Thursday 26 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পদ্মা নদীর মাঝি: এক কালজয়ী আঞ্চলিক উপন্যাসের আখ্যান

ফাহিম হাসনাত
২৬ জুন ২০২৫ ১৮:১৪

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ একটি অবিসংবাদিত নাম। অলঙ্কার শাস্ত্রের সংজ্ঞানুসারে এটি নিঃসন্দেহে একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। এর আঙ্গিক গঠন, বুননশৈলী, চরিত্রদের মুখে আরোপিত ভাষা, জীবনাচরণ এবং জীবনদৃষ্টি – সবকিছুই আঞ্চলিক উপন্যাসের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই উপন্যাসের জগৎ বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে ছিল সম্পূর্ণ এক অজানা দিগন্ত, যা এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।

বিশিষ্ট সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বঙ্গ সাহিত্য উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থে এই উপন্যাসের জনপ্রিয়তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন যে, এর একটি কারণ হলো বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব – পদ্মানদীর মাঝিদের দুঃসাহসিক ও কিছুটা অসাধারণ জীবনযাত্রার আকর্ষণ। দ্বিতীয়ত, পূর্ববঙ্গের সরস ও কৃত্রিমতা বর্জিত কথ্য ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগ। তবে তার মতে, উপন্যাসটির সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হলো জীবনের চিত্রাঙ্কনে শুদ্ধ ও নিখুঁত পরিমিতিবোধ এবং এর সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে সনাতন মানব-প্রবৃত্তিগুলির ক্ষুদ্র সংঘাত ও মৃদু উচ্ছ্বাসের যথাযথ চিত্রণ।

বিজ্ঞাপন

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কর্মোদ্যমের লেখক হলেও, তিনি ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাকে ‘কল্লোলের উত্তর পুরুষ’ আখ্যা দিলেও, মানিক নিজেই তার ‘লেখকের কথা’য় কল্লোলীয়দের সঙ্গে নিজের মনোভঙ্গির পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তার লেখায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের মতো পূর্বসূরিদের বা কল্লোল-বিচিত্রা-প্রবাসী কেন্দ্রিক সমকালীন প্রথিতযশা লেখকদের পথ অনুসরণ না করে, ভিন্ন এক জীবনদৃষ্টি নিয়ে তিনি কলম ধরেছেন। তার নির্মোহ, নিরাবেগ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির প্রতিফলন দেখা যায় তার সৃষ্টিতে। প্রশ্ন ওঠে, এই বাস্তববাদী দৃষ্টি নিয়ে তিনি সমকালীন পরিবেশ সম্পর্কে কতটা নির্মোহ ও নিরাবেগ হতে পেরেছিলেন?

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মাত্র ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে প্রায় ২০ বছর উপন্যাস লেখায় নিযুক্ত ছিলেন। তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘জননী’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। এর মধ্যে শেষ দুটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট পূর্ববঙ্গের নদীতীরের গ্রাম। ছেলেবেলা থেকেই নদীমাতৃক পূর্ব বাংলা ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে মাঝি-জেলেদের জীবনের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটেছিল। এই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন – ‘শহুরে সমাজের বিলাস ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত চাষী, মজুর, মাঝি, মাল্লা, গাড়োয়ান, বাগদিদের রুক্ষ, কঠোর, সংস্কারাচ্ছন্ন, বিচিত্র জীবন কেন অবহেলিত হয়ে থাকে, কেন এই বিরাট মানবতা সাহিত্যে স্থান পায় না?’ এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সৃষ্টি হয়েছিল ‘পদ্মানদীর মাঝি’।

উপন্যাসের পটভূমি ও চরিত্র _

‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চল। দেবীগঞ্জ ও আমিনবাড়ি পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম। এই উপন্যাসে পদ্মার তীরবর্তী কেতুপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাঝি ও জেলেদের বিশ্বস্ত জীবনালেখ্য চিত্রিত হয়েছে। পদ্মা নদীর প্রলয়ংকরী স্বভাব এবং এর তীরবর্তী গ্রামের দীন-দরিদ্র জেলে-মাঝিদের জীবনসংগ্রাম, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও অভাব-অভিযোগ এখানে বিশ্বস্ততার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই যেন তাদের জীবনের পরম আরাধ্য।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কুবের। সে পদ্মার এক পারদর্শী মাঝি, যে নিজের জীবনের সীমাবদ্ধতা এবং পরিবারের অভাব-দারিদ্র্যের মধ্যে লড়াই করে। চিরপঙ্গু স্ত্রী মালা এবং সন্তানদের প্রতি তার স্নেহময়তা থাকলেও, মালার বোন কপিলার প্রতি তার আদিম আকর্ষণ উপন্যাসের কাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই কুবেরই একসময় চুরির অভিযোগে জেল খাটার ভয়ে হোসেন মিয়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এবং কপিলার হাত ধরে পাড়ি জমায় হোসেন মিয়ার স্বপ্নের ময়নাদ্বীপে, পেছনে ফেলে আসে তার অতীত জীবন ও অসহায় পরিবারকে।

কপিলা উপন্যাসের নায়িকা। সে চতুর, চপল ও উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন এক যুবতী, যার আচরণে কিছুটা আদিম ও অসংষ্কৃত মনের পরিচয় মেলে। কুবেরের জীবনে সে পদ্মার মতোই চঞ্চল ও মুক্তির আশ্রয়। তার রহস্যময় চরিত্র পাঠককে মুগ্ধ করে।

হোসেন মিয়া এই উপন্যাসের এক রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। নোয়াখালীর এই ব্যক্তি সমুদ্রের বুকে একটি দ্বীপের পত্তন ঘটিয়ে সেখানে বিভিন্ন এলাকার দরিদ্র মানুষদের নিয়ে ময়নাবাসী গড়ে তুলেছিল। তার স্বপ্ন ছিল এমন একটি জনসমাজ গড়ে তোলা, যেখানে দলমত ও ধর্মমত নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ মানবীয় মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গড়ে তুলবে। তার এই ময়নাদ্বীপই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শোষণমুক্ত সমাজভাবনার প্রতীক।

অভিনবত্ব ও সীমাবদ্ধতা _

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের স্বতন্ত্রতা ময়নাদ্বীপকে কেন্দ্র করে নির্মিত হলেও, এর মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে কুবের-কপিলার প্রেম। উপন্যাসের মূল ঘটনাগুলো যেমন মালার পঙ্গুতা, কুবেরের ঘর ভাঙা, গোপীর পা ভাঙা, হোসেনের সঙ্গে কুবেরের মেয়ের বিয়ে স্থির করা – সবকিছুই কপিলা-কুবেরের সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে। সমালোচকদের একাংশের মতে, প্রকৃতি ও মানুষের অবিরাম সংগ্রামের কাহিনি বা ময়নাদ্বীপকে কেন্দ্র করে প্রকাশের সমস্ত রকম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মানিক নরনারীর সম্পর্কের অমোঘ আকর্ষণের প্রতিই অভিনিবিষ্ট হয়েছেন। তবে, নদীকেন্দ্রিক আঞ্চলিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে সেইসময় প্রায় ছিল না, এবং এই উপন্যাসের মাধ্যমে পদ্মাবিধৌত পূর্ববঙ্গ উপন্যাসের পাতায় বিশেষ স্থান লাভ করে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার লেখক জীবনের প্রথম দিকে ফ্রয়েডীয় ছায়া দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি মার্কসীয় দর্শনে দীক্ষা নেন। এই উপন্যাসটি এই দুই ভাবনার সম্মিলনে রচিত। মার্কসীয় দর্শনে তখনও তিনি পুরোপুরি দীক্ষিত না হলেও, ফ্রয়েডের মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চরিত্রের নির্মোহ রহস্য উন্মোচনে ব্যস্ত ছিলেন। এই উপন্যাসের সমাপ্তি কোনো নিয়তি-তাড়িত নয়, বরং ময়নাদ্বীপে এক কঠোর সংগ্রামে কপিলা-কুবেরের নতুন জীবন শুরুর সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে মানিক তার কলমের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।

বিশ্বজনীন আবেদন ও চলচ্চিত্রায়ন _

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ জেলে অধ্যুষিত গ্রামের জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও, এর আবেদন বিশ্বজনীন। এই উপন্যাসের কোথাও ‘এই ধীবর পল্লীর জীবনযাত্রায় শিক্ষিত আভিজাত্যের মার্জিত রুচি ও উচ্চ আদর্শবাদের জয়পাত নাই।’ এখানকার অধিবাসীদের দেনা, প্রতিদানহীনতা, প্রীতি, সমবেদনা, ক্রান্তি, দলাদলি সবই বাইরের নব্য সভ্যতার সাড়া নিজ প্রকৃতি নির্ধারিত সংকীর্ণ বক্ষপথে আবর্তিত হয়েছে। একটি সুখপাঠ্য, সার্থক ও বিশিষ্ট আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে এখানেই এর সার্থকতা।

উপন্যাসটির প্রথম অনুবাদ হয় ইংরেজিতে ‘Boatman of the Padma’ নামে, যা হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে সুইডিশ, চেক, হাঙ্গেরীয়, রুশ, রোমানীয়, নরওয়েজীয়, জার্মান ও ওলন্দাজ ভাষায়ও এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। মানিক যেভাবে দারিদ্র্য ও ক্লেশকে এই উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন, তা শরৎচন্দ্র বা বিভূতিভূষণের চেয়ে কোনো অংশে কম করুণ নয়। তবে মানিককে এক্ষেত্রে এগিয়ে রাখতে হয়, কারণ তিনি এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি পথ দেখিয়েছেন – যা তার মতে, একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রই পারে সমাজের বঞ্চনাপীড়িত মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে। হোসেন মিয়ার চরিত্র এবং ময়নাদ্বীপের পরিকল্পনা যেন লেখকের স্বপ্নের ইউটোপিয়া, যেখানে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘The Old Man and the Sea’ উপন্যাসের বৃদ্ধ মাঝির মতোই নতুন দিনের স্বপ্ন দেখা যায়। একটি ভিনদেশী রাজনৈতিক মতাদর্শকে একটি সামাজিক উপন্যাসে এত শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে মানিকের মুন্সিয়ানা তাকে ম্যাক্সিম গোর্কির মতো শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের কাতারে নিয়ে গেছে।

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র হলো পাকিস্তানি চলচ্চিত্র ‘জাগো হুয়া সাভেরা’, যা ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায়। এরপর ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয় গৌতম ঘোষ পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। এই দুটি চলচ্চিত্রই উপন্যাসের জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

লেখকের এই অকৃত্রিম নিষ্ঠা এবং গ্রামের দরিদ্র মানুষের জীবনকে নিশ্বস্তভাবে রূপায়িত করার জন্য কেতুপুর গ্রামে গিয়ে জেলেদের সঙ্গে মিশে তাদের মুখের আঞ্চলিক ভাষাকে সঠিকভাবে তুলে আনার চেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ শুধু একটি উপন্যাস নয়, এটি একটি জীবন, যা পাঠককে গভীরভাবে স্পর্শ করে।

লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

কালজয়ী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি