন।
ফাহিমার সাথে কথা বলে শাকিল সিদ্ধান্ত নেয় অ্যাপার্টমেন্ট ডিসপোজাল ও বাবাকে জোরজবরদস্তি করে নিয়ে আসার কাজটা এবারই সারতে হবে। ফাহিমাই বড়, থাকে আটলান্টাতে। বলেছে, বাবাকে আমিই রাখব। তবে অ্যাপার্টমেন্ট বেচার অর্ধেক টাকা আমাকে দিস।
শাকিল বলেছে পুরোটাই ট্রান্সফার করব। এসময় আমার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স নিল থাকাই ভালো। বেনেফিটের জন্য অ্যাপ্লাই করব।একটা অপরাধবোধ থেকে বেরোবার জন্য শাকিল এসে দুদিনের মধ্যেই সাজ্জাদের সাথে যোগাযোগ করল।
রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে একসাথে পড়েছে। তার অন্তত চার বছর আগে সাজ্জাদ স্টেটস পৌঁছে। স্টুডেন্ট ভিসায় সেও যখন যায়, নিউ ইয়র্কে সাজ্জাদের অ্যাপার্টমেন্টই শেয়ার করে। সাড়ে পাঁচ মাসে একটি ডলারও তাকে দেয়নি, সেও চায়নি। সাজ্জাদ রাতে ক্যাব চালাত, দিনে মোষের মতো ঘুমাত।
সাজ্জাদের ক্যারিবিয়ান গার্লফ্রেন্ড ইসাবেলাও এখানেই থাকত। মাস তিনেক সবই ভালো ছিল, তারপর কেমন প্যাচ লাগতে শুরু হয়। ইসাবেলার সাথে শাকিলের গল্প করার অঢেল সময়। গল্প করতে করতে নতুন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। রাতে ক্যাব দিনে ঘুম, ইসাবেলা শাকিলকে বলে আমি কি বুড়ো আঙ্গুল চুষবো নাকি? আই নিড অ্যা ম্যান, আই নিড সেক্স। আই অ্যাম নট অ্য রোবট।
ইসাবেলা পাঁচদিন হাসপাতালে জুনিয়র নার্স হিসেবে কাজ করে, কামাই সাজ্জাদের চেয়ে বেশি।
ইসাবেলাই শাকিলকে সাজ্জাদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তুলে নিল। সাজ্জাদ ইসাবেলাকে কিছুই বলল না, এমনকি শাকিলকেও না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এজন্যই শাকিলের প্রথম দিকে সন্দেহ ছিল সাজ্জাদ কায়দা করে ইসাবেলাকে তার কাছে গছিয়ে দিল না তো?
মাস তিনেক পর শাকিল একটা চিরকুট পেল, ‘ইসাবেলাকে নিয়ে সুখে থাকিস, ইসাবেলা খুব ভালো মেয়ে। আমার অ্যামেরিকান ড্রিম শেষ হয়ে গেছে। আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি।’
এই চিরকুটটি পাবার পর শাকিল ও ইসাবেলা দুজনই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল। এটা অপরাধবোধের অস্বস্তি।
সাজ্জাদ যদি শাকিলকে বাস্টার্ড এবং ইসাবেলাকে হৌর বলত, তাহলে দুজন একটু স্বস্তি পেত। কিন্তু তা হবার আর সুযোগ নেই।এসব অবশ্য অনেক আগের কথা। শাকিল ও ইসাবেলার টুইন আইডেন্টিক্যাল ডটার। বাচ্চাদের জন্মের দুমাস আগে দুজন বিয়ের কাজটা সেরে নিয়েছে। একটা মেয়ের নাম ক্যাসান্ড্রা, অন্যটা অ্যান্ড্রোমিডা।
ইস্কাটনে গার্ডেন রোডে তার একদা পরিচিত মালঞ্চ নামের সরকারি বাড়িটিতে গিয়ে শাকিল জজ সাহেবকে পেল। সাজ্জাদের বাবা আশরাফ হোসেন অবসরপূর্ব ছুটি শেষ করে খুব অনুনয় বিনয় করে তিন মাস অতিরিক্ত সময় থাকার অনুমতি পেয়েছেন, একমাস প্রায় শেষ, এখন বাড়ি খুঁজছেন, কম টাকায় পেলে কিনবেন, নতুবা ভাড়াই থাকবেন।
শাকিল অনেকটা টানাটানি করেই তাকে তাদের ধানমন্ডি রোড নম্বর ৭/এ-এর অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে এল।
তিনি বললেন, আমি মাপা টাকার মানুষ, ধানমন্ডি আমার জন্য নয়। যাত্রাবাড়ি কি শনির আখড়া ওদিকে একটু কম দাম ফ্লাট পাওয়া যাচ্ছে বলে আমার পুরোনো সেরেস্তাদার বলেছে। তাকে খোঁজ নিতে বলেছি।
মালঞ্চে দ্বিতীয় আগমনের সময় শাকিল বলল, নিউ ইয়র্কে আমি শাকিলের বাড়িতেই উঠেছিলাম। ও সাহায্য না করলে আমি আমেরিকায় টিকতে পারতাম না। আমি অ্যাপার্টমেন্টের দামটা আপনার সাধ্যের মধ্যেই এনে দেব।
সাজ্জাদ বলল, দাতা হাতেম তাঈ সাজার দরকার নেই।
শাকিল দ্রুত একটা মিথ্যে বানিয়ে বলে সাজ্জাদের মন নরম করে ফেলল। বলল, ইসাবেলা বলেছিল ছেলে হলে নাম রাখবে সাজ্জাদ। কিন্তু হয়ে গেল এক জোড়া মেয়ে।
শেষ পর্যন্ত প্রায় কোটি টাকা দামের অ্যাপার্টমেন্ট পঁচাত্তর লাখ টাকায় আশরাফ হোসেনকে দিয়ে, টাকাটা দ’ুনম্বরি পথে ফাহিমার একাউন্টে ট্রান্সফার করে শাকিল বাবাকে নিয়ে চলে গেল।
আমার ইভনিং ওয়াকের সঙ্গী জজ সাহেবের কাছে এটুকু শোনার পর তিনমাস তার আর হদিস পাইনি।
২.
ইউরোপ আমেরিকায় এবং হালে ঢাকায়ও দ্রুত বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড পাল্টাবার মতো আমরাও ওয়াকিং পার্টনার বদল করে থাকি। এর মূল কারণ ওয়াকারদের শারীরিক অবস্থা। আজ ভালো তো কাল বিছানা ছাড়া দায়।
প্রায় তিনমাস পর আমার হাঁটাপথে আবার তাকে দেখে আমার অন্তর্বর্তীকালের সঙ্গীকে এক্সকিউজ মি বলে একলা পথে ছেড়ে দিয়ে তার সামনে হাজির হয়ে বলি, স্যার কি হসপিটালাইজড হয়েছিলেন?
তিনি বললেন, দেখে কি সে রকম মনে হচ্ছে?
বললাম, না স্যার, চেস্ট পেইন নিয়ে আমি নিজেই গতমাসে হৃদরোগ হাসপাতালে এগার দিন কাটিয়ে এসেছি। ভালোই কেটেছে। আমরা তো এক ডজন ভাইবোন, আজ রাতে এ বোন তো কাল রাতে ও ভাইয়ের বউ- এভাবে ডিউটি করেছে। যারা এবার চাঞ্চ পায়নি, বুকিং দিয়ে রেখেছে যারা এবার নাইট ডিউটি করার সুযোগ পায়নি, নেক্সট টাইম যেন তারা প্রায়োরিটি পায়।
জজ সাহেব বললেন, ভাইবোন আমরাও তো নয়জনই ছিলাম, এখন অবশ্য পাঁচজন টিকে আছি। ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক সন্তান দুটিই যথেষ্ট’ এই খপ্পরে না পড়লে আমাদেরও আট-দশ জন ছেলেমেয়ে হতো। অবশ্য এখন বাড়িঘরের যে অবস্থা বেশি হলে বিপদেই পড়তাম।
আমি তার সাথেই হাঁটছি। অন্তর্বর্তী সময়ের গল্পটা তিনিই শোনালেন। পঁচাত্তর লাখ টাকায় ছেলের বন্ধু যে অ্যাপার্টমেন্ট তাকে দিয়েছে এর দাম এখন দেড় কোটি। বড় একটা মাস্টার বেড, দুটো বেডরুম, একটা গেস্টরুম, বড় একটা ড্রইংরুম। এই বাড়িতে উঠার দ্বিতীয় বছর তার স্ত্রী লাইলুন নাহার বরিশালের আমড়া খাবার সময় গলায় আমড়া আটকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলেন।
তিনি বললেন, গলায় কৈ মাছ আটকে মানুষ মারার খবর পত্রিকায় পড়েছি, কিন্তু আমড়া আটকে মরা পৃথিবীতে এটাই প্রথম।
স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি একাই এত বড় বেডরুমটি দখল করে রেখেছিলেন। রুমের বিশালত্ব তার ফুসফুসের উপর কেমন একটা চাপ সৃষ্টি করত, শ্বাস নিতে কষ্ট হত। সাজ্জাদ যখন সদ্য ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢোকা নাইমাকে বিয়ে করল, তিনি বেডরুমটা তাদের সাধলেন।
সাজ্জাদ বলল, রুমটাতে মায়ের স্মৃতি, বাবা তুমিই থাকো।
নাইমা বলল, বাবা, আপনার নাতি-নাতনি হলে বড় রুম লাগবে, তখন আপনারটাতে চলে আসব। এখন মাঝেমাঝে আমরাও আপনার রুমে আসব, সময় কাটাব, তাতে আপনি লোনলি ফিল করবেন না।
কোনো সন্দেহ নেই নাইমা আসলে এই রুমটাই চেয়েছে, হয়ত শাকিলেরও তা-ই চাওয়া। তবুও বলেছে, বাবাই থাকুক। আফটার অল বাবাতো।
এই রুমটাতে একটা কমদামি এয়ার কন্ডিশনার আছে। কিন্তু লাইলুন নাহারের মৃত্যুর পর শরীর ঠান্ডা করার জন্য তিনি এটার সুইচ অন করেননি। তবে এটাকে চালু রাখার জন্য দু’তিন মাস পরপর একবার মিনিট পাঁচেক করে চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনিতেই তো আর ঠান্ডা বাতাস দেয় না, বিদ্যুতের বিলও বাড়ে।
সকালের দিকে তার প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করে, কাজ থাকলে দুপুরের পর বেরোন।
নাইমা জ্বর নিয়ে ছুটিতে। দুপুরের পরপরই তিনি যখন পেনশনের টাকা তুলতে সোনালী ব্যাঙ্কে, নাইমা এই রুমে ঢুকে এয়ার কন্ডিশনার ছেড়ে শ্বশুরের বিছানাতেই শুয়ে পড়ে, ঘুমও এসে যায়। নাইমা চিৎকার করে যখন ঘুম থেকে জেগে উঠে, জজ সাহেব ততক্ষণে ফিরে এসেছেন, বৌমা ঘুমোচ্ছে দেখে ভেতরে ঢুকে আবার বেরিয়ে এসে বহুবছর আগে কেনা মওলানা আবুল কালাম আজাদের ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম বইটা বের করে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়তে শুরু করেন।
চিৎকার শোনার পর কি হয়েছে কি হয়েছে বলতে বলতে তিনি যখন ভেতরে ঢুকলেন দেখলেন নাইমা বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে বাম হাতে থুতনি ধরে ডান হাতে গলায় আঙ্গুল দিয়ে একটা কিছু বের করার চেষ্টা করছে। আবার জবাবও দিচ্ছে, বাবা আমার গলায় আমড়া আটকে গেছে।
তিনি বললেন, আমড়া পেলে কোথায়? এটা তো আমড়ার সিজন নয়। তুমি কি স্বপ্ন দেখছিলে?
নাইমা ধাতস্ত হয়। বলে, সরি বাবা, মনে হয় স্বপ্ন দেখছিলাম। আমার মুখে কে যেন জোর করে একটা আমড়া ঢুকিয়ে দিচ্ছিল।তিনি কপালে হাত রাখলেন, জ্বর নেমে গেছে।
নাইমার মন ভালো করার জন্য সে রাতে তিনি নাইমা, সাজ্জাদ আর ইংরেজিতে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়া মেয়ে সিঁথিকে নিয়ে চাইনিজ খেতে এলেন।
বললেনও, তোমাদের মা কখনো কখনো বাইরে খেতে যেতে চাইত। কিন্তু আমার তো জজের চাকরি-মানুষ আমাকে যত কম দেখে ততই ভালো। আমি বলতাম আনিয়ে দিচ্ছি।
তোমাদের মা বলত, থাক লাগবে না।
থাই স্যুপে চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, আমার বাড়িতে কখনো আমড়া কেনা হবে না। সবাই এটা মনে রেখো।
নাইমার দুঃস্বপ্নের পর তার এয়ার কন্ডিশন্ড বেডরুমের ব্যাপারে নাইমাও আগ্রহ হারালো।নাইমার একটি মিসক্যারেজ হয়ে গেল।এর মধ্যে সিঁথি পাশ করল, বিয়ে করল অনেকটা চালচুলোহীন পনের হাজার টাকা বেতনের এক এনজিও চাকুরেকে।
সাজ্জাদেরটা জজ সাহেবের পছন্দের বিয়ে, ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইতিমাতউদ্দিনের মেয়ে নাইমা, দেখতে এক কথায় সুন্দর। একটু শুকনো। সমস্যা নেই। বিয়ের পর প্রতিমাসে দু কেজি করে ওজন বাড়বে।
সিঁথির পছন্দের আতাহার আলী সম্পর্কে তিনি ভালোমন্দ কিছুই বলেননি। শুধু মেয়েকে বলেছেন, পনের হাজার টাকার মধ্যে বাড়ি ভাড়া কত দিবি আর খাবি কি?
সিঁথি বলল, নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি বলে বের করে দেবে নাকি? ও থাকবে মেসে, আমি আমার রুমে, মাঝে মাঝে আসবে, অবশ্য তুমি যদি অ্যালাও করো।
অগত্যা তাকেই বলতে হলো, হাশমত আলীকে বল মেসের পাট চুকিয়ে তোর রুমেই এস উঠুক।
সিঁথি বলল, বাবা, ওর নাম হাশমত আলী না আতাহার আলী।
তারপরই বাবাকে এসে হাগ করল, বলল, আমি জানতাম তুমি একটা সল্যুশন বের করবে।
বাজার-সদাই তিনিই করেন। মূল খরচটা তারই। ছেলে ও মেয়ে কখনো ফেরার সময় এটা ওটা খাবার কিনে আনে। তিনি বলেন, এভাবে টাকা নষ্ট করিস না, টাকাটা জমা। কাজে লাগবে।
সাজ্জাদ বলে বাবা তুমি ডিভ্যালুয়েশন বোঝ? এখন পঞ্চাশ টাকায় মুরগির একটা ড্রামস্টিক কিনতে পারবে। কুড়ি বছর পর এই টাকায় মুরগির একটা ছবি পাবে। ছবি তো খাওয়া যাবে না।
মুরগির রান যে ড্রামস্টিক এটা জজ সাহেব জানতেনই না। ছেলেমেয়েদের কাছে শুনে শিখেছেন।
সিঁথি ও নাইমার মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারত, হয়নি। সিঁথির বিয়ের পর সম্পর্কটা ক্রমেই ভাটির দিকে যেতে থাকে। আভাসে ইঙ্গিতে নাইমা তাকে বুঝিয়ে দেয় বিয়ের পর মেয়েদের আর বাবার বাড়িতে থাকা ঠিক নয়।
এর মধ্যে সাজ্জাদ ও নাইমার মধ্যে কয়েক দফা ঝগড়ার শব্দ তিনি পেয়েছেন। ঝগড়া অবাক করা কোন ব্যাপার নয়। এটা রুটিনওয়ার্ক। এ রকম আমৃত্যু চলতেই থাকবে। এর মধ্যে বাচ্চা হবে, বাচ্চা বড় হবে। স্ত্রী বলবে, বাচ্চাগুলো না থাকলে তোমার মতো অপদার্থের সাথে কে ঘর করত? লাইলুন নাহারের মতো কম কথার মানুষই এ কথা তাকে সকাল-বিকাল শোনাতেন। এমনিতে স্ত্রীর সামনে তেমন মুখ না খুললেও তিনিও একদিন শুনিয়ে দিলেন, তোমার কি ধারনা বাচ্চাদুটো না থাকলে আমি তোমার সুন্দর চেহারা দেখার জন্য পড়ে থাকতাম?
এমন কথা হতেই পারে। কিন্তু সুন্দর চেহারার কথা বলে জজ সাহেব লাইলুনকে খুব বড় রকমের একটা আঘাত দিলেন। লাইলুন কোনোভাবেই সুদর্শন নন। পাত্রী দেখতে গেলে পাত্রপক্ষ যে ধরনের চেহারার মেয়ে রিজেক্ট করে থাকে লাইলুন সে দলের। দু’তিনটি প্রত্যাখ্যান তার ভাগ্যেও জুটেছে। কিন্তু নতুন চাকরিতে ঢোকা মুনসেফ আশরাফ হোসেন রাজি হয়ে গেলেন। পাত্রী দেখতে গিয়ে নন্দনতত্ত্বের উপর রীতিমত একটা লেকচার ঝেড়ে দিলেন; সুন্দর চামড়ায় নয়, অন্তরে। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর মেজো কাকিমা কাকাকে পথে বসিয়ে নিজেই পাগল হয়ে যান। পেতলের কলসিতে মাটি ভরে নিজের শরীরের সাথে বেঁধে রমজান মাসে সেহেরির সময় ইদারায় লাফ দেন। লাশ উঠে পরদিন বিকেলে। তার ভাই হত্যা মামলা করলে পুলিশ এসে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কাকাকে হাজতে নিয়ে গেল।
চেহারার খোঁচাটা লাইলুন হজম করতে পারেননি। পুরো একটা দিন কেঁদেছেন। এরপর জজ সাহেবের মুখে সুন্দর চেহারার খোঁচা আর কেউ শোনেনি।
সাজ্জাদ ও নাইমার ঝগড়ার মধ্যে আকস্মিকভাবে ইসাবেলার নাম এসে যায়। নাইমা তাকে যাচ্ছে তাই গালাগাল দেয়। সাজ্জাদ হুঙ্কার দেয় তার গালাগাল দেবার ক্ষমতা চিরদিনের মত স্তব্ধ করে দেবে। সম্ভবত তার গলার দিকে হাতও বাড়ায়। নাইমা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে আসে। দরজায় কয়েকটা লাথির আওয়াজ শোনা যায়। রাত তখন সাড়ে তিনটা।
নাইমা অচিৎকার করে আশরাফ হোসেনকে বলে, শুনুন জজ সাহেব, আমি আপনাকে আর বাবা ডাকতে চাই না, আপনি একটা বাজে ছেলে জন্ম দিয়েছেন। আমার সরলসোজা বাবাকে পটিয়ে এমন একটা অপদার্থ ছেলের জন্য আমাকে নিযে আসতে আপনার লজ্জা করল না? আপনি একটা প্রতারক, ঠগ।
তিনি কেবল বললেন, শোনো মা, আমার কথা শোনো।
আমি আপনার কোনো কথা শুনব না। আপনার স্ত্রী গলায় আমড়া আটকে মরেছেন নাকি আপনারা তার গলায় আস্ত আমড়া ঢুকিয়ে তাকে মেরেছেন? আমি জামালপুর চলে যাচ্ছি। আমাদের কলেজ রোডের বাসায়। নাইমা কাঁদতে শুরু করে।
তিনি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন ভোর হতে আরো তিন ঘন্টা বাকী। সাজ্জাদ অপদার্থটার সাথে তোমার আর থাকার দরকার নেই। আমি তোমাকে দিয়ে আসব। কিছুক্ষণ তুমি আমার রুমে ঘুমাও, আমি গেস্টরুমে যাচ্ছি। নাইমাকে প্রায় ঠেলে তিনি যখন নিজের রুমে ঢোকাচ্ছেন পাশের রুমে সাজ্জাদ চিৎকার করছে, বাবা, ওকে ঘাড় ধরে বের করে দিন।
তিনি নাইমাকে বললেন, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দাও, সাজ্জাদ ডাকলেও খুলবে না।
নাইমা তাকে ধমকে উঠে, আপনি আমাকে আর মা বলবেন না। আপনাদের সাথে আমার সম্পর্ক শেষ। আমি কালই নারী নির্যাতন আইনে সাজ্জাদের বিরুদ্ধে মামলা দেব, আপনাকেও আসামি করব।
জজ সাহেব বললেন, ঠিক আছে মা, মামলা করো। এখন একটু ঘুমাও।
৩.
গেস্টরুমটা বেডরুমের সিঁকি ভাগ, কিন্তু একজন অতিথির আরামদায়ক অবস্থানের জন্য যা যা দরকার সবই আছে, আটাচড বাথরুমটা একেবারে দামি হোটেলের বাথরুমের মতো। রাতের বাকী অংশটা তার ভালোই কাটল। শুরুতে মনে হয়েছিল সার্কিট হাউসে আছেন। ততক্ষণে ঘুম এসে যায়। তিনি যখন বেরোলেন দেখলেন ডাইনিং টেবিলে পাঁচজনের নাস্তা সাজানো। কেউ খায়নি। দরজাগুলোর দিকে তাকালেন, সম্ভবত কেউ ঘুম থেকে উঠেওনি।
সিঁথি ও তার স্বামী সাধারণত তৈরি হয়েই ন’টার দিকে বেরোয়। সাজ্জাদ রুম থেকে বেরিয়ে খেতে খেতে বলল, রাতে খাবে না, এমনকি নাও ফিরতে পারে।
জজ সাহেব বললেন, রাতের ঢাকা নিরাপদ নয়, বেশি রাত হলে ফেরার দরকার নেই।
এগারটার দিকে নাইমা বের হলো। খাবারটা গরম করতে তিনিই মাইক্রোওয়েভে দিলেন।
নাইমা বলল, সরি বাবা, আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। আসলে আপনি ভালো, সাজ্জাদই খারাপ। আমি তার সাথে আর থাকতে চাই না।
জজ সাহেব জানেন, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। তিনি এর উপর ভরসা করেই বললেন, তুমি আমার রুমেই ঘুমাবে, ওটাই এখন থেকে তোমার রুম। সাজ্জাদটার শাস্তি হওয়া দরকার।
লাইলুন নাহারের মৃত্যুর পর তিনি কখনো ভেতর থেকে দরজা বন্ধ রেখে ঘুমান নি। কারণটাও তিনি খোলামেলা বলে দিয়েছেন: যদি এমন হয় ঘুমের মধ্যেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের মতো একটা কারণ দেখিয়ে আজরাইল তার জানটা কবচ করে নেয়, যত টোকাই পড়–ক, তার পক্ষে শয্যা ছেড়ে ওঠে এসে দরজা খোলা সম্ভব হবে না। তখন শাবল চালিয়ে দরজা ভাঙ্গতে হবে। এই দরজা মেরামত করতে কয়েক হাজার টাকা লেগে যাবে। তার চেয়ে খোলাই থাকুক।
গেস্টরুম জীবনে ঘুমের মধ্যে তিনি শাপের শিসের মতো একটা শব্দ শোনার পরপরই এক ঝাপটা সুঘ্রাণ পেলেন। ঘ্রাণটা হালকা, সম্ভবত বেলি ফুলের। অন্ধকার রুমের ভেতর মানুষের ঘ্রাণ পেয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে?
বাবা আমি নাইমা। আপনার ঘরটাতে ভ্যাপসা গন্ধ, একটু এয়ার ফ্রেশনার ছিটিয়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা মা, বলে তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিনই নাইমা মিস্টি ঘ্রাণের এক কাপ কফি নিয়ে নাইমা শ্বশুরের রুমে ঢুকল। বলর, বাবা, এটা স্পেশাল, হেজেলনাট কফি।
এক চুমুক দিয়ে বললেন, দারুন তো! কোথায় পেলে?
ছায়ানটে আমার টিচার ছিলেন শহীদ খোন্দকার টুকু স্যার, এখন টরোন্টোতে থাকেন। স্যার ঢাকায় এসেছেন শুনে আমরা ক’জন দেখতে গিয়েছিলাম। স্যার আমাকে দিলেন চকোলেট, আর আপনার জন্য হ্যাজেলনাট কফি।
তুমি তোমার স্যারকে আমার কথা কি বললে?
বলেছি, আমার শ্বশুরবাড়িতে তিনিই একমাত্র ভালোমানুষ।
বলতে বলতেই নাইমা বলল, বাবা গলাটা একটু সোজা করুন তো।
কেনো তিনি বুঝতে পারছেন না।
নাইমা তার গলার নিচের দিকটা আলতো করে চেপে ধরল, বাবা, ব্যথা পাচ্ছেন?
না তো । কি হয়েছে?
বাবা, জায়গাটা অনেক ফুলে গেছে। ডাক্তার দেখানো দরকার।
সেরে যাবে। ডাক্তার দেখাতে গেলেই এক হাজার, টেস্ট দেবে পাঁচ হাজার টাকার। দরকার নেই।
বেডরুম থেকে ঘুরে এসে নাইমা তার হাতে একটা ছোট্ট খাম দিয়ে বলল, বাবা, এর ভেতর কিছু টাকা আছে। আপনি আজই ডাক্তারের কাছে যাবেন।
নাইমা বেরিয়ে গেল।
জজ সাহেব টাকা গুনতে শুরু করলেন। পাঁচশ টাকার কুড়িটা নোট। দশ হাজার টাকা। সাজ্জাদ, সিঁথি- ওরাও তো কমবেশি কামাই করে, কিন্তু কেউ তো এমন করে টাকা তুলে দেয়নি।
কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় আতাহার আলী বলল, বাবা আমি চৌদ্দ মাসের একটা স্কলারশিপ পেয়েছি- মাস্টার ইন ডেভলাপমেন্ট স্টাডিজ। সাসেক্সে। ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স।
তাই নাকি? ভালো খবর।
জ্বি বাবা। ব্রিটিশরা এনজিও সেক্টরেও কিছু স্কলারশিপ দিচ্ছে। আমারটা ওমেন এমপাওয়ারমেন্ট ফোকাসড। ওমেন এমপাওয়ারমেন্ট-এর কোনো একটা ইস্যু নিয়ে ডিসার্টেশন লিখতে হবে।
খুবই ভালো। সিঁথিও কি যাবে? প্রোগ্রাম কবে শুরু?
মূল কোর্স অক্টোবর থেকে, তার আগে দুমাস অরিয়েন্টেশন ও ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স। সিঁথিকে বলিনি, কনফার্মেশনের জন্য ওয়েট করছিলাম। আজ পেয়েছি, এখন বলব।
প্রায় একমাস হয়ে গেল নাইমা ও সাজ্জাদের মধ্যে সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। সময়ই শ্রেষ্ঠ উপশমকারক-এই তত্ত্বেও উপর জজ সাহেব ভরসা করে আছেন।
এর মধ্যেই সিঁথি ও আতাহারের মধ্যে ভীষণ লেগে গেল। চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনি গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে আসেন।সিঁথি আতাহারকে বলে চলেছে, গেট আউট। এটা আমার বাবার বাড়ি। এটা তোর বাবার বাড়ি না। এক্ষণ এ বাড়ি থেকে বের হ।
আতাহার ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।
তিনি সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা করছেন। যতটুকু বুঝেছেন; সাসেক্স-এ মাস্টার ডিগ্রি করার জন্য এনজিও সেক্টর থেকে আতাহার ও লম্বু সীমা (প্রকৃত নাম কেউ বলেনি। মেয়েটি নিশ্চয়ই লম্বা, নাম সীমাই হবার কথা) বৃত্তি পেয়েছে। ২৮ জুলাই দুজন একই ফ্লাইটে ঢাকা থেকে রওয়ানা হবে।
সিঁথি বলল, লম্বু সীমা যাবে না।
কেনো?
বেশ তাহলে তুমি যাবে না।
স্কলারশিপ এবার মিস করলে আর কখনো পাবোনা। তাছাড়া সিলেকশন কি আমার হাতে?
বেশ তাহলে সীমা যাবে না।
তাকে বৃত্তি দেবার বা বৃত্তি বাতিল করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমি এসব নোংরামিতে যাবো কেনো?
কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সিঁথি যখন আতাহারকে জজ সাহেবের সামনে ফকিন্নির বাচ্চা, এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা বলল, এবার হঠাৎ রেগে যাওয়া ছেলেটি চিৎকার করে বলল, আপনি যদি এখনই ওকে চুপ না করান তাহলে আমি আপনার সামনে ওর জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলব। আমি সাসেক্স যাবার আগে তোকে এমপাওয়ারমেন্ট শিখিয়ে দেব।
বাড়াবাড়ি যে সিঁথিই করছে তিনি তো দেখতেই পাচ্ছেন, কিন্তু আতাহারের হুঙ্কারের পর তিনি ভড়কে গিয়ে বললেন, তুমি শান্ত হও, আমি দেখছি।
আতাহার বলল, আমি ওকে এখনই তালাক দিয়ে এখান থেকে চলে যাবো।
জজ সাহেব সিঁথিকে ধমক দিলেন। আতাহার বলে উঠল, আই উইল নেভার টাচ হার। আমি তার সাথে থাকব না।
জজ সাহেব বললেন, ঠিক আছে। ওর সাথে থাকার দরকার নেই। তুমি এই গেস্টরুমটাতে থাকো।
জজ সাহেব আতাহারকে গেস্টরুমে ঢুকিয়ে রাতের বাকী সময়টুকু কাটাবার জন্য পুরোনো আমলের থ্রি সিটার সোফার উপর কেবল একটি বালিশ ফেলে শুয়ে পড়লেন। ড্রইং রুমটা বেশ খোলামেলা। বদ্ধরুমে ফুুসফুসের উপর যে চাপটা অনুভব করতেন এখানে সে চাপ নেই। অবাক হলেন, এই সোফাতেই তার স্মরণকালের সবচেয়ে ভালো ঘুম হলো। ইন্দুরকানি থেকে আত্মীয়-পরিজনহীন ঢাকা শহরে আইএ পড়তে এলেন, সোয়ারিঘাটে এক দূর সম্পর্কের মামার চায়ের দোকানে লম্বা বেঞ্চের একদিকে কাপড়ের ছোট পুটলিটাকে বালিশ বানিয়ে তার উপর শুয়ে পড়তেন। সতর দিন পর একটা লজিং পেয়ে যাওয়ায় বেঁচে যান। একবার বেঞ্চ থেকে পড়ে মাটিতেই ঘুমিয়েছিলেন, কিছুই টের পাননি। সেই বেঞ্চের তুলনায় এই থ্রি সিটার সোফা তো স্বর্গ।
জজ সাহেব বললেন, গত একুশ দিন ধরে এই সোফাতেই ঘুমাচ্ছিলেন। আমাদের হাঁটার রাউন্ড সেদিনের মতো শেষ হয়ে আসছে।
জজ সাহেব বললেন, ভাগ্যিস আমার আর সন্তান নেই, তাহলে নির্ঘাৎ বাড়ি ছেড়ে আপনাদের ঐ রবীন্দ্র সরোবর খোলা আকাশের নিচে ঘুমাতে হতো। অবশ্য ওদিকটাতে মশা, বেশ্যা আর পুলিশের সমান উৎপাত। সাজ্জাদ, নাইমা, সিঁথি ও আতাহার আলী যার যার ইগো পুঁজি করে ভালোই জীবনযাপন করছে।
আর তিনিও সোফাতে আরামেই আছেন। সব মিলিয়ে ধানমন্ডি ৭/এ সড়কের ছতলা বাড়ির পাঁচতলার এই অ্যাপার্টমেন্টটিতে এক ধরনের শান্তিপূর্ণ স্থিতবস্থা বজায় আছে।
জজ সাহেব ভাবলেন, ভাগ্যিস গলায় আমড়া আটকে লাইলুন নাহারের মৃত্যু হয়েছিল, বেঁচে থাকলে তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে এই থ্রি সিটার সোফাতে সংসার করাটা খুব বিব্রতকর হতো।
টীকা:
১. ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার সড়ক নম্বর ৭/এ-এর পাঁচ তলার সেই অ্যাপার্টমেনটির প্রথম মালিক হুমায়ুন খান অ্যালজিমার্স রোগ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া গেলেন। ৪ জুন ২০০৪ তার মৃত্যু ঘটে। ঠিক তার পরের দিন মারা যান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান। দুজনেই আমেরিকাতে সমাহিত হন।
২. সাজ্জাদ ও নাইমার সেই ঝগড়ার পেছনে ইসাবেলার পাঠানো মেরি ক্রিসমাস কার্ড। ইসাবেলা সাজ্জাদকে যে ক্রিসমাস কার্ড পাঠিয়েছে তাতে সান্তা ক্লজের দুই কোলে ইসাবেলার দুই জমজ কন্যা ক্যাসান্ড্রা ও অ্যান্ড্রোমিডা। ছবির নিচে কলমে লেখা- এ দুটোকে তোমার বাচ্চা দাবি করে বসো না। – কৃতজ্ঞতার সাথে ইসাবেলা ।
ইসাবেলা ও শাকিল দুজনই স্বীকার করে সাজ্জাদ না থাকলে তাদের কখনো দেখাই হতো না। সুতরাং তারা সাজ্জাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কার্ডটা অফিসের ফোল্ডারে ছিল। নাইমা ফোল্ডার খুলবে এটা সাজ্জাদ কখনো ভাবেনি।
নাইমা বলল, বাচ্চা দুটো অনেকটাই তোমার মতো।
সাজ্জাদ বলল, আমি ইসাবেলাকে চিনতাম সত্য, কিন্তু বাচ্চা দুটো হয়েছে আমি আমেরিকা ছেড়ে আসার ২৭ মাস পরে। ২৭ মাস পেটে বাচ্চা রাখতে পারলে তো ইসাবেলার সাথে আমার নামও গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ উঠে যেতো।
নাইমা বলল, বেশি জ্ঞান দেবার চেষ্টা করো না। ডিপ ফ্রিজে রাখা স্পার্ম দিয়ে ২৭ বছর পরও বাচ্চা নেওয়া যায়।
৩. নাইমা জজ সাহেবের গলায় একটা স্ফিতি আবিষ্কার করেছিল, পরীক্ষা করানো জন্য টাকাও দিয়েছিল। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি এক বন্ধু ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার গলা থেকে টিশ্যু নিয়ে কালচার করতে দেন। ৭২ ঘন্টা পর রিপোর্ট বলে, কার্সিনোজেনিক গ্রোথ, মেটাস্ট্যাসিস হয়ে গেছে। জজ সাহেব আর কাউকে কিছু বলেননি। শুধু নাইমাকে বলেছেন, মা তোমার টাকা সবটাই কাজে লেগেছে।
নাইমা জিজ্ঞেস করে, মানে?
তিনি বলেন, এতো টাকা খরচ করে ইনভেস্টিগেশন করানোর পর যখন জানা যায় কিছুই হয়নি তখন মনে হয় টাকাটাই মার গেল।কি খবর বাবা?
জজ সাহেব বললেন, কাউকে বলো না মা, ডাক্তার সাহেব বললেন আর বছর দুয়েক আছি।
মানে?
জাস্ট টু ইয়ার্স। অপারেশন, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি এসব করে দেখতে দেখতে দু’বছর চলে যাবে।
নাইমা বলল, বাবা, আজ রাত থেকে আপনি বেডরুমে ঘুমোবেন।
তুমি? তুমি কোথায় থাকবে?
বাবা, সাজ্জাদ সরি বলেছে। আমি অলরেডি শিফট করে ফেলেছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকটা হাত ধরাধরি করে পপকর্ন খেতে খেতে সিঁথি ও আতাহার আলী ঢুকল। সিঁথি ঢুকেই বলল, বাবা, আমিও সাসেক্স যাচ্ছি। অন পেমেন্ট একটা শর্ট কোর্স করব। আপাততঃ ছ’মাসের ছুটি পেয়েছি।
একই রাতে জজ সাহেবের বাসার থ্রি সিটার্স সোফা এবং গেস্টরুম খালি হয়ে গেল।