বাংলা প্রতিবাদী কাব্যধারায় এক অনিবার্য নাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উত্তাল কালপর্বে আবির্ভূত এই কবি তার কাব্যযাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য।
‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’—এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি ততোধিক স্পর্ধায় তিনি উচ্চারণ করেছেন—‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তার অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক’-এ। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা।
বাংলা সাহিত্যের দ্রোহ ও প্রেমের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ৬৯তম জন্মদিন আজ। ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর তার পিতার কর্মস্থল বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার মূল বাড়ি বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে।
কবি রুদ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এম.এ. পাস করেন। ঢাকা ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে এস.এস.সি. এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচ.এস.সি. পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৮০ সালে সম্মানসহ বিএ এবং ১৯৮৩ সালে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র থাকা অবস্থায় সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অবৈধ সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের পরের সবকটি সরকারবিরোধী ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত। তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক এই কবি ৩৫ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং ‘ভালো আছি ভালো থেকো’সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন।
কাব্যগ্রন্থসমূহ _
উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯)
ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮২)
মানুষের মানচিত্র (১৯৮৪)
ছোবল (১৯৮৬)
দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮)
মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)
তিনি ১৯৮০ সালে শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার এবং ২০২৫ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন।
নিজেকে ‘শব্দশ্রমিক’ হিসেবে ঘোষণা করা এই কবি কবিতার ক্ষেত্রে ছিলেন নিবিড় নিরীক্ষাপ্রিয়। ব্যক্তিজীবনে বাউন্ডুলে স্বভাবের হলেও কবিতার প্রতি তার ছিল গভীর নিষ্ঠা। তার মনন ছিল সর্বভুক, চিন্তা নৈর্ব্যক্তিক ও কর্ম ছিল পরিমাপহীন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধির দেশ হিসেবে দেখতে। শুধু কবিতা লিখতেন না, কবিদের সংঘবদ্ধ হতেও আগ্রহী করতেন।
ব্যক্তিজীবনে বন্ধু ছিল অসংখ্য। অনেক ভালোবেসে ১৯৮১ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি বিয়ে করেন তসলিমা নাসরিন-কে, তখনও তিনি সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পাননি। ১৯৮৮ সালে তাদের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে। পরে সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেটিও স্থায়ী হয়নি। জীবনের শেষদিকে তিনি আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। শুরু হয় প্রচুর ধূমপান ও মদ্যপান, খাবারে অনিয়ম—সব মিলিয়ে পাকস্থলীতে আলসার ও পায়ে বার্জার্স ডিজিজে আক্রান্ত হন।
শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে কবিতা পাঠে অংশ নিতেন। অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। সেখান থেকে ২০ জুন বাসায় ফেরেন। ২১ জুন ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।
জন্মদিনে এই মহান কবির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ওপারে ভালো থাকুন প্রিয় কবি।
লেখক: লেখক ও গবেষক