Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঈর্ষায়, ভালোবাসায়


৩০ মে ২০১৯ ২২:২৩

জীবনে ঈর্ষার অনেক রূপ দেখেছি। আজ দেখলাম আরেক রূপ। নিকৃষ্ট মানের ছোটলোকি ঈর্ষা। ব্যাপারটা ধরতে আমার কিছুটা সময়  লেগেছে। কিন্তু  শেষ  পর্যন্ত কারণ খুঁজে  পেয়েছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনে সোনালি ব্যাংকের একটি শাখা আছে। সেই শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলেছিলাম সতের বছর আগের কোনো এক ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন আমি সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত একটি নামকরা স্কুল অ্যান্ড কলেজের কলেজ শাখায় ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে  যোগ দিয়েছি।

বিজ্ঞাপন

দিনটা ছিল ১৩  ফেব্রুয়ারি, পহেলা ফাল্গুন। কলেজে  যোগ  দেওয়ার এগার দিন পরে। সেদিন সবাই নিয়ম মেনে হলুদ-কমলায়  সেজেছিল। তখন এসব পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইন দিবস পালনের প্রারম্ভিক কাল। বাঙালি উৎসবের কিছু  পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে নাকি এগুলো ব্যবসায়িক ধান্দা  সে বিতর্ক থাক।
আমি মাত্র ক’দিন আগে আমার  প্রায় দীর্ঘ দু’দশকের খুলনার জীবনে ইতি  টেনে রাজধানী শহরে থিতু হবার  চেষ্টা করছি।  সেই  চেষ্টার গল্প বড় কঠিন। আর  যেকোন একই ধরনের গল্পের মতো। নতুন শহর, অল্প-পরিচিত আত্মীয়তা, অপরিচিত কর্ম-পরিবেশ, অচেনা মানুষ, কণ্টকময় রাস্তা-ঘাট। সব মিলিয়ে আমার  ভেতর  ফেলে আসা জীবনের জন্য তীব্র হাহাকার। নিঃশব্দে। আমাকে নাকি এখানেই নতুন জীবন খুঁজে নিতে হবে। সবাই ঢাকা শহরে এমন চাকরি নিয়ে আসার সুযোগ পায় না। আমি  পেয়েছি। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আমার সামনে অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ইত্যাদি।
সেই ভবিষ্যতের সন্ধানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে  গেলাম। সাথে বড় ভাই। আমার সাথে আরও  গেলো কৃষ্টি নামে লম্বা ঝলমলে চুলের  যে মিষ্টি  মেয়েটা স্কুল শাখায়  যোগ দিয়েছিল  সেও। কৃষ্টির সাথে ওর নতুন বিয়ে করা বর ছিল কিনা মনে  নেই।  সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে বাংলায় পাশ করে কিছুদিন হলো  বেরিয়েছে। বিয়েও হয়েছে সম্প্রতি। আমার  থেকে বয়সে বছর দুয়েকের  ছোট। ঝলমলে লম্বা চুল ছাড়া অদ্ভুত মিষ্টি হাসিটা ছিল ওর  চেহারার আরেকটা নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য।  প্রথম  দেখাতেই  চোখে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

কৃষ্টির সাথে পরিচয়ের  প্রথম দিনটা অস্পষ্ট করে হলেও মনে আছে। ইন্টারভিউ  বোর্ড  থেকে  বের হয়ে আসার পর  দোতালার করিডোরে ওর সাথে  দেখা। আমাকে আপন মনে করেই কিনা  কে জানে ব্যাগটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,  সে বাথরুমটা ঘুরে আসতে চায়। শাড়ি পরা ছিল। নতুন বউ এর সব উজ্জ্বলতায় ঝলমল করছিল। কাউকে জিজ্ঞাসা করে নিয়ে টুকটুক করে বাথরুমের দিকে চলে  গেলো। আমি অবাক হয়ে ওর স্বতঃস্ফূর্ততা  দেখলাম। আমি রাজধানী শহরের স্মার্টনেস  দেখি। আর ভাবি, এসব না হলে কী হয়। আমি  তো এতো সহজে  যেকোনো অপরিচিত জায়গায় চট করে বাথরুমে ঢুকে  যেতে পারবোনা।
ও, হ্যাঁ, কৃষ্টি ভার্সিটিতে পড়া  মেয়ে। ওকে এসবের সাথে অভ্যস্ত হতে হয়েছে। আমি পরিবারের আদরের লালিত্যে বড় হয়েছি। তাই অনেকরকম শুচিবাই,  ছোঁক  ছোঁক স্বভাব।  যেকোন নতুন জায়গায়  গেলে নানা কিসিমের জড়তা এসে ভর করে। মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। তবে এতো কিছুর মধ্যেও নিজের অনেক ব্যক্তিগত কাজ নিজেই করে নিতে পারি। অপরিচিত পরিবেশে মানিয়ে  নেওয়ার  প্রাথমিক সমস্যাটুকু ছাড়া আর সব  ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করা শিখে নিতে হয়েছে। পরিবার  থেকে পাওয়া স্বাবলম্বনের ওই শিক্ষার বদলেই আবার খুব সহজে অভিযোজনটুকু  সেরে  ফেলতে পারি।

কৃষ্টি আমার মধ্যে কিছু একটা  দেখেছিল। হয়তো  গাম্য, নিপাট সরলতা। যা  সে তার সিরাজগঞ্জ শহর  ছেড়ে আসার পর এই রাজধানী শহরে বা এর আশেপাশের এলাকায় আর  তেমন করে  দেখবার সুযোগ পায়নি। তাই  প্রথম  দেখাতেই আমাকে অনেকটা বড়  বোনের দাবিতে  বেঁধে  ফেলতে চাইলো। আমিও একেবারেই অচেনা এই নগরে এমন একজন সুস্মিতা  পেয়ে মানসিকভাবে কিছুটা হাল্কা হতে চাইলাম। দুজন একই দিনে কাজে  যোগ দিলাম। আমি কলেজ শাখায় ইংরেজির  প্রভাষক হিসেবে। আর কৃষ্টি স্কুল শাখায় বাংলার সহকারী শিক্ষিকা হয়ে। আমাদের ঘনিষ্ঠতা যা হলো তা ওই একসাথে একই  প্রতিষ্ঠানে কাজে  যোগ  দেবার কারণে। এর বাইরে খুব অল্পই আমাদের  দেখা সাক্ষাৎ হতো। মাঝেমাঝে ক্লাসের ফাঁকে অথবা টিফিনের বিরতিতে  সে আমার পাঁচ তলার শিক্ষক মিলনায়তনে চলে আসতো। আমিও একইভাবে  চেষ্টা করতাম কখনো কখনো তার  দোতলার টিচার্স কমনরুমে গিয়ে একটু ঘুরে আসতে।

কিন্তু  কোথাও আমার ভালো লাগতো না। মনে হতো, আমি  যেন একটা কারাগারে এসে বন্দি জীবন যাপন করছি। ঢাকা শহরের বাইরের একটা  মেয়ে এরকম একটি শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানে এসে  কেবল  যোগ্যতার গুণে তার জায়গা করে নিতে পারে বিষয়টা আমার চারপাশের আটানব্বই ভাগ মানুষ সহজে  মেনে নিতে পারছিল না। আমার মনে হতে শুরু করলো, সবাই  যেন আমার সবকিছু খুব তীক্ষè দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অবলোকন করছে। প্রথম দিকে এই অস্বস্তি ছিল আমার একান্ত নিজের কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে। মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও আমি  জোর  চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। যদিও এই সংগ্রামে আমাকে জিততেই হবে এমন  কোন জিদ  কেন জানি নিজের  ভেতরে একবারও কাজ করেনি। আমার অস্বস্তি ছিল মূলত ভিন্ন পরিবেশগত এবং বদলে যাওয়া বাহ্যিক আচারগত কারণে। সালোয়ার-কামিজ  ছেড়ে হঠাৎ আমাকে বারো হাতের শাড়িতে শরীর  পেঁচানো শিখতে হলো। খুবই  বেসামাল অবস্থা। শাড়িতে অনভ্যস্ত আমি যখন রিকশায় উঠছি,  দেখি আমার পা  প্রায় হাঁটু পর্যন্ত উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। আমার পিউরিটান মন তাতে ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তা সামলাতে সামলাতে আমি বাঁ হাতে কুঁচি সামান্য উঁচু করে ধরে সিঁড়ি  বেয়ে পাঁচ তলাতে ওঠা শিখে  গেলাম।

একদিন সকালের অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে আছি। ছাত্র-ছাত্রীরা শপথ পাঠ করছে। পাশ  থেকে কৃষ্টি আস্তে করে বলে উঠলো, আপা, শাড়ি  তো উল্টা করে পড়েছেন। ইস্টার্ন প্লাজা  থেকে নিজের পয়সায়  কেনা ওটা আমার তৃতীয় বা চতুর্থ নাম্বার শাড়ি। সকালবেলা  সোজা উল্টা দিক খুব ভালো করে  দেখে একেবারে নিশ্চিন্তে হয়ে পরে এসেছি। এখন শুনছি, শাড়ি নাকি উল্টা করা পরেছি। লজ্জায় নিজের  ভেতরে সিধিয়ে  গেলাম। কৃষ্টি আমার মনের অবস্থা বুঝতে  পেরেছে আগেই। আমি কিছু বলার আগেই সান্তনা  দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো, আপা, এটা কিছু না। আমারও  প্রথম  প্রথম এমন হতো। কৃষ্টির কথায় মন ভিজলেও নিজের  ভেতরে অস্বস্তি  থেকে  গেলো যতক্ষণ  পর্যন্ত বাসায় না ফিরলাম।
এর মধ্যে একদিন শুনি, আগামীকাল পহেলা ফাল্গুন। ওইদিন নাকি হলুদ, কমলা রঙের শাড়ি পরে আসতে হবে। মনে মনে বিপদ গুনলাম। মাত্র দশ দিন হলো কাজে  যোগ দিয়েছি। দুই-তিনটা শাড়ি দিয়ে কাজ চালাচ্ছিলাম। হলুদ শাড়ির চিন্তা নিয়ে মুখ কালো করে বাড়ি ফিরলাম। পরের দিন ভাইয়ের বউয়ের  দেয়া হাল্কা সাদা হলুদ  শেডের একটা জর্জেট শাড়ি গায়ে জড়িয়ে জড়সড় হয়ে কলেজে  গেলাম।  সেখানে  পৌঁছে  দেখি ধুন্দুমার ব্যাপার। সবার পরনে নানা মাত্রার হলুদ, কমলা, লাল এর বিচ্ছুরণ  দেখে  চোখে রীতিমতো সর্ষে ফুল  দেখতে শুরু করলাম। বয়স  কোন বাধা মানেনি এই উজ্জলতায় নিজেদের রাঙিয়ে নিতে। পঞ্চাশোর্ধ্ব  ফেরদৌসি আপা  থেকে শুরু করে হালের  যোগ  দেওয়া তরুণী শিক্ষিকা কৃষ্টি  পর্যন্ত। শুধু বর্ণিল ছটার শাড়ি  তো নয়, সাথে মিলিয়ে নানা ডিজাইনের বাহারি গহনার সাজ।

ফাল্গুনের এমন উচ্চকিত উদযাপন দর্শন আমার এই  প্রথম। তাই  প্রাথমিক ধাক্কাটা ছিল  বেশ ভালোরকম। উপরন্তু, নিজের নিস্তেজ ম্যারম্যারা  বেশ নিয়েও  বেশ কাচুমাচু অবস্থায় ছিলাম। হাল্কা হলুদ শাড়ির সাথে আবার পরেছি সাদা ব্লাউজ। সাতাশ বছরের তরুণী এক  পোশাকেই সাতচল্লিশ এর  চেহারা ধারণ করেছি। আর সারা অভিব্যক্তিতে  সেই চিরন্তন উদ্বাস্তু উদাসীনতা। মোট কথা, আমি একদমই মানানসই ছিলাম না স্কুল-কলেজের  সেই ফাল্গুন বরণের বর্ণিলতায়।
মুখ  গোমড়া করে শিক্ষকদের কক্ষে বসেছিলাম। টিফিনের বিরতিতে আমার আর কৃষ্টির ব্যাংকে যাবার কথা। এখন মনে পড়ছে, কৃষ্টির বর  সেদিন অফিসের কাজে আসতে পারেনি। আমার বড় ভাই এসেছিল। আমরা তিনজন  হেঁটে না রিকশায়  রেজিস্টার ভবনে  গেলাম তা আজ আর মনে  নেই। যা মনে আছে, আমার দৃষ্টি বারবার কৃষ্টির পিঠ ছড়ানো ঝলমলে চুলের দিকে চলে যাচ্ছিল। কী সুন্দর করে  সেজেছে  মেয়েটা! খুব সাধারণ অথচ কী উচ্ছল,  প্রাণবন্ত! ওর পাশে  প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, আমি  মোটেও ওর মতো নই।

অথচ আমরা দুজনই দুজনকে পছন্দ করি বলি আমাদের আচরণে  প্রকাশ  পেয়ে যাচ্ছিল। ওর বর আসতে পারবেনা বলেই  সে আমার সাথে আসতে  চেয়েছে। এটাও আমার  প্রতি ওর এক ধরনের  ছোটবোনসুলভ নির্ভরতা বলে মনে হয়েছে। যদিও এসবই আমার একান্ত নিজস্ব চিন্তা। কৃষ্টির কাছ  থেকে  সেভাবে সরাসরি  শোনার সুযোগ হয়নি। শুধু এটুকু বুঝতে  পেরেছিলাম, ইট-কাঠের এই আবেগহীন শহরে  সে আমার মধ্যে এক ধরনের মফস্বলীয় মানবিকতা খুঁজে  পেয়েছিল। তাই  যে সামান্য সময় আমাদের  দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ ঘটতো,  সে অকপটে খুলে দিতো তার মনের কপাট। সিরাজগঞ্জ এর টানে বলা ওর কথাগুলো শুনে আরাম  পেতাম। আমার খুব  বেশি কিছু বলবার ছিলনা।

ধীরে ধীরে আমরা  যে যার কাজের  ক্ষেত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ক্লাস  নেওয়া, খাতা  দেখা,  প্রশ্নপত্র  তৈরি করা ইত্যাদি। ছুটি  পেলে আমি চলে  যেতাম খুলনা। কৃষ্টি হয় তার বাবার বাড়ি সিরাজগঞ্জ অথবা শ্বশুরবাড়ি দর্শনা। পরিচয় পর্বের  প্রথম দিকে কৃষ্টির বর মিনহাজের সাথে কথা বলতে গিয়ে  জেনেছিলাম,  সে দর্শনার  ছেলে। আশ্চর্য হলেও সত্য, এক ফাঁকে এটাও জানা হলো, মিনহাজ  কোন এক সময় আমার কলেজের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কুহেলির  প্রেমপ্রার্থী ছিল। কুহেলি দর্শনা  থেকে খুলনায় এসেছিল অনার্স পড়তে। দর্শনায় একই কলেজে ওরা ইন্টারমিডিয়েটে পড়েছে। অজ্ঞাত কারণে কুহেলি মিনহাজের  ন্ত্রমের ডাকে সাড়া  দেয়নি। সাড়া দিলে মনে হয় আজ  সে ভালোই থাকতো। এটা অবশ্য অনেক পরের কথা। এসবের কিছুই কুহেলির কাছ  থেকে  শোনা নয়। কৃষ্টির পাশে আমাকে  দেখে মিনহাজ যখন জানলো আমি খুলনা  থেকে এসেছি,  সে নিজের  থেকেই এসব বললো। আর সব শুনে আমার মনে হলো, হায়, আল্লাহ, পৃথিবীতে এভাবেও মানুষের সাথে  যোগাযোগ হয়!

পরে কুহেলির সাথে  দেখা হলে আমি তাকে মিনহাজের সাথে পরিচয়ের কথা বললাম।  সে তখন লালমাটিয়ায় এক এনজিও অফিসে টিকে থাকার লড়াই করছে। আমার মতো বড় ভাইয়ের বাসায়  থেকে। সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে বললো, মনে হয় ভুলই করেছি। শুধু ওর মুখে বসন্তের দাগ ছিল বলে ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। অথচ এখন বুঝি, ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসতো। এখনো বাড়ি  গেলে আমার  খোঁজ  নেয়। শুনেছি, ভারি মিষ্টি একটা বউ  পেয়েছে। পাবেই  তো। খুব ভালো  ছেলে। তখন বুঝতে পারিনি। কুহেলির আফসোস আমার মনকে আর্দ্র করে। আমরা দুজনই তখনো বিবাহ নামক দিল্লিকা লাড্ডুর স্বাদ নিতে পারিনি। এ নিয়ে  সে সময়  পর্যন্ত আমাদের  তেমন  কোন কথাবার্তাও হয়নি। মাত্র রাজধানী শহরে এসে স্থিতু হবার কঠিন  চেষ্টায় আমাদের দুই গ্রাম্য শিক্ষিত নারীর তখন নাভিশ্বাস ওঠা অবস্থা।

অ্যাকাউন্ট  খোলার পর  থেকে  প্রতিমাসের  প্রথম সপ্তাহে ব্যাংকে গিয়ে জানতে চাই,  বেতন জমা হয়েছে কিনা। জমা হলে টাকা তুলে  টেলিফোনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে কিছু টাকা খুলনায় পাঠাই। কৃষ্টি ছাড়া আরেকজন বয়োজ্যেষ্ঠ সহমর্মী শিক্ষক পাই যিনি  কোনো এক অজানা কারণে একেবারে  প্রথম  থেকে আমার জন্য নিখাদ ভালোবাসা  পোষণ করতে থাকেন। এখন ভাবলে অবাক হয়ে যাই। এবং খুব  বেশি সত্য মনে হয় এই কথা  যে মানুষের জীবনে দুয়েকজন আন্তরিক শুভাকাক্সক্ষী থাকলেই যথেষ্ট। অনেক বন্ধু বা সমব্যথীর  প্রয়োজন  নেই।  ফেরদৌসি আপা আমার মধ্যে কী  দেখলেন  কেবল আল্লাহ মালুম। পরিচয়ের  প্রথম দিন  থেকে আমাকে তুই  ডেকে এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে  ফেললেন।
কলেজের নতুন পরিবেশে মানিয়ে  নেবার  সেই ভীষণ অস্বস্তিকর সময়টাতে  ফেরদৌসি আপার  স্নেহাস্পর্শ  প্রাপ্তি ছিল এক  প্রায় অপার্থিব  যোগ। আপা আমাকে শাড়ির  দোকান  চেনাতে নিয়ে  গেলেন হকার্স মার্কেটে। কলেজ ছুটির পর ব্যক্তিগত পাজেরো গাড়ি  রেখে তাঁর সাথে রিকশায় পাশে বসিয়ে আমাকে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলেন। আমরা ফুলার  রোড  ছেড়ে বৃটিশ কাউন্সিল  পেরিয়ে কাঁটাবনের রাস্তা  কেটে বাটা সিগন্যালের  মোড়ে  পৌঁছানোর আগেই বামদিকে  সোজা ঘুরে যাই। এপ্রিলের তপ্ত দুপুরের  রোদ  থেকে বাঁচতে আমাদের মাথার ওপর রিকশার হুড টানা। আমি ঘাড় কাত করে ডানে-বামে মাথা ঘুরিয়ে এতোদিন বই-পত্রিকায় পড়া রাস্তাগুলোর সাথে মনে মনে হাই-হ্যালো করি।

কদিন পরেই পহেলা  বৈশাখ।  ফেরদৌসি আপা আমাকে  বৈশাখী শাড়ি কিনতে নিয়ে  গেলেন।  প্রায় আড়াই মাসের ঢাকা বাসে আমি সামান্য একটু সপ্রতিভ হয়ে উঠতে  পেরেছি। কেবল নিজের কাছে। বাইরে  প্রকাশ কম। ফাল্গুনে উপযুক্ত শাড়িহীনতায়  যে হীনমন্যতায় ভুগেছিলাম,  ফেরদৌসি আপার কল্যাণে সামনের  বৈশাখ উদযাপনে তার  কোন ছাপ পড়বেনা  ভেবে মনে মনে বিশেষ পুলক অনুভব করলাম।

আপার সাথে হকার্সের  ভেতরে  ঢোকার অভিজ্ঞতাও চমকপ্রদ। দাঁড়া,  তোকে ওইখানে নিয়ে যাই বলে তিনি তার পরিচিত কয়েকটা  দোকানে নিয়ে  গেলেন এবং নিজের মতো করে দামাদামি শুরু করে দিলেন।  প্রতিটা  দোকানই সাদা-লালের মিশেলে রঙিন। এভাবে  বৈশাখ উপলক্ষে শাড়ি  কেনা আমার এই  প্রথম।  সেই  ফেব্রুয়ারির ফাল্গুন  থেকে উপলব্ধি হতে শুরু করেছে  যে ঢাকা শহরে আমার জীবনের অনেক কিছুরই  প্রথম ঘটন ঘটবে। শুভ-অশুভ মিলিয়ে হয়তো। ইতিমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে।

ফেরদৌসি আপার  দেখানো পথ অনুসরণ করে আমি এখন মাঝেমাঝে একাএকাই দুয়েকটা  দোকানে যাই, শাড়ি কিনি। একদিন ইস্টার্ন প্লাজা  থেকে বকশীবাজার  ফেরার পথে রাস্তা হারিয়ে  ফেললাম। এদিক-ওদিক চরকির মতো রিকশায় ঘুরে অবশেষে বদরুন্নেসা কলেজের  চেনা গলি খুঁজে  পেয়ে ধরে  প্রাণ ফিরে  পেলাম। আরেকবার আজিজ সুপার মার্কেট  থেকে জাতীয় গণ গ্রন্থাগারের পায়ে হাঁটা পথ বুঝতে না  পেরে এক রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাওয়ালা মনে হয় আমার  বেকুবি বুঝতে  পেরেছিল।  সে চালাকি করে আমাকে  সোজা ঢাকা ক্লাবের রাস্তা বরাবর নিয়ে  যেতে শুরু করলো। অথচ, আজিজ সুপার মার্কেটের  যেখান  থেকে (সম্ভবত পাঠক সমাবেশ এর সামনের ফুটপাত) আমি রিকশায় উঠি, রাস্তা পার হলেই জাদুঘর  পেরিয়ে গণ গ্রন্থাগারের সামনের চত্ব¡রে  পৌঁছে  যেতে পারি।  সেখানে তখন একটা তাঁত শাড়ির  মেলা চলছিল।

এভাবে  চেনা- অচেনা গলিপথ ধরে ধরে যখন আমি আমার নতুন জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানোর তুমুল  চেষ্টা করছি, ওদিকে আমার তথাকথিত অভিজাত শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়ে  গেছে এক অবিশ্বাস্য  নোংরা  খেলা। আমার মফস্বলীয় মগজের রাডারে  সেই  খেলা ঠিকমতো ধরা পড়েনি। বহিরাগত মানসিকতায়  কেবল নিজের অক্ষমতাই  প্রকট হয়ে উঠছিল। কিছুতেই আমার  দোষ বা ত্রুটি  কোথায়  বের করতে পারছিলাম না। অনেকদিন পর জীবনে চক্রান্ত শব্দটির উপস্থিতি  টের পাই।  সেটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে আমার ওই  প্রতিষ্ঠান ছাড়ার সময় হয়ে আসে।

ঘটনা খুলে বললে এরকম: কলেজে ইংরেজির  প্রভাষক হিসেবে  যোগ দিলেও কার্যত  দেখা  গেলো  প্রায় সময় আমাকে স্কুলের বিভিন্ন  শ্রেণির ইংরেজি ক্লাসও নিতে হয়। যদিও বাংলার পাশাপাশি সাধারণ বিষয় হিসেবে আমার নির্ধারিত ক্লাসের সংখ্যা এমনিতেই অন্য শিক্ষকদের তুলনায়  বেশি। বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য বিভাগের ছয়টা করে ক্লাস। দুই পত্র মিলিয়ে। এর আগেও আরেকটি কলেজে পড়িয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে আমাকে  কেজি ক্লাস  থেকে শুরু করে নবম-দশম  শ্রেণির ক্লাসও নিতে হয়। কলেজিয়েট শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানে নাকি এটাই নিয়ম। নিয়োগপত্রে কী  লেখা ছিল মনে  নেই।

স্টপ-গ্যাপ বা এরকম একটা শব্দের সাথে  প্রথম পরিচিত হলাম। ওই  যে রাজধানীতে অনেক  প্রথমের সাথে আমার  মোলাকাত ঘটছিল তার নমুনা হিসেবে। এর অর্থ, স্কুলের  কোন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে তার ক্লাসটি  নেওয়া। আমার  ক্ষেত্রে এটা নিয়মিতভাবে ঘটতে থাকলো। একটা ক্লাস নিয়ে এসে বসতে পারিনি পিয়ন বা বুয়া অধ্যক্ষের হাতে  লেখা চিরকুট এনে হাতে ধরিয়ে  দেয়।  ছোট বাচ্চাদের ক্লাস নিতে আমার ভালোই লাগতো যতক্ষণ  পর্যন্ত ক্লান্ত অনুভব না করতাম। সপ্তম-অষ্টম  শ্রেণির বাচ্চারাও কথা শুনতো। কিছুটা সমস্যা হতো এর ওপরের ক্লাসগুলোতে  গেলে।  প্রায় কয়েকটা ইঁচড়েপাকার সাথে যুদ্ধ করতে হতো। তরুণ শিক্ষক হলে যা হয়। তবে আমার ঘটনা ছিল ভিন্ন।
সবচেয়ে  বেশি  প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলাম কলেজের বাণিজ্য  শ্রেণিতে পড়াতে গিয়ে। নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রের একটা দল নানাভাবে আমাকে বিরক্ত করবার  চেষ্টা করতো। আমি আমার মতো করে  সেটা সামাল দিতাম। কখনো মনে হয়নি, অধ্যক্ষ বা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানিয়ে আসি। বরং  ভেবেছি, বয়সের  দোষ। দুদিন পরে পড়ালেখার চাপে এসব বাঁদরামি এমনিই উবে যাবে। কিন্তু ঘটনা তা ছিল না।

এর মধ্যে আরেক উৎপাত শুরু হলো। ক্লাস নিচ্ছি। হঠাৎ দরজার দিকে  চোখ  গেলে  দেখি, অধ্যক্ষ মহোদয় আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার ক্লাস  নেওয়া পর্যবেক্ষণ করছেন। এই বিব্রতকর অভিজ্ঞতাও  প্রথম। তারপর ইশারায়  ডেকে নিয়ে কীভাবে আরো ভালো করে ক্লাস নিতে হবে তার সবক বয়ান। এই ঘটনার পর একটু ঘাবড়েই  গেলাম।  মোটামুটি মানানসই শাড়ি-টাড়ি পরে, নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়ে যখন মাত্র ভাবতে শুরু করেছি, যাক  প্রথম ঝক্কি পার হওয়া  গেলো, আসলে ঝক্কির তখন  কেবল আরম্ভ। অধ্যক্ষ আমার ক্লাস  নেওয়া পরীক্ষা করছে এটা  টের পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে খানিকটা দমে  গেছিলাম। আমার জানার সুযোগ হয়নি, অন্যদের  ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে কিনা। কৃষ্টির কাছে এ ব্যাপারে কিছু জানতে  চেয়েছিলাম কিনা তাও মনে করতে পারি না।

এই ঘটনার  রেশ কাটতে না কাটতেই একদিন অধ্যক্ষের কক্ষে তলব পড়লো। গিয়ে  দেখি একজন অপরিচিত  লোক বা ভদ্রলোক বসে আছে অধ্যক্ষের  টেবিলের সামনের  চেয়ারে। বসার ভঙ্গি, চেহারার দৃষ্টি  কোনটাই ভালো নয়। তিনি আমাকে আপাদমস্তক একবার  দেখে নিয়ে  যে বাণী বর্ষণ করলেন তাতে আমার আশঙ্কা সত্য  প্রমাণিত হলো। তার কথার সারমর্ম, ক্লাসে আমার পাঠদান যথেষ্ট মানোপযোগী নয়। কাজেই আমাকে সতর্ক করা হলো। কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট না হলে  যেকোন সময় আমার চাকরি চলে  যেতে পারে। ইত্যাদি। আমি কিছু বুঝলাম,  বেশিরভাগ বুঝলাম না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক। স্কুল-কলেজ পরিচালনা পরিষদের সদস্য।

আমার মনে পড়ে না ভাইভা  বোর্ডে এই  লোককে আমি  দেখেছি কিনা। বরং যা  দেখেছি, লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর  প্রাপ্তির সাথে  মৌখিক পরীক্ষায়  বোর্ডের সবার  চোখের বিস্ফোরিত বিস্ময়। এখন আমি ঠিকঠাক পড়াতে পারছিনা এই অভিযোগ চার মাস পরে  কেন কর্তৃপক্ষের মনে এলো জানি না। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম। পরপর কয়েকদিন। মনে হয় কান্নাকাটিও করলাম। বড় ভাই সব শুনে উল্টা আমাকেই  দোষারোপ করলো। আমি নাকি কারো সাথে মিশতে জানি না। তাই এই সমস্যার উদ্ভব। ইত্যাদি। মনের এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় তার সাথে বাড়তি কথা বলার আগ্রহ  বোধ করলাম না। এবারের সংগ্রাম চলবেই বলে  ঠোঁট কামড়ে ধরলাম।

তারপরের কয়েকটা মাস  গেলো ঝড়ের মতো। এর মধ্যে স্বয়ং অধ্যক্ষের গদিতে টান পড়লো এবং তিনি  কোন রাজ নৈতিক কারণেই কিনা  কে জানে বরখাস্ত হলেন। এসব বিষয়  থেকে কয়েকশ হাত দূরে থাকি বলে আসল কারণ জানা হয়না। আমি আগের মতোই ক্লাস আর পরীক্ষা নিতে নিতে আর পরীক্ষার খাতা  দেখতে  দেখতে হাঁফিয়ে উঠি। জীবনে  প্রথম বারের মতো ঢাকা শিক্ষা  বোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজি বিষয়ের খাতায় মার্কিং করে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরালাম।

এর মধ্যে নভেম্বর চলে এলো এবং এক সকালে পত্রিকা মারফত  পেলাম জীবনের অন্যতম আনন্দের সংবাদ।  সেদিন স্কুলের  প্রথম  শ্রেণির বাচ্চাদের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। ক্লাসে গার্ড দিলাম আর ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা  ছোট্ট পাখিদের নানারকম মজার আচরণ  দেখে নিজের মনের  গোপন আনন্দটাকে বাড়িয়ে নিলাম। স্কুলের শিক্ষকদের কমনরুমে  যেতেই সবাই  ছেঁকে ধরলো। বিসিএসের চূড়ান্ত ফল  প্রকাশিত হয়েছে। তারা আমার খবর জানতে চায়।  যেহেতু অনেকেই জানতো কলেজে  যোগ  দেবার আগেই আমি বিসিএসের ভাইভা বোর্ডের সামনে বসেছি। ততোদিনে আরও খানিকটা চালাক-চতুর হয়ে উঠেছি। কায়দামতো জবাব দিয়ে তখনকার মতো তাদের এড়িয়ে  গেলাম।

কিন্তু হাতে  গোনা  যেকজন শুভাকাক্সক্ষী ছিল,তাদের কাছে  বেশিক্ষণ  চেপে রাখতে পারলাম না।খবর বিদ্যুতের গতিতে সারা স্কুল-কলেজে ছড়িয়ে পড়লো। মুহূর্তের মধ্যে এতোদিনের অনেকের পরিচিত মুখগুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম  চেহারা নিয়ে আমার সামনে হাজির হতে লাগলো।  কেউকেউ, স্কুল শাখা  থেকে যারা আমার সাথে  প্রভাষক পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল, আমি কীভাবে বিসিএসের জন্য  প্রস্তুতি নিয়েছিলাম  সে বিষয়ে বিশদ জানতে চাইলো। হঠাৎ করে আমি এই  প্রতিষ্ঠানের একজন  সেলিব্রেটিতে পরিণত হলাম। সবার এই পরিবর্তন  দেখে  ফেরদৌসি আপা মুখ  ভেংচি  কেটে বললেন,  দেখলি, মানুষ কত সহজে  ভোল পাল্টে  ফেলে! এই বলে তুই ঠিকমতো ক্লাস নিতে জানিস না! আর এখন  তোর কাছে এসেই সবাই ধর্ণা দিচ্ছে! ইত্যাদি।

আমি ধীরে ধীরে কলেজ ছাড়ার জন্য  তৈরি হতে থাকি। একদিন  কোন এক পরীক্ষার হলে ডিউটিতে ছিলাম।  খেয়াল করলাম, কলেজের বাণিজ্য শাখার  যে  ছেলেগুলো খুব বিরক্ত করতো তারা দরজার কাছে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সাথে কিছু কথা বলতে চায়। আমি বাইরে এসে দাঁড়াতে ওরা হুড়মুড় করে আমার পায়ের ওপর পরে সালাম করলো। ভ্যাবাচ্যাকা  খেয়ে কী করো কী করো বলে কয়েক পা  পেছনে সরে আসতেই একজন বললো, মিস, আপনি নাকি অনেক বড় চাকরি  পেয়ে চলে যাচ্ছেন? আমরা খুব স্যরি, মিস, আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আমাদের মাফ করে দিয়েন। আমাদের জন্য  দোয়া করেন। আসলে… বলে  সে  থেমে  গেলো। পাশ  থেকে আরেকজন বলে উঠলো, মিস, আমরা এরকম করতে চাইনি। নীলাঞ্জন স্যার আমাদেরকে এরকম করতে বাধ্য করেছেন…।

মুহূর্তে সবকিছু জলবৎ তরলং হয়ে  গেলো। এই নীলাঞ্জন, ঢাকা ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগ  থেকে পাশ করা একটা মিচকা শয়তান, স্কুলের সহকারী শিক্ষক।  ঠোঁটে পিছলা হাসি  লেগে আছে সবসময়। কিন্তু এই হাসি মুখে নিয়েই  সে তার  প্রতিপক্ষের বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিতে পারে। নিজের স্বার্থে।  সেও আরও অনেকের সাথে  প্রভাষক পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল। হয়নি। কোথাকার অজপাড়াগাঁয়ের এক  মেয়ে এসে এতো  লোভনীয় চাকরিটা বাগিয়ে  নেবে  প্রথম দিন  থেকেই  সে এটা হজম করতে পারেনি। স্কুলে কিছুদিন কাজ করার সুবাদে ইতিমধ্যে অধ্যক্ষ এবং ম্যানেজিং কমিটির দুয়েকজন সদস্যের সাথে তার সখ্য গড়ে উঠেছে। নিজের দুরভিসন্ধি পূরণের জন্য তাদের আশীর্বাদ নিয়ে  সে কলেজের কিছু কোমলমতি ছাত্রকে বিভ্রান্ত করে আমার  পেছনে  লেলিয়ে দিয়েছে। লাভটা কী হলো?

সতের বছর হলো  সেই কলেজ  থেকে আমি চলে এসেছি। কয়েকবার এর সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করেছি। আমার সময়কার অনেকেই এখন আর  নেই। কিন্তু  কেন জানি আর কখনো ওই কম্পাউন্ডের  ভেতরে  ঢোকার ইচ্ছা হয়নি। বর্তমান চাকরি  ক্ষেত্রেও নিত্যদিন নানারকম ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। মন্দের সংখ্যাই  বেশি। তবে ভাবিনি,  যে ঈর্ষার ব্যর্থ আস্ফালন  দেখে কলেজটা  থেকে  বেরিয়ে এসেছিলাম, আজ এতো বছর বাদে কলেজের স্মৃতিবিজড়িত ব্যাঙ্কটায় গিয়ে আবার একই রকম তিক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো।

সোনালি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা  রেখে আমি  দেশের বাইরে চলে যাই। অ্যাকাউন্ট  থেকে আব্বাকে টাকা পাঠাতাম বলে আবেগপ্রসূত কারণে  সেটি আর বন্ধ করিনি।  দেশে ফিরে ভাবলাম, যাই,  খোঁজ নিই, দেখি কী অবস্থায় আছে।  প্রথম দিন এসে  যে অফিসারের কাছে  গেলাম,  রোকনুজ্জামান নাম,  বেশ ভালো ভদ্র ব্যবহার করলো। আমার অ্যাকাউন্টটা ডর্মেন্ট হয়ে আছে। যা  ভেবেছিলাম তার  থেকেও  বেশি, লাখ খানেকের ওপরে, টাকা আছে।  রোকনুজ্জামান আমাকে অ্যাকাউন্ট রিঅ্যাক্টিভেট করার জন্য চার পাতার ফর্ম দিলো। সাথে অযাচিত পরামর্শ দিলো  ছেলেকে নমিনি করার জন্য। ইত্যবসরে কথা  প্রসঙ্গে  সে  জেনেছে আমি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা এবং তার মতো করে  ভেবে নিয়েছে বিদেশ-টিদেশ ঘুরে  বেশ ভালো পরিমাণের মালপানি কামিয়ে  দেশে ফিরেছি। একজন সাধারণ ব্যাংক অফিসার হিসেবে ওর পিত্তি জ্বলা কি তখন  থেকেই শুরু হয়ে  গেছে?

নির্ধারিত দিনে ফর্ম অর্ধেকটা লিখে নিয়ে,বাকিটা  ভেবেছিলাম ব্যাংকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে লিখবো,  রোকনুজ্জামানের  টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার সামনের  চেয়ারে এক অবসরপ্রাপ্ত বয়স্কা শিক্ষিকা বসে আছেন। আরেকদিকে মহিলার সাথে আসা এক  বয়স্ক পুরুষ দাঁড়ানো। মহিলার পাশের  চেয়ার খালি থাকাতে  সেখানে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম আমার টার্ন আসবার জন্য। এর মধ্যে রোকনুজ্জামান দুয়েকবার আমার দিকে তাকিয়েছে। আমি  ধৈর্য্য ধরে বসে আছি।

বয়স হলে মানুষের কথা বলার  প্রবণতা বাড়ে। এক কথা বারবার বলতে থাকে। শিক্ষিকা মহিলাও  দেখলাম তার ব্যতিক্রম নন। একই বিষয় বারবার জিজ্ঞাসা করছেন।  রোকনুজ্জামান সামান্যতম বিরক্তি বা উষ্মা  প্রকাশ না করে তার কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের  দেশের মানুষ অল্পতেই উত্তেজিত হয়, অস্থির হয়।  রোকনুজ্জামানের ধীর-স্থির স্বভাব আমাকে আস্বস্ত করলো, না,  দেশে এখনো এমন ঠান্ডা  মেজাজের মানুষ আছে তাহলে। আমি মনে মনে তার  ধৈর্য্যশক্তির  প্রশংসা না করে পারলাম না। বরং, পাশে বসে  থেকে মহিলার একই কথায় আমিই বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। অফিসে ফিরতে  দেরি হয়ে যাচ্ছে। একসময় মহিলা  চেয়ার  ছেড়ে উঠলেও  যেতে  যেতে আরো কিছু সময় নষ্ট করলেন।

এরপর আমি শিক্ষিকার কবল  থেকে মুক্তি পাওয়া  রোকনুজ্জামানের সামনে ফর্মের চারটা আলাদা পাতা  মেলে ধরলাম। ছবি  বের করলাম। কিন্তু আমার  চোখ এড়ালো না, আজ  যেন  রোকনুজ্জামানের ব্যবহারে  প্রথম দিনের আন্তরিকতার অভাব (এসব ব্যাপারে আমার ইন্সটিঙ্কট খুবই  প্রবল। অকারণেই বিরক্ত, অধৈর্য্য। অথচ কিছুক্ষণ আগেও  দেখলাম তার অসামান্য  সৌম্য মূর্তি। হঠাৎ কী এমন হলো  যে  সে এতোটা অস্থির হয়ে উঠেছে? এর মধ্যে অন্য  কোন ক্লায়েন্টও  তো আসেনি। এখন আমার  ধৈর্য্য  দেখাবার এবং উপেক্ষা করবার পালা।  যে কাজ নিয়ে এসেছি  সেটা হওয়া নিয়ে কথা। ফর্মের  যে জায়গায় বুঝতে বাকি ছিল, আমি ভদ্রভাবে জানতে চাইলাম  সেখানে কী লিখবো। ভীষণ অবহেলার সাথে  রোকনুজ্জামান কিছু একটা বললো। আমি বুঝতে না  পেরে আবার জানতে চাইলাম। এবার তার  ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো। পড়তে পারেন না ? বলে  সে  খেঁকিয়ে উঠলো।

ততক্ষণে আমারও  ধৈর্যের বাঁধ  ভেঙে  গেছে। এক লাফে  টেবিল  থেকে উঠে সামনে দরকারি  যে কাগজগুলো  রেখেছিলাম  টেনে নিয়ে বললাম, আমি একজন  প্রথম  শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। আর আমি পড়তে পারি না? আমি আমার অ্যাকাউন্ট রিঅ্যাক্টিভেট করবো না। একটা সাদা কাগজ  দেন। আমি ম্যানেজারের কাছে আবেদন করবো। আমার অগ্নিমূর্তি  দেখে  রোকনুজ্জামান চুপসে  গেলো।  সে এমন  প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। তার মুখ  থেকে  কোন কথা  বের হলোনা। পাশের  টেবিলের মহিলা অফিসার ম্যাডাম আপনি বসেন বলে অনুনয় করতে লাগলো। আমি কলমের এক টানে ওই  লোকের সামনেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার আবেদন লিখে  শেষ করলাম। উঠে এসে সহকারী ম্যানেজারকে যা বলার বললাম। আবেদনপত্র দিলাম। তিনি খানিকটা স্যরি হলেন। উচ্চবাচ্চ করলে করা  যেতো। কিন্তু আমার স্বভাবজাত শুভবোধ সক্রিয় হয়ে উঠলো। অ্যাকাউন্ট বন্ধ করবার  প্রয়োজনীয় অনুরোধ করে আমি ব্যাংক  থেকে  বের হয়ে এলাম। আমার মনে তখন একটা কথাই বিস্ময়ের  ঘোরে ঘুরপাক খাচ্ছে। যুগে যুগে নীলাঞ্জন,  রোকনুজ্জামানরা ঘুরেফিরে আসে। একেক সময় একেক নামে, একেক  চেহারায়। নীলাঞ্জন  যোগ্যতাবলে  প্রভাষক পদে আমার চাকরি  প্রাপ্তি  মেনে নিতে পারেনি।  রোকনুজ্জামান সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা হিসেবে একজন শিক্ষিত মহিলার উত্থান হজম করতে পারেনি।

সব শুনে আপনি হয়তো বলবেন, আমার বুঝতে  কোথাও ভুল হচ্ছে নাতো? আমার নিস্পৃহ জবাব: না, মশায়, অনেক  দেখলাম কিনা। নিশ্চয় মানবেন, মানুষের ভালোবাসা  যেমন  বোঝা যায় হাতের সামান্য নাড়াচাড়ায়,  তেমনি ঈর্ষা নামক ওই ইনভিজিবল ব্যাপারটিও ধরতে পারা যায় নাকের সামান্য কুঞ্চনে!

ঈর্ষায় বড়গল্প ভালোবাসায় মালেকা পারভীন