আজ দিনটা অন্যরকম
৫ জুলাই ২০১৮ ১৬:৫৭
কিযী তাহনিন ।।
কিছু একটা প্রয়োজন। আচমকা, হঠাৎ, হুট করে ঘটে যাওয়া, ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ ধরণের কিছু। সময়টা খুব ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে, পানসে। আলুবিহীন কাচ্চি বিরিয়ানির মতন। সব ঠিকঠাক, কিন্তু কি যেন নেই।
আমি থাকি পাঁচ তলায়। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে, প্রতিদিন সকালে যখন কাজের উদেশ্যে রওনা দেই, সেই পথে চোখে পরে এক রাধাচূড়া গাছ। কতদিন ধরে চোখে পরে তা আর মনে নেই। যা দেখি, যা আমার প্রতিদিনের জীবনে, তাকে তো আলাদা করে মনে করা হয়না। করতে হয়না। তাই পানসে সময়ের অংশ হয়ে রাধাচূড়া গাছখানাও বহাল কাঠামোতে ঠিকঠাক। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আলাদা করে মনে করা হয়না। বাড়ি থেকে গুনে গুনে দশ-বারো পা ফেললেই যে তিনমাথার মোড়টা, তার কোণে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি।
গাছটির নিচে একপা ভাঙা কালচে কাঠের ক্ষয়ে যাওয়া যে বেঞ্চি, সেটাও যে কবে থেকে আছে, আমার মনে নেই। গাছের নিচে, এক কোণে নিজের মতন করে। পা-ভাঙা বেঞ্চিকে আলাদা করে মনে রাখবার কিছু নেই। আমি মনে রাখিও না। তবে বেঞ্চিটাকে চোখে পরে যায়, সেই বেঞ্চিতে বসে থাকা মানুষটির জন্য। পাড়ার পশ্চিম কোণের বস্তিতে তার ঘর। সূর্য উঠলে সেও ওঠে। চলে আসে গাছের নিচে। এই বেঞ্চি যেন তার রাজত্ব। আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকে সারাদিন। গাছের পাতার মতন দুলে দুলে উঠে মাঝে মাঝে। বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়া দিয়ে যায়। সেখানে বসেই খায়। ভাতঘুম দেয়। দুপুরে এক ফাঁকে তার মা জোর করে একবার বাড়ি নিয়ে যায়। গোসল, বাথরুম প্রয়োজনীয় কাজ সারে তখন। আবার ফেরে বেঞ্চিতে। যতক্ষণ দিনের আলো ক্লান্ত না হয়। সে থাকে, গাছটিকে ঘিরে, বেঞ্চিতে আসনপিঁড়ি হয়ে। রাজত্ব যেন তার।
তার নাম টুকু। টুকু পাগলা। কিংবা পাগলা। অথবা পাগল। সবাই চেনে তাকে, এই নামে। সে পাগল। সেও তা জানে।
তাই পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা যখন তার পাশে ঘুরঘুর করে, আর খেলা করে, কেউ একজন প্রশ্ন করে প্রতিদিন, ‘বলতো তোর নাম কি?’
‘টুকু পাগল’। পোকা খাওয়া দাঁত বের করে হেসে হাত-পা নেড়ে নেড়ে উত্তর দেয় সে।
‘আচ্ছা এবার বলতো আমার নাম কি?’ পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা খেলতে থাকে।
তোদের নাম পা লম্বা। আমার পা গোল, তোদের পা লম্বা। টুকু পাগলেও সে খেলায় যোগ দেয়।
হেসে হেসে গড়িয়ে পরে, প্রশ্নকর্তার দল। টুকু পাগলাও।
আমার ও মাঝে মাঝে টুকু পাগলার সাথে এমন খেলা খেলতে ইচ্ছা করে। লোকে কি ভাববে, ইমেজ- এ ধরণের কাঁটাতারের খোঁচায় এমন খেলা হয়না।
তবে আমি কাজে যাওয়ার সময় যখন, মোড় পর্যন্ত হাঁটি, রিক্সার খোঁজে, টুকু পাগলাকে একবার প্রশ্ন করি, অভ্যেসে,আছো কেমন?
ভালো গো ভালো, তুমিও কি ভালো? টুকু পাগলাও আমাকে প্রতিদিন পাল্টা প্রশ্ন করে।
কবে থেকে আমি প্রশ্ন করি, সে উত্তর দেয়, সে প্রশ্ন করে, আমি উত্তর দেই, মনে নেই। তবে ওই যে চলছে চলুক পানসে সময়ের মতন এই ঘটনাও ঘটে চলছে।
আমি আছি ভালো। আমি উত্তর দেই।
তুমি ভালো, আমি ভালো। তবে খারাপ কে? খারাপটা কে? টুকু পাগলা পাল্টা প্রশ্ন করে।
এ প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাইনি। জানিনা। তাই কখনো উত্তর দেইনা। এক গাল হেসে সামনে আগাই। যেখানে রিক্সার জটলা। প্রতিদিন এমন হয়। প্রায় প্রতিদিন।
আজ কেন শুরু থেকে সব অন্যরকম লাগছে জানিনা। আজ টুকু পাগলা ঠিক বেঞ্চিতে বসে নেই। বেঞ্চির ভাঙা পা, যা একটি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আটকানো, তাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে আছে।
আজ আমার ও কাজে যেতে মন চাচ্ছেনা। অভ্যাসও আজ বেহিসাবি। প্রতিদিনের প্রশ্ন উত্তর খেলা খেলতে ইচ্ছা করছেনা। তবুও অভ্যাসকে অবজ্ঞা করা ঠিক না ভেবে, প্রশ্ন করলাম,
আছো কেমন টুকু পাগলা?
নাই, নাই, আজ নাই, আজ সব খারাপ।
বলেছিলাম না, আজ সব অন্যরকম। টুকু পাগলা নইলে এমন উত্তর দেয়? অভ্যাসকে আজ ছুটি দিতেই হচ্ছে। আমি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। টুকু পাগলার মুখ বরাবর।
প্রশ্ন করি, কেন, হলো কি?
কি যেন একটা নাই বুঝলা, কি যে নাই বুঝতেসিনা। কেমন কেমন লাগে।
হু, আমার ও।
গাছের পাতা নড়েনা। ফুলও মাটিতে পড়েনা। কিছুই তো আগের মতো হচ্ছেনা গো। টুকু পাগলা বলে।
“হু আমারও। এক ফোটা লিখতে পারছিনা। কত কি লিখতে ইচ্ছা করছে। কত গল্প মাথায় গিজগিজ করে। লিখতে গেলে সব থেমে যাচ্ছে।
সব থেমে আছে বুঝলা সব থেমে আছে।
টুকু পাগলা বোধহয় আজকে সত্যি ভালো নেই। হাসি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। বিড়বিড় করছে শুধু। আর পা দাপাচ্ছে মাটিতে। যেন মাটিতে আঘাত করলে সব ঠিক হয়ে যাবে, আগের মতন, প্রতিদিনের মতন।
বিড়বিড় তো বোধহয় আমিও করছি। একা একা বলে যাচ্ছি, আমাকে রাইটার’স ব্লকে ধরেছে বুঝলা। কিচ্ছু লিখতে পারছিনা। কিছুনা। লেখারা হারিয়ে যাচ্ছে।
টুকু পাগলা উত্তরে বলে, পাতা নড়েনা, পাতা পড়েনা। যাও যাও, এখন যাও।
আমি ও এগোতে থাকি। সামনে। যেখানে রিক্সার জটলা থাকবার কথা।
আজ দিনটি তো অন্যরকম। অফিস গিয়ে তাই, ইমেইল খুলে জানলাম, বিদেশী যে স্কলারশিপ এর আশায় এতদিন ছিলাম, তা পাইনি। মেজো খালা দো’তলার সিঁড়ি থেকে পরে পা ভেঙে ফেলেছে। হসপিটালে আছে। যে ইউএসবি ড্রাইভে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাইল আছে, সেটা খুঁজে পেলাম না। সারাদিন তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। বাসা থেকে দুপুরের যে খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম, সবজি খিঁচুড়ি, তা পচে গন্ধ। কাজের চাপে না খেয়ে দিন পার। গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা বুকের এপাশ ওপাশ চিনচিন করে লাফাচ্ছে। ফেরার পথে দেখি, গাছের নিচে মাটিতে টুকু পাগলা শুয়ে আছে। আমার দিকে তাকালোনা। বুঝলাম কথা বলতে চায়না। বুঝলাম আজ দিনটা অন্যরকম।
আজ দিনটি অন্যদিনের মতন নয়। আজ দিনটি আজকের মতন, অন্যরকম। তাই এই সন্ধ্যে-রাতের মাঝখানের অসময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীর, তারচেয়েও ক্লান্ত মন। সময় স্থির। এ জড়তা কাটানোর একটিই উপায়, ঘুমের মধ্যে পালিয়ে যাওয়া। পালালাম।
ঘুম ভাঙলো খানিকটা অস্বস্তিতে। সে অস্বস্তি খারাপ লাগছেনা। অস্বস্তি আসলে এক স্বস্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। জড়তা কাটছে। খুব চেনা গন্ধ। আমার চোখে আর ঘুম নেই। আমি উঠি। পরিচিত গন্ধ আবারও। জড়তা ভাঙার শব্দগুলোও খুব পরিচিত। শব্দ ঠিক নয়। ছন্দ কেমন যেন। টুপটাপ, টুপটাপ।
টুকু পাগলার গলার আওয়াজ পাই। আজ সে এখনো বাড়ি যায়নি। জড়তা কেটে যাবার উৎসব উদযাপন করছে আজ সে। মেঘের গর্জনের ফাঁকে ফাঁকে, টুকরো শব্দেরা ভেসে ভেসে আসে। শুনি, সে বলছে, পাতা নড়ে, পাতা পড়ে গো…. দেখো, দেখো।
আর শুনি, প্রতি বাড়ির চিরাচরিত বৃষ্টি-মুহূর্তের সংলাপ, এই বারান্দায় সব শুকনো কাপড়, নিয়ে আয়, নিয়ে আয়। সব ভিজে যাবে।
গত ক’দিন এলাকায় পানির সংকট। টুকু পাগলার বস্তিতেও। আমি জানি, আজ সে খুব ভিজবে, শুকনো কাপড়, শুকনো মন, সব ভিজবে আজ।
আমি কমলা রঙের খাতা খুলে বসি। কতদিন ধরে টুকু পাগলার মতন একা একা অপেক্ষা করা কিছু শব্দ, সাদা পাতায় আটকে আছে। অপেক্ষা করছে।
‘শৈবাল রঙা জানালা।…’
আজ দিনটি অন্যরকম। আজ অন্যদিনের মতন প্রতিদিন নয়। আজ পাতা পড়বার দিন। আজ পাতা নড়বার দিন। আসে পাশে জানালার কপাট লাগানোর শব্দ। আর যারা জানালা খুলে রেখেছে আজ, তারা জানে, জানালার ওপারে আছে গল্প। আছে চরিত্রেরা। আসলে প্রতিটি জানালা যেন বইয়ের মলাট। কপাট খুলে দিলে গল্পে মেলে, জানালার ওপাশে।
আজ আমি শৈবাল রঙা জানালা’কে সঙ্গে নিয়ে খেলতে বসি। শব্দের খেলা। বহুদিনের গুমোট বাধা শব্দঘরে আজ বৃষ্টি। আমি তাই লিখি, লিখে যাই…
‘জানালার ওপাশে বৃষ্টি তুমুল
তেমন বৃষ্টি, যেমন বৃষ্টিতে
প্রশ্ন আর বিস্ময়ে কোনো চিহ্ন থাকেনা।’
সারাবাংলা/পিএম