Monday 11 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তা ও সৃষ্টির ত্রিকালদর্শী প্রভাব

ইমরান ইমন
৬ আগস্ট ২০২৫ ১৬:৩০

‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান’— এই একটি পঙক্তিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন মৃত্যুর ভেতরেও জীবনের জয়গান শুনে ফেলেন। বাংলা ১৩৪৮ সনের ২২শে শ্রাবণ (১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট) কলকাতায় পৈতৃক বাসভবনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস ২২শে শ্রাবণ বাঙালির হৃদয়ে শুধু শোকের দিন নয়, এটি এক অনন্ত অনুধ্যানের দিন— যেখানে মৃত্যু ও জীবনের বিভাজনরেখা মুছে গিয়ে রবীন্দ্র-সৃষ্টির আলোয় আলোকিত হয় একটি সময়োত্তীর্ণ অনুভব। মৃত্যু, যা অধিকাংশের কাছে ভয়ের, অজানার, অন্ধকারের—তা রবীন্দ্রনাথের কাছে এক অস্তিত্বের উন্মোচন, আত্মার মুক্তি, অনন্ত জীবনের দ্বার।

বিজ্ঞাপন

রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে কখনও ‘শেষ’ বলেননি। বরং বারবার তাকে ‘নতুন যাত্রা’, ‘প্রতিষ্ঠার প্রাপ্তি’ রূপে দেখেছেন। তার জীবন ও সাহিত্যের শেষভাগের লেখাসমূহ এক গভীর মৃত্যুবোধের প্রতিফলন, কিন্তু কখনও হাহাকার নয়, বরং আত্মপ্রবঞ্চনাহীন এক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।

গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ‘ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বলেছেন: ‘শেষ বলে কিছু নেই, শেষের এই কথাটাই ভুল।’ এই উপলব্ধি শুধুমাত্র বিশ্বাস নয়, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসকে সাহিত্যে রূপান্তরের শিল্পও। তার কাছে মৃত্যু ছিল জীবনের অনিবার্য পূর্ণতা, চেতনার পূর্ণবিকাশ, সেই উপলব্ধির কেন্দ্রবিন্দু।

মৃত্যু তার কবিতায় এসেছে কখনও প্রেমিকরূপে, কখনও বন্ধুরূপে, কখনও আবার বিশ্বসত্তার এক রহস্যময় আহ্বান হিসেবে। তার আত্মবিনাশে নয়, বরং আত্মস্ফূরণে বিশ্বাস ছিল। তাই তিনি মৃত্যুর কাছেও শ্রদ্ধাবনত হয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি যেন নিজেই মৃত্যুর এক অন্তর্জাগরণ। তিনি বারবার মনে করিয়ে দেন, মৃত্যু জীবনের প্রতিপক্ষ নয়—বরং জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলে মৃত্যুর স্বীকৃতি ও উপলব্ধি। মৃত্যু নিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘মৃত্যু দিয়ে রেখেছি তোমার পূজার সুধাসিক্ত আসন।’ এ এক অভাবনীয় দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে মৃত্যু শুধুমাত্র পরিসমাপ্তি নয়, বরং মহাসত্যের প্রতিভাস।

সৃষ্টির সর্বশেষ পর্যায়েও, যখন তিনি শয্যাশায়ী, তার শরীর ক্ষয়ে যাচ্ছে, বার্ধক্য গ্রাস করছে প্রাণশক্তিকে—তখনো তিনি লিখেছেন, ভেবেছেন, সৃষ্টি করেছেন। ‘শেষ লেখা’, ‘জন্মদিনে’, ‘আত্মনির্বাণ’—এই সব লেখা যেন মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে জীবনের গীত।

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের এক বছর আগে, নিজের জন্মদিনে লিখেছিলেন কালজয়ী কবিতা ‘জন্মদিনে’— যেখানে এক অদ্ভুত আত্মসমর্পণ, অথচ অপূর্ব আভিজাত্যের প্রভাব লক্ষণীয়: ‘আজিকে আমার জীবনেরে দেখি আমি শেষের সম্মুখে—
তাই দেহের কবাট খুলে দাও,
আলোকে আলোকে ভরে যাক হিয়া।’

এখানে কোনো বিলাপ নেই, আছে এক গভীর কৃতজ্ঞতা। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও তিনি আলোকে আহ্বান জানাচ্ছেন—তার চিরন্তন নন্দনের অভিলাষ যেন জীবনের শেষ পর্বেও অপরিবর্তিত থাকে। এই কবিতায় কেবল ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথেরই নয়, বরং মানবজাতির জীবনবোধের এক পরিপক্ব অভিব্যক্তির মিল পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ এমন একজন স্রষ্টা, যিনি কেবল নিজের সময়ের জন্যই লিখেননি, বরং ভবিষ্যতের সময়ের জন্যও লিখে গেছেন। তার সৃষ্টির ভেতর আছে এক ত্রিকালদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এক অভিন্ন চেতনাবিন্দুতে মিলিত। তিনি বলেছিলেন: ‘আমি সেই দিনটি আজ দেখতে পাচ্ছি, যখন মানুষ গোষ্ঠীভেদে নয়, চৈতন্যে মিলবে।’ এই ভবিষ্যৎদর্শন, এই বিশ্বচেতনা, এই মানবতাবাদ আজকের সংকীর্ণ জাতিগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বিভাজনের যুগেও যেন আমাদের মাঝে আশার আলো জাগায়।

তার গান ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’—শুধু একটি গান নয়, এটি একটি যুগচেতনা। এটি আত্মবিশ্বাসের, একক সংগ্রামের, নৈতিক দৃঢ়তার গান। আমার কাঁধে যখন হতাশা ভর করে তখন আমি এ গানটি শুনি আর নবোদ্যমে জেগে ওঠি। এমন শত শত রচনার মাঝে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর পরে হয়ে ওঠেন আরও জীবন্ত, আরও প্রাসঙ্গিক।

১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তিনি কি কখনও চলে গেছেন? এ প্রশ্ন প্রতিবার ২২ শ্রাবণে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। তিনি নিজেই যেন উত্তর দিয়ে গেছেন:

‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই—
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিখিয়েছেন মৃত্যুকে ভয় নয়, বরং সাদরে বরণ করে নিতে হবে। মৃত্যুর গভীরতম অন্ধকারেও এক ধরণের আলোর সন্ধান রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার চিন্তা, তার কবিতা, তার গান, তার দর্শন আজও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে মানুষের আত্মায় ও চিন্তায়। তিনি মৃত্যুর আগে যা বলে গেছেন, তা আজও আমাদের জীবনপথের দিশারী: ‘মরিতে জানি আমি, তাই মরণকে ভয় করি না।’ এই আত্মবিশ্বাস, এই দৃষ্টিভঙ্গি—আজকের বিশ্বের, বিশেষত মানবিক সংকটে জর্জরিত সময়ের জন্য এক পরম পাঠ।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু আমাদের চোখের সামনে ঘটে গেলেও, তার সৃষ্টিশীল উপস্থিতি আজও অনুভব করি প্রতিটি মানবিক আলোচনায়, প্রতিটি হৃদয়ের অন্বেষণে। মৃত্যুকে অতিক্রম করে তিনি হয়ে ওঠেছেন সময় ও চেতনার বিশ্বপথিক। ২২ শ্রাবণ তাই কেবল তার মৃত্যুদিন নয়—বরং এক আত্মজাগরণ, এক স্মরণ, এক শপথ— জীবনকে তার মতো করে গভীরভাবে ভালোবাসার, উপলব্ধির, আর সৃষ্টির অনুশীলন করার।

প্রয়াণ দিবসে রবীন্দ্রনাথকে তার ‘১৪০০ সাল’ কবিতার কিছু পঙক্তি দিয়ে স্মরণ করা যাক:

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি
আমার কবিতাখানি—কৌতূহল ভরে হাসি
পুরাতন ভাষা মম টেনে আনিছো পাছে পাছে
নবজীবনের ছোঁয়ায় ক’রে নবসাজে।’

রবীন্দ্রনাথ জানতেন—তার কবিতা, তার দর্শন, তার সৃষ্টি, তার চিন্তা—শত বছর পরেও কেউ না কেউ আবার পড়বে, ভাববে, ভালোবাসবে। আজ, আমরা সেই কেউ না কেউ।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস আজ। প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

২২শে শ্রাবণ ইমরান ইমন প্রবন্ধ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তা