Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এশিয়া মিডিয়া সামিট ও বাংলাদেশের নাটক নিয়ে কিছু কথা


১ জুলাই ২০১৮ ১৫:৫১

খ ম হারূন ।।

গত মে মাসে দিল্লী গিয়েছিলাম এশিয়া মিডিয়া সামমিট ২০১৮ তে অংশগ্রহনের জন্য। এআইবিডি (এশিয়া-প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট ফর ব্রডকাস্টিং ডেভেলপমেন্ট) এর স্থায়ী সদস্য হবার কারণে প্রতি বছর এই সামিটে অংশগ্রহনের সুযোগ আসে পৃথিবীর (মূলত: এশিয়া) কোনো না কোনো দেশে। এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মিডিয়ার শীর্ষ ব্যক্তিত্বগণ আসেন, মতবিনিময় করেন। ওয়ার্কশপ, সেমিনার এর পাশাপাশি আগামী দিনের টেলিভিশন, বেতারসহ অন্যান্য অনলাইন মিডিয়া কিভাবে বিকশিত হবে তার একটা ধারনা পাওয়া যায়। নতুন প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সহ সামিটে অংশ নেয়া কয়েকজনের সঙ্গে লেখক

দিল্লী যেহেতু আমার কাছে অতি পরিচিত একটি শহরই শুধু নয়, এখানে তিন বছর পড়াশুনা করার পাশাপাশি নানান স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ একটি শহর। এখানে বাস করে আমার অনেক পুরোনো বন্ধু-সহপাঠি, যারা সবাই মিডিয়ার কোনো না কোনো শাখায় কাজ করছেন। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অঙ্গণে তারা অনেকেই সারা ভারতের পরিচিত নাম। সুতরাং যখনই দিল্লী যাই দিল্লীতে কর্মরত বন্ধুরা ছাড়াও মুম্বাই ও অন্যান্য শহরের অনেকেই আমাদের আড্ডায় হাজির থাকার চেষ্টা করেন। সারাদিনব্যাপী আড্ডা, পরিচিত স্মৃতিবিজরিত জায়গাগুলিতে হেঁটে বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া এভাবেই কেটে যায় দিনটি। আমি এশিয়া মিডিয়া সামিটে দিল্লী আসছি জানার পর একটা সুবিধাজনক দিন ঠিক করা হলো আড্ডার জন্য। ৯ মে থেকে ১১ মে সারাদিন সামিটের বিভিন্ন প্রোগ্রামে ব্যস্ত থাকায় আড্ডার দিন ঠিক করা হয় ১২ মে। এই দিন এশিয়া মিডিয়া সামিটের সারাদিনের প্রোগ্রাম ছিলো দিল্লী ভ্রমণ। সুতরাং আমার কাছে ভ্রমনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া।

বিজ্ঞাপন

নির্ধারিত দিনে দিল্লী সংলগ্ন গুরগাঁও থেকে আমার বন্ধু যুবরাজ শর্মা আসে আমার হোটেলে। তার উপর দায়িত্ব ছিলো আমাকে তুলে সে নিয়ে যাবে এনএসডি (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা) ক্যাম্পাসে। যেখানে অন্যরা অপেক্ষা করবে। সকালে রেডি হয়ে লবিতে আসতে আসতে যুবরাজের কল। মোবাইল ধরার আগেই দেখি আমার সামনেই সে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে সেই পরিচিত অট্টাহাসি। ১৯৮৩ সালের কনভোকেশনের পর আর তার সাথে দেখা হয়নি। সারাক্ষন নাটক নিয়েই তার জীবন কাটে। আমাদের দুজনের আবেগ দেখে কাছাকাছি থাকা আমার বিভিন্ন দেশের মিডিয়ার বন্ধুরা এগিয়ে আসে। ছবি তোলে।

দিল্লীর এনএসডি’র ক্যাম্পাস

কতো স্মৃতি ভেসে ভেসে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে আমি বিভিন্ন উপলক্ষে দিল্লী গেলেও যুবরাজের সাথে ১৯৮৩ এর পর আর দেখা হয়নি। মনে পরে ১৯৭৯ সালে এনএসডির শেষ সেমিস্টার আমরা সম্পন্ন করেছিলাম পুনের ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যান্ড টিভি ইনন্সিটিউট। পুনের কোর্স সম্পন্ন করার পর বিভিন্ন জন বিভিন্ন শহরে হয়ে দিল্লী ফেরার পরিকল্পনা করি। আমি ও যুবরাজ যাই চেন্নাই (তখন মাদ্রাজ) হয়ে বেঙ্গালুরু। সেখানে যুবরাজের বান্ধবীর বাড়িতে থাকি কটা দিন। বেঙ্গালুরু ও মহীশুরের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখার পর আমি দিল্লী ফিরে আসি। যুবরাজ ওখান থেকে যায় চন্ডিগর। এই সব স্মৃতিচারণ করতে করতে যুবরাজের গাড়িতে করে যাত্রা করি ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে।

এনএসডিতে কর্মরত আছে আমাদের বন্ধু ববি, যার পুরো নাম অমিতাভ শ্রীবাস্তব, এছাড়াও অধ্যাপনার সাথে আছে ত্রিপুরারি শর্মা ও অশোক সাগর ভগৎ। এইসব অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক ববি। অতএব এই গরমে তার রুমের হিমশীতল পরিবেশে প্রথম আড্ডার স্থান নির্ধারণ করা আছে। প্রফেসর অশোক সাগর ভগৎ এখন দিল্লীতে নেই। ছাত্রভর্তির ইন্টারভিউ নিতে গেছে এলাহবাদ, ওখান থেকে যাবে ভূবনেশ্বর, মুম্বাই। অতএব সে আড্ডায় থাকতে পারবেনা, তাই মুল আড্ডার একদিন আগে হোটেলে এসে সে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে যায় আমার সাথে। অশোক ভগৎ এর বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। তার এক  চাচা ও এক মামা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মাটিতেই শহীদ হয়েছেন। জ্ঞাতি চাচা-মামাদের মধ্যে সতেরো জন একাত্তরে যুদ্ধ করেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের বিপক্ষে। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাও তার জ্ঞাতি চাচাদের একজন। ভগৎ কথায় কথায় বলছিলো, তার পরিবারের প্রায সকল ভাই ও জ্ঞাতি ভাই আর্মিতে জয়েন করে, সেই প্রথম যে আর্মিতে না গিয়ে এনএসডিতে এসেছিলো থিয়েটার নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহনের জন্য। এখন সে ভারতের প্রথম সারির একজন থিয়েটার ব্যক্তিত্ব।

এনএসডি’র সহপাঠীদের সঙ্গে লেখক

এর আগে ডলি আলুওয়ালিয়ার সাথে কথা হলো। আমাদের সহপাঠিদের মধ্যে সে এক উজ্জ্বল তারকা। সেও আড্ডায় থাকতে পারবে না। সেজন্য সে নাকি  দুঃখপ্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বলেই পাঞ্জাবী ভাষায় কি যেনো বলে দিলো অট্টাহাসি। আমার এনএসডির বন্ধুরা হাসির মধ্য দিয়েই তাদের মনের ভাষা প্রকাশ করতে ভালোবাসে। ডলি জানালো সে এখন মুম্বাই আছে ছবির কাজে। অভিনয়ে অত্যন্ত দক্ষতা দেখালেও ডলি এখন মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির একজন কসটিউম ডিজাইনার। হায়দার ছবির জন্য সে বেস্ট কসটিউম ডিজাইনারের এওয়ার্ড পেয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে। কয়েকদিন আগে জানালো এবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে একাডেমি এওয়ার্ডে অংশগ্রহনের জন্য  ভারত থেকে যে ক’জন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তার মধ্যে ডলি একজন। ডলির পরিবারেরও অনেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত। মনে আছে পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে কোর্স করার সময় ডলি একদিন জানালো (১৯৭৯ সালের কথা) তার একজন চাচা এখন পুনে ক্যন্টনমেন্টে কর্মরত আছেন, তিনি আমার সাথে কথা বলবেন। যথাসময়ে তার চাচা মেজর জেনারেল আলুওয়ালিয়া এলেন একটা মোটর সাইকেল চালিয়ে, ডলিকে নিয়ে তার বাসায় যাবেন। একজন মেজর জেনারেল সাথে নিজস্ব একটি মোটর সাইকেল! ইচ্ছে করলেতো তারকা খচিত একটা গাড়ি আনতে পারতেন। কথা বলার সময় তিনি বাংলাদেশের যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা এইসব অঞ্চালের স্মৃতিচারণ করলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব অঞ্চলে এসেছিলেন। আমিও খুলনার এবং একইসাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি জানতে পেরে তিনি খুব খুশি হলেন, আমাকে আলিঙ্গন করলেন।

যুবরাজ আমাকে নিয়ে এনএসডিতে যখন পৌঁছালো তখন বন্ধুদের আনন্দের সীমা নেই। ভাওয়ালপুর রাজবাড়ীর পুরোটা জুড়েই এনএসডি ক্যাম্পস। দু’মাসও হয়নি আন্তর্জাতিক থিয়েটার অলিম্পিক শেষ হয়েছে। ক্যাম্পস তাই বর্ণময় রূপ ধারন করে আছে। ববির রুমে চলে এসেছে ভিকে (যার পুরো নাম ভিনোদ কুমার, কিন্তু এই নামে তাকে কেউ চেনে না), মোনা চাওলা, নুতন সুর্য (সুরাইয়া), সুনীল জৈন। তারপর একেকজনের ফোন আসতে লাগলো। কেউ কেউ আসলো দেরিতে। ভুবনেশ্বর থেকে জয়দীপ, মুম্বাই থেকে গোপী দেশাই, অমরদ্বীপ পিংকি সহ কয়েকজন। এশিয়ান মিডিয়া সামমিটের অনেক বন্ধুরা আমি এনএসডিতে যাচ্ছি শুনে আমার সঙ্গী হতে চেয়েছিলো। কিন্ত আমি যাচ্ছি আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সান্নিধ্যে। তাই অন্যকাউকে সঙ্গে নিতে রাজী হতে পারিনি।

আড্ডার মাঝে স্মরণ করলাম আমাদের সেইসব সহপাঠিদের যারা এখন আর নেই। ক’দিন আগেই মারা গেছে অমিতা উদগাতা। মুম্বাইয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতো। ক’বছর আগে তার স্বামী সুভাষ উদগাতা মারা গেছে। সেও আমাদের সহপাঠি ছিলো। তাদের একটি ছেলে একা হয়ে গেছে। মারা গেছে আমাদের আরেক সহপাঠি জ্ঞান শিবপুরী। সম্পর্কে সে ছিলো অভিনেতা ওম শিবপুরীর ছোটভাই। মারা গেছে নন্দিতা, অনেক বছর আগে, বাচ্চা হবার সময়। এরকম নানা কথার ফাঁকে মোনা চাওলা জানতে চাইলো বাংলাদেশের নাটক সম্পর্কে। বাংলাদেশের থিয়েটার নিয়ে তাদের আগ্রহের শেষ নেই। তারা আন্তর্জাতিক থিয়েটার  অলিম্পিকে প্রতিবছর বাংলাদেশের নাটক দেখে থাকে। যার আয়োজক সংস্থা দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা। আমার বন্ধুরাও এই আয়োজনে জড়িত থাকে। বাংলাদেশের টিভি নাটকের কথা যখন উঠলো তখন আমি জানালাম টিভি নাটকে ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাবের কথা। তারা কিছুটা বিস্মিত হলো। কারণ তারাইতো ভারতীয় ড্রামা সিরিয়াল দেখে না। এতো নিম্নমানের প্রোডাক্ট বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে পৌঁছালো কিভাবে? এ বিষয়ে আর কথা বাড়াতে চাইলাম না। কারণ আমি নিজেও জানি ভারতীয় সিরিয়াল ভারতেই জনপ্রিয় না। পশ্চিমবঙ্গের দর্শকদের পছন্দ বাংলাদেশের নাটক, তবে সেখানে যেহেতু বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা যায়না তাই ভরসা ইউটিউব বা অনলাইন মাধ্যম। আর দিল্লীর আমার বন্ধুদের পছন্দ নাকি পাকিস্তানের টিভি নাটক। সেসব নাটকে নাকি নাটকের গুণগতমান বজায় রাখা হয়, যেটা ভারতীয় টিভি নাটকে রাখা হয়না।

একটা কথা বলে শেষ করি, ভারতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা না গেলেও সেখানে সর্বত্র দেখা যায় পাকিস্তানি চ্যানেল। তারা যেকোনো দেশের ভালোটা গ্রহণ করে আর আমরা মন্দের পেছনে ছুটি।

খ ম হারূন : টেলিভিশন ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব

সারাবাংলা/পিএম

এশিয়া মিডিয়া সামিট খ ম হারূন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা বাংলাদেশের নাটক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর