শূন্য
৩০ মে ২০১৯ ২১:৩৮
যিশা আছে বিরাট আনন্দে। আজ ছুটির দিন। তার ইশকুল নেই। যিশা বলল, আজ হচ্ছে আনন্দের ওপর আনন্দ- ডবল আনন্দ। যিশার বিশেষ আনন্দের কারণ হচ্ছে সেজোমামা এসেছে। সেজোমামার অফিসে একটা নাম আছে। বেশ লম্বা নাম। যিশার সবসময় সেটা মনে থাকে না। সে মনে রাখারও চেষ্টা করে না। সেজোমামা তার কাছে সেজোমামা। সেজোমামার আলাদা কোনো নামের দরকার হয় না। তবে মা তাকে ভিকুট নামে ডাকে এটা যিশা শুনেছে। সেজোমামা চাকরি করে মহাকাশ গবেষণা সংস্থার টাইম অ্যান্ড স্পেস ডিভিশনে। বয়স ৪৩ বছর। দেখলে মনে হয় ৩৩ বছরের তরুণ। সব সময় আনন্দে থাকে। এবার এসেই বলল, যিশা ফাটাফাটি অফার আছে। সেজোমামার অফার মানেই বাইরে ঘুরতে যাওয়া। যিশা যখন পঞ্চম শ্রেণি পাশ করল তখন মামা তাকে নিয়ে গেল ভূটানে বেড়াতে। তারপর থেকে প্রতিবছর পরীক্ষা শেষে মামা যিশাকে কোনো একটা দেশ দেখিয়ে নিয়ে আসে। সে ইন্ডিয়া, নেপাল, আমেরিকা আর আফ্রিকা ঘুরে এসেছে।
যিশা বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি, মামা?
সেজোমামা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলো আশপাশে কেউ নেই। গলার স্বর নামিয়ে বলল, টপ সিক্রেট। শুধু তুই আর আমি জানব।
যিশা বলল, আমার পেটে বোমা বেঁধে পরীক্ষা করে দেখতে পারো আমি গোপন কথা বলে দিই কিনা। মামা, তোমাকে কথা দিচ্ছি আমাকে রিমান্ডে নিলেও আমি বলল না। টপ সিক্রেট বলো এবার।
সেজোমামা জিগ্যেস করল, তোর এসএসসি পরীক্ষা কবে?
যিশা ঠোঁট উলটে বলল, সে অনেক দেরি আছে। তার আগে একগাদা মডেল টেস্ট, প্রিটেস্ট, টেস্ট!
মামা গম্ভীর গলায় বলল, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
লেফট-রাইট টাইপ, মামা। কোনো ওঠানামা নেই। সমান তালে হয়ে যাচ্ছে।
সেই তালটা কি গাছের ওপরে নাকি গোড়ায়?
ওপরেই আছে মামা। টপ সিক্রেট বলো।
সেজোমামা বলল, জুপিটারে যাচ্ছি।
লাফিয়ে উঠতে গিয়ে যিশা থমকে গেছে। তার থমকে যাওয়ার কারণ হচ্ছে দুটো। সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেনি মামা কী বলেছে। জুপিটার হচ্ছে গ্রহ। মামা তাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে! নিয়ে যেতেও পারে, কারণ মামা মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় কাজ করে। মাঝেমধ্যে পৃথিবীর কাছাকাছি গ্রহ থেকে ঘুরে আসে। কিছুদিন আগে ঘুরে এসেছে শুক্রগ্রহ থেকে। যিশার জন্য সেখানকার পাথর নিয়ে এসেছিল।
যিশার থমকে যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মা ঘরে ঢুকেছেন।
মা বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?
সেজোমামা বলল, জুপিটারে যাচ্ছি বুবু। সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতি।
যিশা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে না মামা কেন মাকে টপ সিক্রেট ব্যাপারটা বলে দিচ্ছে।
মায়ের কাছে মামার জুপিটারে যাওয়ার ঘটনা খুব স্বাভাবিক মনে হলো। যেখানেই যাস ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস। শুকিয়ে তো একেবারে সুতো হয়ে গেছিস।
মায়ের হাতে ট্রে। তাতে নানারকমের খাবার। সেজোমামা বাড়িতে ঢোকার সঙ্গেসঙ্গে মা তার জন্য খাবারের আয়োজন করতে চলে গেছেন। মিটবলের প্লেট মামার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তিতির আর টার্কির মিক্সড। খেয়ে বল কেমন হয়েছে। সেজোমামা বলল, তোমার হাতের ঘাসভাজিও অসাধারণ, বুবু। মা বললেন, তার মানে আমার রান্না তোর কাছে ঘাস-ঘাস লাগে! যিশার অস্থির লাগছে। মায়ের সামনে জুপিটারে যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করা ঠিক হবে কিনা সে বুঝতে পারছে না। মামা ঘটনা বলে দিয়েছে। তাকে বলেছে টপ সিক্রেট। সে আছে বিশাল টানাটানির ভেতর।
সেজোমামা বলল, এবার ফিরতে বেশ কিছুদিন দেরি হবে। তাই ভাবছি যাওয়ার আগে যিশাকে নিয়ে কয়েকদিন ঘুরে আসি।
ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেছে যিশা। সে বুঝতে পেরেছে মামা তাকে নিয়ে জুপিটারে যাচ্ছে না, একা যাচ্ছে। তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে। সেই অন্য কোথাও ব্যাপারটাই হচ্ছে টপ সিক্রেট। সেটা মনে হতেই যিশা আবার অস্থিরতা বোধ করতে থাকল।
মা বললেন, যিশার সামনে পরীক্ষা!
মামা বলল, আমি যখন ফিরব তখন ওর পরীক্ষার রেজাল্ট হয়ে যাবে। যিশা পরীক্ষায় ভালো করবে। কলেজে ভর্তি হবে। সেলিব্রেশনটা অনেক দেরি হয়ে যাবে, বুবু। পরীক্ষায় আগেই তাই ওকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। যিশার পরীক্ষার বেশ কিছুদিন দেরি আছে। বেশি দূরে যাব না। আমাদের হেড অফিস ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনি।
আবার হতাশ হয়ে গেল যিশা। অফিস দেখার মতো কোনো জায়গা না। হোক সেটা মহাকাশ গবেষণা অফিস। তা ছাড়া মামা তাকে সেই অফিস একবার ঘুরিয়ে দেখিয়ে এনেছে।
মা বললেন, যিশার মতামত এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সে যা বলবে তাই।
খাবার রেখে মা চলে গেছেন।
যিশা লাফিয়ে উঠে বলল, মামা ঘটনা কী? অফিস দেখাতে নিয়ে যাচ্ছ মানে!
সেজো মামা বলল, প্রমিজ কর, তুই কাউকে কিছু বলবি না।
অবাক হয়েছে যিশা। মামাকে ভীষণ সিরিয়াস দেখাচ্ছে। যিশা বলল, প্রমিজ।
মামা বলল, তোর জন্য অফিস থেকে স্পেশাল পারমিশন নিয়েছি। আমাদের একটা প্রজেক্ট-অফিসে নিয়ে যাব তোকে। প্রজেক্ট হেড আমার ব্যাচমেট, বন্ধুমানুষ। অনুমতি পাওয়া গেছে।
খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে দুজনের কারও খেয়াল নেই। যিশা খানিক দ্বিধা আর কৌতুহল নিয়ে বলল, কিসের প্রজেক্ট মামা? সেজোমামা বলল, আগামী ভ্রমণ।
যিশা কিছু বুঝতে পারল না। সেজোমামা বুঝিয়ে দিলো। আমরা ভবিষ্যতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। পরীক্ষা সফল হয়েছে। বিশেষ কিছু কারণে সরকারিভাবে সেটা এখনো প্রকাশ করা হচ্ছে না। সফল পরীক্ষার পর আমাদের খুব কাছের দু’একজনকে আমরা পাঠাচ্ছি। তবে অতি গোপনে। তোর জন্য অনুমতি জোগাড় করেছি।
যিশা ঠিকঠাক মতো বুঝতে পারছে না সেজোমামা তারসঙ্গে দুষ্টুমি করছে কিনা। মামা কখনো এরকম দুষ্টুমি করে না। সে যখন বলেছে তারমানে ঘটনা সত্য। একথা মনে হতেই যিশা নিজের ভেতর প্রচ- উত্তেজনা বোধ করল। দুপাশে দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বিশাল জোরে চিৎকার করে উঠল, ইয়াহু।
মা বললেন, কী হলো?
সেজোমামা বলল, আমরা আগামীকাল বেড়াতে যাচ্ছি।
২.
শারীরিক পরীক্ষা শেষে যিশাকে একটি ক্যাপসুলের ভেতর শোয়ানো হয়েছে। ক্যাপসুলের নিচের অংশ লাল আর নীল রংয়ের। অর্ধেকটা লাল, অর্ধেকটা নীল। ওপরে স্বচ্ছ কাচ।
ক্যাপসুলে ঢোকানোর আগে সেজোমামা বলল, তুই সেখানে থাকবি আধাঘন্টা বা তারও কম সময়। তোর কাছে মনে হবে অনেকদিন। তাহিতা নামে একজন সেখানে তোকে রিসিভ করবে। সেটা কয়েকশ বছর পরের পৃথিবী। তোর যেমন ইচ্ছে এনজয় করবি। কিছু খেতে ইচ্ছে করলে খাবি। ওরা আমাদের কাছে বিল পাঠিয়ে দেবে। অসুবিধা নেই। শুধু এমন কিছু সঙ্গে আনতে পারবি না যা দেখা যায়। তোর কাছে ভবিষ্যতের কিছু দেখলে এখানে হৈচৈ পড়ে যাবে।
ক্যাপসুলে যিশার মাথা আরামদায়ক একটা হেলমেটের ভেতর রাখা। সুন্দর মিউজিক বাজছে। যিশার ভালো লাগছে। ক্যাপসুলের তাপমাত্রা হালকা শীতল। তাতে শীত লাগছে না বরং ভালো লাগছে। যিশার ঘুম পাচ্ছে। সে আলতো করে চোখ বন্ধ করল। যিশা ঘুমিয়ে গেছে।
৩.
তাহিতা বলল, তোমাকে অভিবাদন যিশা। আশা করি তুমি ভালো আছ।
যিশা বড়ো হলঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। এটা ভবিষ্যত পৃথিবীর ঘর। যিশার কাছে বিশেষ নতুন কিছু মনে হলো না। একবার সন্দেহ হলো তাহিতা নামে যে মেয়েটিকে সে সামনে দেখছে সে হয়তো সামনে দাঁড়িয়ে নেই। এটা তাহিতার হলোগ্রাফিক ইমেজ।
যিশা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয় ভালো আছ তাহিতা? আমি ভালো আছি।
তাহিতা তারসঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তার মানে এটা হলোগ্রাফিক ইমেজ নয়, সত্যিকারের মানুষ। যিশা অবশ্য এখনো বুঝতে পারেনি সে সত্যিকারের মানুষ নাকি মানুষের আদলে তৈরি রোবট।
তাহিতা বলল, তোমাকে সব দেখাব। তোমার যা জানতে ইচ্ছে করে আমাকে বলবে। খেতে ইচ্ছে করলে, কিছু চাইলে অস্বস্তি বোধ করবে না। আমি তোমার বন্ধু।
যিশার ভালো লাগছে। তাহিতা তার সমবয়সী। বেশ হাসিখুশি মেয়ে, আন্তরিক। যিশা বলল, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
তাহিতা মনে হলো ধাক্কা খেয়েছে। যিশার প্রশ্ন সে ঠিক বুঝতে পারেনি। তাহিতা বলল, চলো আমরা কোথাও গিয়ে বসে কথা বলি।
তাহিতা ঘরের দেয়ালের তাকে ঝোলানো দুটো ব্যাগমতো জিনিস নামাল। সেদুটো মেঝেতে রাখতেই ফুলেফেঁপে ছোটো দুটো উড়োযান হয়ে গেল। তাহিতা দেখিয়ে দিল কেমন করে চালাতে হয়। তারা দুজন উড়োযানে চড়ে উড়ে গেল অনেকদূর। যিশা দেখল অতি সুন্দর এক শহর। সাজানো গোছানো, ঝকঝকে তকতকে। সেদিকে তাকালে চোখ জুড়ায়। চোখে আরাম লাগে। চারদিকে সবুজ আর কেমন যেন নরম ভেজাভেজা। যেন শিশির জমে আছে সবখানে।
ওরা এসে যেখানে নামল সেটা বাগান। গাছগুলো অচেনা, ফুলগুলোও। অনেক পাখি আছে বাগানে। যিশা কোনো পাখি চিনতে পারল না। বাগানের সামনে দিয়ে হ্রদের মতো। হ্রদের পানি ঝকঝকে নীল।
বিকেলের মতো ছায়াছায়া ভাব। এখন বিকেল কিনা যিশা জানে না, নাকি সবসময় আবহাওয়া এরকমই থাকে তাও বুঝতে পারছে না। কেন জানি তার এটা জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করল না। সে সামনে ঝকঝকে নীল পানির ওপর পাখিগুলোর খেলা দেখতে থাকল।
তাহিতা বলল, তুমি কিছু জানতে চেয়েছিলে।
যিশার মনে পড়েছে। সে বলল, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
তাহিতা বলল, তোমার প্রশ্ন শোনার পর তোমাদের সময়ের কাছ থেকে আমি উত্তর জানার চেষ্টা করেছি। এখানে আমরা পড়ি না।
আঁতকে উঠল যিশা, তোমরা পড়ো না! মানে এখানে কোনো ইশকুল, কলেজ নেই?
তাহিতা বলল, তুমি যখন পড়ো তখন সেই তথ্য তোমার ব্রেইনের নিউরনে জমা হয়। সেটা তোমার জ্ঞান। আবার তুমি যা শোনো, দেখো বা করো- যা থেকে তোমার অভিজ্ঞতা হয় সেটাও জ্ঞানে পরিণত হয়। এখানে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আলাদা করে ব্রেইনে ইন্সটল করে দেওয়া হয়। পড়াশোনা করে জ্ঞান অর্জন করতে হয় না।
যিশার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না ঘটনা কীভাবে ঘটে। যিশা বলল, আমাকে বুঝিয়ে বলবে তুমি যা বলছ?
তাহিতা বলল, খুব ছোটোবেলায় ঠিক করে ফেলা হয় একজন বড়ো হয়ে কী হবে। এটা পরিবার ও একাডেমিক কাউন্সিল ঠিক করে দেয়। একাডেমিক কাউন্সিল হচ্ছে এখানে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক। অবশ্য কেউ বড়ো হয়ে তার পেশা বা আকাক্সক্ষার ব্যাপারটা বদলে ফেলতে পারে।
যিশা অস্থির হয়ে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তাহিতা বলল, পরিবার ও একাডেমিক কাউন্সিল যখন নির্ধারণ করে কেউ একজন বড়ো হয়ে কী হবে তখন তার ব্রেইনে সেই বিষয়ে তথ্য, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মেমোরি ইন্সটল করা হয়। তার নিজের ব্রেইন তখন আর কাজ করে না। সেটার কোনো প্রয়োজন হয় না। দরকারী সব তথ্য আলাদাভাবে মেমেরি চিপসে দেওয়া থাকে। এটা ন্যানো চিপস। এখানে জীবনের জন্য যা প্রয়োজন সমস্ত জ্ঞান থাকে।
কেউ যদি বড়ো হয়ে শিল্পী হতে চায়?
তার ব্রেইনের ন্যানো চিপসে ছবি আঁকা বা অভিনয় যা করতে চায় তার জ্ঞান ও দক্ষতা দেওয়া হবে। সে বড়ো হতে হতে সেই জ্ঞানের চর্চা করবে শুধু। এভাবেই একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়র, কিংবা কবি-সাহিত্যিক হতে পারে।
আমি যদি চাই তাহলে আমার ব্রেইনে কি সেরকম মেমোরি ইন্সটল করা যাবে?
তাহিতা বলল, যাবে। তবে আমাদের উদালের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি মেমোরি স্টেশনের প্রধান। উদাল নিশ্চয় একাডেমিক কাউন্সিলের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবে।
৪.
উদাল নামে যার কাছে ওরা এসেছে সে বেশ মোটামোটা নাদুসনুদুস একজন মানুষ। যিশার মনে হলো এই লোক সব সময় বসে থাকেন। বসে বসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া-আসা করেন। তিনি এত মোটা যে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই।
যিশা তার কথা জানিয়েছে। উদাল কিছুক্ষণ সময় নিলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমতি পাওয়া গেছে। তোমাদের সময় থেকে তোমার পাঠ্যবইয়ের পুরো তথ্য নিয়ে এসেছি। সিলেবাসে যা আছে সব। বড়ো হয়ে তুমি চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছ। আমরা সে ব্যবস্থাও করেছি। প্রয়োজনীয় সমস্ত জ্ঞান আমরা তোমার ব্রেইনে আলাদা মেমোরি চিপসে ইন্সটল করে দিচ্ছি। তোমার ব্রেইন নিউরন থেকে স্মৃতিগুলো কপি করে মেমোরি চিপসে পেস্ট করে দিয়েছি। তোমার নিজের ব্রেইনের এখন আর কোনো দরকার নেই।
যিশা মহা খুশি মনে ব্রেইনে তার পড়াশোনার যাবতীয় তথ্য ইন্সটল করে নিয়ে বর্তমান সময়ে ফিরে এলো।
৫.
মা বললেন, কী রে যিশা তোর যে মডেল টেস্ট চলছে তুই ভুলে গেছিস? উপুড় হয়ে শুয়ে সিনেমা দেখছিস!
যিশা বলল, পড়া হয়ে গেছে, মা।
মা বললেন, ফাজলামি হচ্ছে? তোকে আমি কয়েকদিন একবারও পড়তে দেখিনি। সবসময় দেখি হয় সিনেমা দেখছিস নাহয় গল্পের বই পড়ছিস।
যিশা বলল, ইস মা, গল্পের বইগুলো একবারে যদি সব ব্রেইনে ইন্সটল করে নেওয়া যেত!
মা বললেন, কী বললি?
যিশা থতমত খেয়ে বলল, কিছু বলিনি মা। বললাম, গল্পের বইগুলো যদি সব একবারে পড়ে ফেলা যেত!
এখন ক্লাসের পড়া পড়।
আমি কোনো পরীক্ষা খারাপ দিয়েছি তুমি বলো?
এটাই মায়ের কাছে বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। আগে যিশা পরীক্ষার আগে নাকমুখ গুঁজে পড়তো। এখন একদম লেখাপড়া করে না। তবু প্রত্যেকটা পরীক্ষাতে সে পূর্ণ নম্বর পাচ্ছে। কীভাবে পাচ্ছে মা বুঝতে পারছেন না।
৬.
যিশা বিশাল সমস্যায় পড়ে গেল প্রিটেস্টের দ্বিতীয় পরীক্ষা দিতে গিয়ে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। তার কিছু মনে পড়ছে না। মাথার ভেতর সব শূন্য মনে হচ্ছে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কাউকে দেখে যেন চিনতে পারছে না।
যিশাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তাররা তার সবরকমের পরীক্ষা করলেন। সব ঠিক আছে। যিশার অসুস্থতার কারণ ডাক্তাররা বুঝতে পারলেন না। কম্পিউটেড টমোগ্রাফিতে তারা ব্রেইনের একপাশে আবছা বিন্দুর মতো দেখলেন। সেটা কী অনুমান করতে পারলেন না। ডাক্তাররা তার ব্রেইনের ম্যাগনেটিক রোজোন্যান্স ইমেজিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন।
খবর পেয়ে সেজোমামা চলে এসেছে। যিশার আগামী ভ্রমণের সব তথ্য তার কাছে আছে। যিশাকে দেখে মামা ঘটনা বুঝে ফেলেছে। যিশার ব্রেইনে লাগানো মেমোরি ন্যানো চিপস ক্র্যাশ করেছে। সেখান থেকে যিশা আর কোনো তথ্য পাচ্ছে না। আলাদা করে মেমোরি চিপস লাগানো হয়েছে বলে তার নিজের ব্রেইন কাজ করছে না। সে আর এখন কিছু মনে করতে পারছে না।
সেজোমামা বলল, যিশাকে আমার পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাই।
হাসপাতালের ডাক্তাররা বললেন, তার ব্রেইনে কিছু একটা ধরা পড়েছে সেটা আমরা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছি।
সেজোমামা তাদের সেটা পরীক্ষা করে দেখতে দিলেন না। তিনি জোর করে যিশাকে নিয়ে গেলেন। আগামী ভ্রমণ প্রজেক্ট অফিসে কথা বলে তখুনি যিশাকে আগামী সময়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলে দেওয়া হয়েছে, যিশার ব্রেইনে নতুন করে কোনো মেমোরি চিপস লাগানোর দরকার নেই। তার নিজের ব্রেইন যেন তারা সচল করে দেয়।
৭.
যিশা ফিরে এসেছে। এখন সে তার নিজের ঘরে। যিশা কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠেছে। বেশ ঝরঝরে বোধ করছে। আগামীকাল পরীক্ষা আছে সেটা মনে পড়েছে। যিশা নাকমুখ গুঁজে পড়তে বসেছে।
সেজোমামা এসেছে। যিশা ফিসফিস করে বলল, মামা, আমার মনে আছে আগামী ভ্রমণের সময় আমি ব্রেইনে ন্যানো মেমোরি চিপস লাগিয়ে এনেছিলাম।
মামা বলল, পরীক্ষার হলে সেই মেমোরি চিপস ক্র্যাশ করেছিল। তোর নিজের ব্রেইন তখন ছিল অকেজো। তুই কিছু মনে করতে পারছিলি না।
যিশা বলল, এখন বুঝতে পারছি মামা, নিজের ব্রেইনের ওপর আস্থা রাখা ভালো।
সেজোমামা গম্ভীর গলায় বলল, আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আগে শতকিয়া পড়ানো হতো। এখন আমরা তিনের ঘরের নামতা জানি না। তিনের সঙ্গে তেরো গুন করতে হলে ক্যালকুলেটর টিপি। আগে যেকোনো তথ্যের জন্য আমাদের বই ঘাটতে হতো, লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হতো, তাতে ব্রেইনের ব্যায়াম হতো। এখন অ্যাপসে চাপ দিলেই সব তথ্য চলে আসে। আমাকে চিন্তা করতে হয় না। গাড়ি চালানোর সময় রাস্তা চিনিয়ে দেয় গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম। যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স থেকে। আমাকে ভাবতে হয় না। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স এখন হার্টের অপারেশন করছে। আমরা শুধু তাকিয়ে দেখছি। ধীরে ধীরে আমাদের ব্রেইন অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
যিশা বলল, আগামীর কাছে তোমরা খবর পাঠাও, মামা- আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সের চর্চা যত বেশি হবে তত আমরা অথর্ব হয়ে যাব। আমাদের নিজ ব্রেইন হয়ে যাবে অসাড়। কোনো একদিন সিস্টেম ক্র্যাশ করলে মেরামত করার মতো নিজস্ব জ্ঞানটুকুও আমাদের থাকবে না। আমরা হয়ে পড়ব অসহায়, শূন্য এক পৃথিবীর মানুষ।
সেজোমামা আলতো করে যিশার মাথায় হাত রাখল। যিশা জড়িয়ে ধরল মামাকে। মামা বলল, তুই একদম ঠিক বলেছিস। তোর কথা জানিয়ে দেব। আজ এবং আগামীদিনের পৃথিবী মনে রাখবে তোকে।
যিশার কেন জানি ভালো লাগছে। সেজোমামাকে জড়িয়ে ধরে যিশা আনন্দে কেঁদে ফেলল।