Sunday 17 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কবি শামসুর রাহমান: যিনি কবিতায় লিখেছেন বাংলাদেশের ইতিহাস

ইমরান ইমন
১৭ আগস্ট ২০২৫ ১৮:১৬

বাংলা সাহিত্যে ‘নাগরিক কবি’ হিসেবে খ্যাত কবি শামসুর রাহমানের ১৯তম প্রয়াণ দিবস আজ। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন খ্যাতিমান এই কবি।

শামসুর রাহমানের বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। ১৩ ভাইবোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। পুরান ঢাকার পোগোজ ইংলিশ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। পাসকোর্সে বিএ পাস করে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয়স্থান অর্জন করলেও শেষপর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি।

বিজ্ঞাপন

শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রূপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, তখন তাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন ‘টেলেমেকাস’ (১৯৬৬ সালে) কবিতাটি। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসংগীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরও স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন।

১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন— যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও।

কবি তখন ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি।

শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশের পরপরই তিনি সচেতন পাঠকমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর থেকে হয়ে ওঠেন ‘কবিতার বরপুত্র’। তার ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান যেন সচিত্র রূপ পায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই শামসুর রাহমানের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক কবিতার সঙ্গে তার পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৯ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তার লেখা ‘বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট ’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’— এসব কবিতা তাকে বাংলা সাহিত্যে বিশেষস্থানে আসীন করে। তার ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ একটি অনন্য কবিতা। যেটি উচ্চমাধ্যমিক সাহিত্যপাঠ বইয়ে সিলেবাসভুক্ত রয়েছে। এ কবিতার নামকরণ ও পট বিশ্লেষণে কবির বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার মাত্রা ফুটে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বেদনামথিত হয়ে তিনি লেখেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’সহ বেশকিছু কবিতা। স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর-পরবর্তী পট পরিবর্তনে আশাহত কবি সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে তার কলম চালিয়েছেন নিরন্তর। সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনুকরণীয়।

বাংলাদেশের কবিদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে যেটি লক্ষ্য করা যায়, তারা পোশাক-আশাকে, চলাফেরায় আউলা-ঝাউলা, অপরিপাটি বা আনস্মার্ট থাকেন‌। কিন্তু শামসুর রহমান সেদিক থেকে ছিলেন পুরোপুরি ভিন্ন। তিনি সবসময়ই স্মার্ট থাকতেন— পোশাকআশাক, চলাফেরায়, কথাবার্তায়— সবদিক থেকেই। অনেকটা তার কবিতার রুপকদের মতোই। তার জীবনাচরণে পশ্চিমা সাহিত্যবোধ ও পশ্চিমা লেখকদের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে— সেটা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়াতেই তিনি সহজভাবে রপ্ত করতে পেরেছেন বলে মনে করি।

শামসুর রাহমানের ষাটের অধিক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও শিশুতোষ, অনুবাদ, ছোটগল্প, উপন্যাস, আত্মস্মৃতি, প্রবন্ধ-নিবন্ধের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৬৪ সালে নভেম্বর থেকে শুরু করে সরকারি দৈনিক পাকিস্তানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭-তে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ সময় তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘অধুনা’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব উত্থান-পতনে রাজধানী ঢাকা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সে নগরীর নাগরিক হিসেবে কবি শামসুর রাহমানকে এসব ঘটনা বেশ প্রভাবিত করেছে। তিনি তার ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’ কাব্যগ্রন্থের ‘পারিপার্শ্বিকতার আড়ালে’ কবিতায় নিজেকে বর্ণনা করেছেন এভাবে: “শামসুর রাহমান নামে আছে একজন, নিজের কাছেই/ বন্দি সর্বক্ষণ।/ প্রতিদিন শহরের সবচেয়ে করুণ গলির মুখচ্ছবি/ মুখের রেখায় নিয়ে হাঁটে ফুটপাতে/ সুনিবিড় রিশ্তা তার রহস্য নামক অতিশয়/ লতাগুল্মময় প্রান্তরের সাথে কেমন অচিন/ দৃশ্যাবলি সমেত বিপুল/ অদৃশ্যের সাথে… একজন পরী হ্যালো হ্যালো বলে, ডায়াল করছে অবিরাম/ মধ্যরাতে ঢাকা বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হয়ে যায়।”

শামসুর রাহমান বাংলা কবিতাকে রিডিংরুম আর ড্রয়িংরুম থেকে বের করে নিয়ে গেছেন আমজনতার দরোজায়, পরিণত করেছেন অধিকার আদায়ের লিফলেট হিসেবে। বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে শামসুর রাহমান কবিতা লিখেছেন। সে দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে ‘জাতীয়তাবাদী চেতনার কবি’ হিসেবে অভিহিত করা যায়।

সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে—আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, জীবনানন্দ পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার, মিতসুবিসি পুরস্কার (সাংবাদিতার জন্য), স্বাধীনতা পদক, আনন্দ পুরস্কার।

১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্ম নেওয়া এবং ৭৭ বছর পৃথিবীতে বেঁচে থাকা এই কবিকে তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকার বনানী কবরস্থানে, মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। বরেণ্য এই কবির প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এএসজি

ইমরান ইমন কবি শামসুর রাহমান প্রবন্ধ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর