ভালোবাসার শরবত বনাম নেগেটিভ ব্রান্ডিং
৩০ মে ২০১৯ ২২:২৮
ভালোবাসার পাশে একটা অসুখ শুয়ে থাকে!
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
আপনি কাউকে ভালোবাসেন আর নাই বাসেন ভালোবাসা নামের অসুখ আপনাকে ভোগাবেই। সম্ভবত একারণে ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ‘Fall In Love’ যার একটা মানে দাঁড়াতে পারে ‘ভালোবাসায় পতন’! কারো পতন হোক এই কামনা কী মানুষের পক্ষে করা সম্ভব? সম্ভব হলেও বলুন- ভালোবাসি! অভিশাপ দিতে হলেও বলুন দুঃখ পেলেও আসিস,পারলে ভালোবাসিস! দয়া করে আবার রাস্তার ক্যানভ্যাসারের মত বলবেন না-আপা আসেন ‘ভালো বাঁশি’। আপা দেখে যান ‘ভালোবাসা বাঁশি’! সাধারণ মানুষ বোঝেনা কী এই ভালোবাসাবাসি! তারা ক্যানভাসারের আহবানে মুগ্ধ হয়ে তার কাছে গেলে সে বলে- শুধু বিশ খালি বিশ। কুড়ি কুড়ি একটা কুড়ি। কেউ বিশ টাকা দেয়ার পর ক্যানভাসার ঝুড়ি থেকে একটা বাঁশি বের করে বলে-এই নিন ভালোবাসা ‘বাঁশি’। তারপর বাঁশিতে সুর তোলে বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে/আসি আসি বলে জোসনা ফাঁকি দিয়েছে! এই পৃথিবীর বেশিরভাগ গান ও কবিতা ‘এই কথা না রাখা জনিত ফাঁকি’ অর্থাৎ প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ‘ছ্যাকা’র সাগরে ভাসিয়ে চলে যাবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়। সুবীর নন্দীর গাওয়া জনপ্রিয় গানের কথা এমন-সে যে কথা দিয়ে রাখলো না/চলে যাবার আগে ভাবলো না/সে কথা লেখা আছে বুকে/দিন যায় কথা থাকে!
শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসের মতো সুনীল গাঙ্গুলীর ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটা ধুন্দুমার জনপ্রিয়! কেউ কথা রাখেনি কবিতার বিখ্যাত লাইন-ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীলপদ্ম/তবু কথা রাখেনি বরুণা/এখন তার গায়ে শুধুই মাংসের গন্ধ/এখনো সে যে কোন নারী!
কবিতা বা গানের বরুণারা কথা রাখে না তবু কবি সাহিত্যিকদের প্রেম কমে না। তাদের লেখালেখির কারণে ওয়ার্ডসওয়ার্থের লুসি, সুনীলের বরুণা বা নীরা,রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য কিংবা জীবনানন্দের বনলতা সেন, এমন কী মাসুদ রানার সোহানা বিখ্যাত হয়ে আছে। বিখ্যাত হয়ে আছে দেবদাস আর পার্বতী। বাংলা সাহিত্যে ভালোবাসার ‘নেগেটিভ ব্রান্ডিংয়ের’ নাম যেন দেবদাস। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই উপন্যাস লেখার পরে শত বছরের (প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ এর জুনে) বেশি সময় পার হয়েছে কিন্তু বাঙালির মন থেকে দেবদাস সিনড্রোম দূর হয় নি,বরং এই ট্রেইন্ড ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছে। পার্বতী যে দেবদাসকে ভালোবাসতো না এমন না। বরং দেবদাস জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়ায় পার্বতীকে নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। তাদের বিয়ে হয় নি। পার্বতীকে বড়শীর বাট দিয়ে কপালে আঘাত করে রক্তাক্ত করেছিল দেবদাস। বলেছিল-যতোদিন তোর কপালে এই দাগ থাকবে ততোদিন আমার কথা তোর মনে পড়বে পার্বতী! পার্বতীকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল বয়স্ক এক ধনাঢ্য ব্যক্তির সাথে যিনি বিবাহিত এবং সন্তানের জনক ছিলেন । আর পার্বতীকে না পাওয়ার বেদনা জেগে উঠেছিল দেবদাসের হৃদয়ে, সারাটা জীবন সে মদ আর চন্দ্রমুখীর নাচে বুঁদ থেকে শেষমেষ মারাই গিয়েছিল। মরার আগেও সে পার্বতীকে ছাড়ে নি। শেষযাত্রায় সে হাজির হয়েছিল পার্বতীর স্বামীর বাড়ির দরোজায়!
এই দেবদাস সিনড্রোম পরবর্তীকালে আমাদের অনেক ভুগিয়েছে। পার্বতীকে না পেয়ে দেবদাস বড়শীর বাট দিয়ে তার কপালে আঘাত করেছিল। এরপর বহুদিন গেছে প্রেমাষ্পদকে না পেয়ে ব্যর্থ প্রেমিক অসহায় প্রেমিকার মুখে এসিড ছুড়ে মারতো! হাল আমালের ট্রেন্ড হচ্ছে প্রেম বা বিয়েতে রাজি না হলে ধর্ষণ করা কিংবা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা। দেবদাস সিনড্রোম সিনেমাতে ব্যবহৃত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রেমিকাকে না পেয়ে বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে মদ খেয়ে মাতাল হবার কিংবা গান গাওয়ার দৃশ্যে বাংলা ও হিন্দি ফিল্মে কয়েক হাজার বার দেখা গেছে। ‘দেবদাস’ উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে ছবি হয়েছে বাংলা ও হিন্দিতে,কয়েকবার করে। এর বাইরেও গান হয়েছে প্রচুর। যেমন- রকের ধারে শখের দেবদাস/দুঃখ পুষে রাখে বারমাস! অথবা দেবদাস কে তোমায় করেছিল সুখী/পার্বতী না চন্দ্রমুখী? কিংবা ভালোবাসা বেশি হলে খুন হয়ে যেতে হয়/দেবদাস বড় খুনি নিজ খুনে মেতে রয়/চন্দ্রমুখীর নাচে ভাবে জীবন পার্বতীময়!
পার্বতীকে দেবদাস ভুলতে পারেনি তার একটা কারণ এমন হতে পারে যে- যতোবারই প্রেমে পড়বেন, মনে হবে প্রতিটা প্রেমই প্রথম প্রেম! আর ভালোবাসার সব কথাই নাকি বলা হয়ে গেছে। তবু কিছু কিছু কথা থাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিলেও কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। এই উপমহাদেশে ভালোবাসার ব্রান্ডিং বা সিএসআর (সোশাল কর্পোরেট রেসপনসিবিলিটি) এর ধরনটা কেমন যেন! উপমহাদেশের মানুষের কাছে প্রেমের তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে যে তাজমহল সেটা আরজুমান্দ বাণু ওরফে মমতাজ মহলের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল। যে তাজমহল আমাদের সামনে দেদীপ্যমান সেটি তৈরি হয়েছিল ভীষণ নির্মমতায়। বাইশ হাজার শ্রমিক বিশ বছর পরিশ্রম করে তৈরী করেছিলেন এই তাজমহল। নিজের বয়স যখন পঞ্চাশের বেশি তখন সম্রাট শাহজাহান ১৪ বছরের এই আরজুমান্দ বানুকে বিয়ে করেছিলেন । যদিও এই বয়সেই আনজুমানের আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। তার স্বামী মারা গেলে (কারো কারো মতে হত্যা করা হয়েছিল) শাহজাহান তাকে বিয়ে করেন। ১৪টি সন্তান প্রসবের পর আরো একটি সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে আরজুমান্দ মারা গিয়েছিলেন। হায় ভালোবাসা! এই মোঘলরা আমাদের শের বা অদ্ভূত কবিতা, মোঘলাই খাবার সহ আরো অনেক কিছু শিখিয়েছে। কিন্তু সেই মোঘলদের ভালোবাসা কেমন? সেলিমের প্রেমিকা আনার কলিকে তারা জীবন্ত কবর দিয়েছিল, শাহজাদীর প্রেমিককে পানিতে চুবিয়ে মেরেছিল! এখন অবশ্য বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানি ভালোবাসার উপর ভর করেছে। তারাই বলে দেয় ‘কোথায় কখন কীভাবে প্রেম করলে’ কতোটা সুবিধা পাওয়া যাবে!
আসলে সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসার ধরন বদলেছে। আগে প্রেমিকা শব্দটার ভেতর কেমন যেন একটা দ্যোতনা ছিল। প্রেমিকা শব্দটার সাথে আগে হয়ত রঙিন খামে চিঠি দেয়া কিংবা কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা করার রেওয়াজ ছিল। প্রেমিকার বানানো পিঠা পায়েস ছিল অমৃতের মতন। প্রেমিকার বাবা বড় ভাইরা ছিল সম্মানিত ব্যক্তি, একই সাথে আবার প্রেমের জন্য ভিলেনের মত ভয়ংকর। প্রেমিকার পাঠানো উপহার ছিল আজীবন রেখে দেবার মত জিনিস। এখন সময় বদলেছে। রঙিন কাগজে লেখা চিঠি নীল খামে করে পাঠানোর ব্যাপারটা এখন জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। চিঠির জায়গায় এসেছে এসএমএস কিংবা এমএমএস অথবা ফেসবুক। পিঠা পায়েসের জায়গায় এখন এসেছে ফাস্ট ফুড। আর তাই গানে গানে বলা হচ্ছে আজকাল ভালোবাসা ফাস্ট ফুডে বেশি যায়/আজকাল ভালোবাসা আইসক্রিম বেশি খায়!
হাল আমলের প্রেমিক প্রেমিকারাও তাই কেমন যেন হয়ে গেছে। যেমন- জন আর জেনিফার। অনেক দিন ভালোবাসাবাসির পর ভ্যালেন্টাইনে একসাথে গেছে এনগেজমেন্ট রিং কিনতে। দোকানদার বললো -আংটিতে কী লিখে দেব ‘টু মাই জেনিফার?’ জন বললো না না। লিখুন ‘টু মাই ওয়ান এন্ড অনলি লাভ।’ দোকানদার জন কে বললো আপনি খুব রোমান্টিক। জন বললো সে জন্য না। যদি আমাদের ব্রেক আপ হয়, তাহলে আংটিটা নতুন কাউকে দিয়ে দিতে পারবো!
জনের মতো ইদানিংকার জেনিফাররাও কম যায় না। যেমন-জনের মন খারাপ। সে তিন দিন ধরে শুধু কাঁদছে। কারণ জেনিফার তিন বছর জনের সাথে প্রেম করার পর এখন অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। জন কান্নাকাটির পর জানতে চাইলো তুমি কাকে বিয়ে করতে যাচ্ছ জেনিফার? জেনিফারের মিষ্টি উত্তর-জন তোমার বাবাকে! তার ব্যাংকের ফিগার অনেক হেলদী! ভালোবাসার জন্য ইদানিং ছেলেরা নাকি দেখে মেয়েদের চেহারা ও ফিগার! আর মেয়েরা নাকি দেখে ছেলেদের ব্যাংকের ফিগার! তাই যে কৌতুক জনপ্রিয় হয় তা এমন-
এক লোক ভিক্ষা করছে। স্যার বিশটা টাকা দেন। স্যার বিশটা টাকা দেন। বিশ টাকা দেবার আগে এক পথচারি জানতে চাইলো বিশ টাকা দিয়ে কী করবি?
– স্যার কফি খাব!
– কফি খাইতে দশ টাকা লাগে। বাকি দশটাকা দিয়ে কী করবি?
– স্যার গার্লফ্রেন্ডও আমার সাথে কফি খাবে।
– ফকির হইয়াও গার্লফ্রেন্ড বানাইছোস?
– স্যার ভুল কইলেন। গার্লফ্রেন্ডই আমারে ফকির বানাইছে! ছোটকালে পড়েছি বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না। পরে জেনেছি বই প্রকাশ করার ব্যবসা করতে যেয়ে অনেকেই দেউলিয়া হয়! হয়তো ভালোবাসতে যেয়েও কেউ কেউ ফকির হয়ে যায়। কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের ভালোবাসাটাকে কোন পাল্লায় মাপা হবে? ভদ্রলোক তার প্রেমিকা লেডি সিম্পসনের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন! আজকাল সম্ভবত কেউ ভালোবাসার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নেয় না, সিংহাসন ত্যাগ করে না, যতো নির্মম উপায়ে হোক না কেন, তাজমহল বানায় না! তবে নিজের আরাধ্য বা প্রেমাস্পদকে কাছে পাবার আকুতি থেকেই জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর সেরা প্রেম কাহিনীগুলো। যেমন ইউসুফ জুলেখা, লাইলী মজনু, শিরি ফরহাদ, রোমিও জুলিয়েট, সোনালি ত্রিস্থান এমন অনেক প্রেম কাহিনী। আর সিনেমার প্রেম একধরনের ‘সন্ত্রাসী প্রেম’। নায়িকাকে পাবার জন্য নায়ককে ভিলেন ও তার অন্তত জনা বিশেক সাঙ্গপাঙ্গকে মেরে ফেলতে হয় কিংবা আধমরা করে পুলিশে দিতে হয়! সিনেমার এই ট্রেন্ডও বদলে যাচ্ছে। আগে নায়িকাকে ভিলেন আটকালে নায়িকা বলতো-শয়তান দেহ পাবিতো মন পাবিনা! এখন বলে-যা করবি নীরবে কর। শয়তান দয়া করে ভিডিও করিস না!
আগে প্রেমিকার সাথে কাটানো সময়টাকে ‘স্বর্গীয় সময়’ বলে মনে করা হতো। এখন মনে করা হয় এই সময়টার অনুভূতি চাইনিজ মালের মতো (বেশিদিন টেকে না!) আর প্রেমিক বা প্রেমিকার চলে যাওয়ার অনুভূতি নাকি জাপানিজ মালের মতো (বহুদিন টিকে যায়!)
ভালোবাসা যেন চিরকাল টিকে থাকে, ভালোবাসার আনন্দ মাখা রসায়ন যেন আরও আনন্দঘন হয় সে কারণে ‘ভালোবাসার শরবৎ’পান করাটা জরুরী। এই শরবত বানানোর আলাদা রেসিপি আছে। দয়া করে এই রেসিপিকে কারও রেসিপির (‘কেএফ’ নামে বাংলাদেশের একজন রন্ধনবিদ আছেন যিনি রবীন্দ্রনাথের প্রিয় নুডুলস আর নজরুলের প্রিয় পানীয়র রেসিপি দিয়ে থাকেন। তার জীবনানন্দের ভুতুম পেঁচার রোস্ট আর সোনালী চিলের তেল চপচপ ভুনার রেসিপি অমর হয়ে থাকবে!) সাথে তুলনা করবেন না। রেসিপিতে পরিমান মত যা যা মেশাতে হবে-
ক. এক চিমটি বেদনা
খ. এক মুঠো আনন্দ
গ. এক বাটি অভিমান
ঘ. এক মগ কান্না
ঙ. ছয় চা চামচ হাসি
চ. চার বাটি দুঃখ
ছ. ছোট্ট এক কৌটা সুখ
জ. এক গামলা বিশ্বাস
ঝ. এক গামলা ঝগড়া
সবকিছু বিশাল বড় এক ড্রামে ঢালুন। ইচ্ছে মতো ঘুটা দিন। এরপর গ্লাসে করে পরিবেশন করুন এবং চুমু দিয়ে দিয়ে পান করুন।