Sunday 15 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তেওতা জমিদার বাড়িতে একবেলা


৩০ মে ২০১৯ ২২:২২ | আপডেট: ১ জুন ২০১৯ ১৯:৪৭
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সপ্তাহ ঘুরে শুক্রবার এলেই আমার মন অকারণ আনন্দে ভরে ওঠে। কারণ, এই দিনটা আমার ঘোরাঘুরির দিন। প্রতি সপ্তাহে একটা করে নতুন জায়গা ঘোরার পরিকল্পনা করেছি।
সেই পরিকল্পনামতোই এক শুক্রবার ঘুরতে গিয়েছি ঢাকার একদম নিকটতম জেলা মানিকগঞ্জ। নদী, জমিদার বাড়ি, গ্রামীণ পরিবেশ- সব মিলে মানিকগঞ্জ সুন্দর এক জেলা। এই জেলায় একসময় অনেক জমিদারদের বাস ছিল। তাদের হাত ধরে রচিত হয়েছে সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। সেই ইতিহাসে চোখ বুলাতেই মানিকগঞ্জ যাওয়া।

পল্টনের বাসা থেকে সকাল ছয়টায় গিয়ে পৌঁছলাম গাবতলী বাসস্ট্যান্ড। গন্তব্য ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জের সবচেয়ে দূরপ্রান্তে অবস্থিত তেওতা জমিদার বাড়ি। তেওতা জমিদার বাড়ির অবস্থান শিবালয় উপজেলায়। সেখানে যেতে হলে প্রথমেই আমাকে যেতে হবে আরিচা। কিন্তু এখন ঢাকা থেকে আরিচা সরাসরি বাস পাওয়া মুশকিল। আর পাওয়া গেলেও যাত্রা খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না। কারণ, বাসের অবস্থা খুব খারাপ। যাই হোক, আমি উথুলিয়া যাওয়ার জন্য ‘পদ্মা লাইন’ নামের বাসে ৮০ টাকার একটি টিকিট কেটে উঠে পড়ি। বাসটি ছাড়ে ৬ টা ৫০ মিনিটে। বাস ছাড়ার সাথে সাথে আমার উত্তেজনা বেড়ে গেলো। অবশেষে যাচ্ছি তাহলে মানিকগঞ্জ!

বিজ্ঞাপন

সবুজ গাছের মধ্যে মধ্যে লাল কৃষ্ণচূড়া উঁকি দিয়ে যাওয়া রাস্তাটা যেন হেলে দুলে স্বাগত জানাচ্ছিলো সারাটা পথ। সা সা করে আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে ছুটছে পদ্মা লাইন। আর বাসের জানালা দিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখছি আমি।

অবশেষে পৌঁছে গেলাম উথুলি। বাসস্ট্যান্ড নেমেই সিএনজিওয়ালাদের হাঁকডাক- ‘এই আরিচা, এই আরিচা, আর একজন’ বলে। ডাক শুনে উঠে পড়লাম ড্রাইভারের ঠিক পাশের সিটে। সাধারনত, কোথাও ঘুরতে যেয়ে সিএনজিতে উঠলে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসি। কারণ, সামনে বসলে রাস্তার আশেপাশের দৃশ্যগুলো ভালোভাবে দেখা যায়।

উথুলি থেকে ১০ টাকা ভাড়ায় চলে আসলাম আরিচা লঞ্চ ঘাট। সেখানে অনেক রিকশা, অটো দাঁড়িয়ে থাকে তেওতা যাওয়ার জন্য। একটা রিকশায় উঠে পড়ি। ৩ থেকে ৫ মিনিট চলার পর রাস্তার একটা মোড় ঘুরতেই হঠাৎ আমার চোখ যায় দিগন্তবিস্তৃত যমুনা নদীর দিকে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা যমুনার একূল থেকে ওকূল দেখা যায়না। শুধু পানি আর পানি। এতো সকালেই যমুনার ঘাটে কাপড় কাচতে এসেছে এক নারী। পাশেই সার বাঁধা নৌকা। নৌকাগুলো জোয়ারের পানির ধাক্কায় দোল খাচ্ছে। শান্ত সকালে এই দৃশ্য, আর ঢেউ ভাঙার শব্দ চোখ আর কান যেন জুড়িয়ে দিল।

কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম তেওতা জমিদার বাড়ির সীমানায়। তেওতা বাজারে রিকশাটা ঢুকতেই স্বাগত জানালো জমিদার বাড়ির সামনে বিশাল সাদা রঙের নবরত্ন মঠ। মঠের সামনে পৌঁছলে আমি রিকশা ভাড়া দিতে ভুলে গিয়ে হা করে তাকিয়ে ছিলাম বিশাল জমিদার বাড়ির দিকে।

তারপর রিকশাওয়ালাকে ৩০ টাকা ভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে গেলাম বর্তমানে ধ্বংসাবশেষ হয়ে পড়ে থাকা জমিদার বাড়ির অন্দর মহলের সামনে। পাশেই খেলা করছিল একদল কিশোর। একাই ঘুরতে গিয়েছি। কিন্তু এই জায়গাটা একা ঘুরে মজা পাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছিল। সঙ্গী প্রয়োজন। তাই সবাইকে ডেকে কিছুটা খাতির করে নিলাম। তারপর ওদের নিয়ে অন্দরমহলের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে গেলাম। ভেতরে যেতেই বাড়ির মালিকের বিলাসিতা আর আভিজাত্যের প্রমাণ পেলাম।

ইউরোপীয় ও মুঘোল স্থাপত্যশৈলির মিশ্রণে বানানো এই বাড়িটা এখনও তার পুরনো গৌরব মনে করিয়ে দেয়। চমৎকার কারুকার্যময় বাড়ির দেওয়াল আর স্তম্ভ। সুনিপুণ এই কারুকাজ যদিও এখন ভেঙ্গে গেছে অনেকটা। তবুও সৌন্দর্য বোঝা যায়।

এসব দেখতে দেখতে চলে গেলাম অন্দরমহলের ছাদে। সেখানে উঠেই চোখ জুড়িয়ে গেলো উপর থেকে জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য দেখে আর শরীর জুড়িয়ে গেলো ঠান্ডা বাতাসে।

সপ্তদশ শতকে পঞ্চানন সেন নামের এক তামাক ব্যবসায়ী এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন। ৭৩৮ একর জমির উপর নির্মিত বাড়িটিতে সব মিলিয়ে ৫৫ টি কক্ষ আছে। পুরো জমিদার বাড়িটা দুটো এস্টেটে ভাগ করা- একটা হরিশংকর এস্টেট আর একটা জয়শংকর এস্টেট। অন্দরমহলের মাঠের সামনে নবরত্ন মঠসহ আছে আরো কয়েকটি মঠ। তাছাড়া আছে একটি নটমন্দির। বাড়িটার এমনই ভগ্ন দশা যে প্রতিটা পদক্ষেপে ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছিল। ভবনটির এমন ঝুঁকিপূর্ণ ও নাজুক অবস্থা দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনটি যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আশংকা আছে যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটার।

এই তেওতা জমিদার বাড়ি ও তার আশপাশের এলাকা যে কারণে মানুষের মুখে মুখে ফেরে, তা হলো এর সাথে জড়িত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রেমের ইতিহাস। এখানে বসেই কাজী নজরুল তার প্রেমিকা প্রমীলা দেবির প্রেমে পড়ে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা ‘তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়। সে কি মোর অপরাধ?’

তেওতা জমিদার বাড়ির চারপাশ ঘিরে ইতিহাস এখনো যেন নজরুল-প্রমিলার স্মৃতিঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। বাড়ির প্রতিটা জায়গা ঘোরাঘুরি আর ইতিহাসে চোখ বোলাতে বোলাতে আর ক্যামেরার লেন্সে স্মৃতি ধরে রাখতে রাখতে কখন যে ঘন্টা দুই কেটে গেলো টেরই পেলাম না।

কিশোরগুলো সারা বাড়িময় আমাকে ঘুরে দেখিয়েছে আর সাথে শুনিয়েছে মজার সব গল্প। সুন্দর সময়গুলো সবসময়ই কম মনে হয়। আবারও কখনও সুযোগ পেলে আবারও আসবো তেওতা নজরুলের স্মৃতিঘেরা তেওতা জমিদার বাড়ি।

আবদুল্লাহ আল মামুন এরিন তেওতা জমিদার বাড়িতে একবেলা ভ্রমণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর