Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মাহমুদুল হকের পাঠশালায়


২১ জুলাই ২০১৮ ১৬:১৭

মোজাফফর হোসেন ।।

আজ ২১শে জুলাই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের প্রয়াণদিবস। ২০০৮ সালের এদিন তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। উপন্যাস ‘জীবন আমার বোন’ এবং ‘কালো বরফ’ তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি। অসাধারণ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাসের পাশাপাশি মাহমুদুল হকের একমাত্র শিশুসাহিত্য হলো অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস ‘চিক্কোর কাবুক’। সাহিত্য প্রকাশ থেকে ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যে প্রায় সকল সিরিয়াস লেখকই কম-বেশি শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। মাহমুদুল হক গদ্যভাষা ও বিষয়বস্তুতে সম্পূর্ণভাবেই বড়দের লেখক। তার প্রমাণ মেলে তাঁর ‘কালো বরফ’ ও ‘অনুর পাঠশালা’ উপন্যাসে—সেখানে শিশুচরিত্র থাকলেও উপন্যাস হিসেবে তা শিশুতোষ নয়। শিশুরা যাতে মাহমুদুল হকের সাহিত্যকর্ম থেকে একেবারে বঞ্চিত না হয় এজন্য বোধহয় তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য একেবারে আলাদা করে রচনা করেছেন ‘চিক্কোর কাবুক’ উপন্যাসটি।

বিজ্ঞাপন

উপন্যাসটির শেষ কয়েকপৃষ্ঠা বাদ দিলে প্রধান চরিত্র মাত্র দুটি: মামা আর ভাগ্নে। শেষের দিকে ভাগ্নে টুপু অপহৃত হলে গল্পের নাম-নায়ক চিক্কোরের সঙ্গে পাঠকদের সাক্ষাত ঘটে; তার আগপর্যন্ত টুপুই কেন্দ্রীয় চরিত্র। টুপু সংসারের সাধারণ প্রাণী নয়। টুপুকে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য উপন্যাসের প্রারম্ভিক প্যারাটিই যথেষ্ট: ‘টুকু ছেলেটি একটু ভিন্ন ধাতের; আর ছিটেফোঁটা ভিন্নধাতের হলেই সচরাচর সকলের ভাগ্যে যা ঘটে থাকে, ওর বেলাতেও তার হেরফের হয়নি। বাড়ির লোকজন তো বটেই, বন্ধুরাও খামোখা ওর পেছনে লেগে থাকে।’

টুপুর সম্পর্কে মামার ধারণা: ‘টুপু হাপ্পাগলা, বিলক্ষণ মাথায় ছিট আছে।’ টুপুর সঙ্গে মামার অতি সখ্য থাকার কারণে মামাকেও সকলে টিটকিরি মেরে বলে, ‘পাগলে পাগল চেনে’।

বিজ্ঞাপন

উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ের একটি করে শিরোনাম আছে। এবং সবগুলো অধ্যায়ের কথক হল গল্পের মামা। মামাদের মুখে শিশুরা গল্প শুনতে ভালোবাসে, আর মামা একটু মজার হলে তো কথায় নেই! এজন্যই হয়ত মাহমুদুল হক কৌশলে একজন মজার মামাকে গল্প বলিয়ের ভূমিকায় দাড় করিয়ে দিয়েছেন। গল্পে তার ভূমিকা এই পর্যন্তই। তবে গল্পবলিয়ের ভূমিকা যে কত শক্ত সেটি যারা জানেন তারা গল্পের মামাকে মোটেও খাটো করে দেখতে পারবে না। মামার সেন্স অব হিউমরের কারণে উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কখনো ক্লান্তি আসে না। শব্দে শব্দে একটা ফুরফুরে আমেজ লেগেই থাকে। জঙ্গলে বিষাক্ত সাপ তেড়ে আসতে দেখেও মামা যখন আতঙ্কগ্রস্ত টুপুকে বলে, ‘আমরা হচ্ছি বনজঙ্গলের হঠাৎ-কুটুম, একটু খোঁজখবর তো নেবেই।’ তখন আর না হেসে পারা যায় না। এমনি করে মামা গল্পকথকের ভূমিকায় থেকে উত্তেজনাটা লাগাম দিয়ে টেনে রাখেন।

উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়ের নাম, ‘শব্দের রঙ’। শব্দের আবার রঙ থাকে নাকি? রঙ তো থাকে দেখিয়ে জিনিসের। অদেখা জিনিসের রঙ থাকতে বিজ্ঞানের মানা। থাকলেও দেখে কার সাধ্য! তবে টুপু যেহেতু কথিত হাপ্পাগলা, ওর দেখতে সমস্যা নেই! টুপু দিব্যি শব্দের রঙ দেখতে পায়। মামা যখন ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারণ করে এর রঙ জানতে চায়, টুপু একটু ভেবে জানায়, ‘সবুজ’। মামা যখন দুবার বাংলাদেশ শব্দ উচ্চারণ করে, তখন টুপু বিজ্ঞের মতো মামাকে বলে, ‘বাংলাদেশ সবুজ। আর যদি একসঙ্গে পরপর দুবার উচ্চারণ করো তবে তার রঙ লাল।’ এভাবে আপন স্বভাবের মামাকে হাতের কাছে পেয়ে টুপু শব্দের রঙ নিয়ে রীতিমতো গবেষণায় মেতে ওঠে। সে এক আজব গবেষণা বটে!

এর পরের অধ্যায়ে প্রকৃতির পাঠশালায় জ্ঞানার্জনের জন্য বেরিয়ে পড়ে মামা-ভাগ্নে। এ যেনতেন প্রকৃতি নয়, খাগড়াছড়ির জনমানবশূন্য ভয়াল জঙ্গল। তারা সঙ্গে নিলো কম্বল, পলিথিনের চাদর, শিকারের ছুরি, দেশলাই, দূরবীন, টর্চসহ টুকিটাকি আরো অনেককিছু। নিরাপত্তার জন্য গুলতি আর বুমেরাং। আর ইস্কুলের ছেলেদের মতো পানির বোতলও ঝুলিয়ে নিয়েছে কাঁধে। এর কারণ হিসেবে মামা স্বভাবসুলভ মজা করে বলে, ‘প্রকৃতির পাঠশালায় পড়তে যাচ্ছি যে!’ পাহাড়ঘেরা গহীন অরণ্যভূমির চড়াই-উৎরাই ভেঙে ক্রমাগত এগিয়ে যায় দুজনে। সেই গা ছমছমে শিক্ষাসফরের বর্ণনা একটু না দিলেই না। মামার ভাষ্যে: ‘কখনো ধস নামা পাহাড়ের গা বেয়ে কখনো সরু ফিতের মতো এক একটি রাস্তা ধরে একটানা হেঁটে চলেছি। ভাঙা দুর্গের মতো এলোপাথাড়ি পাহাড়, নীরব অন্ধকার ঘেরা গভীর খাদ, সবকিছুই ঘন অরণ্য মোড়া। প্রকৃতি কতো রকমের খেয়ালই যে গোপনে গোপনে চারপাশে ছড়িয়ে রেখেছে, কার সাধ্যি তা বোঝে। দিনভর একধরনের গা ছমছমে নিস্তব্ধতা বাঁশবনের মাথায় আর পাহাড়ের অনড় দেয়ালে অবিরাম ঘূর্ণিস্রোতের মতো পাক খায়।’

এমন পিলে-চমকানো জঙ্গলের ভেতর দুজন শহুরে মানুষের মেহমানদারি যেমন হওয়ার তেমনই হয়েছে। একদিক থেকে এগিয়ে আসে বুনো ভাল্লুক, অন্যদিক থেকে বিষাক্ত সাপ। আর জঙ্গলের প্যাচপুচ তো আছেই। ভীষণ শীতরাতে গাছের ডালে পালা করে ঘুমানো, যেনতেন অ্যাডভেঞ্চার নয় এটি। আমাদের সময়ের শিশুরা জিওগ্রাফি চ্যানেলে বিয়ার গ্রিলসের জঙ্গলে নানান ধরনের অ্যাডভেঞ্চার দেখে শিহরিত হয়। আশির দশকে সে সুযোগ ছিল না। বইটি পড়লে তার দরকারও পড়ে না। পড়তে পড়তে দিব্যি মামাভাগ্নের অ্যাডভেঞ্চার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

শুরুতে মামা-ভাগ্নের সফর বুদ্ধিবৃত্তিক আনন্দসফর মনে হলেও ক্রমেই সেই সফর প্রকৃত দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় পরিণত হয়। হঠাৎ করেই জঙ্গলে গায়েব হয়ে যায় টুপু। মামার বুঝতে বাকি থাকে না, মারমাদের ত্রাস-জঙ্গলদস্যু স্টানলির কব্জায় পড়েছে টুপু। জঙ্গলে তাদের কদিন থেকেই অনুসরণ করা হচ্ছিল ওদের, টুপু সেটা মামাকে কয়েকবার জানিয়েছে। মামা তখন গা করেনি। যে পথ ধরে টুপুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই পথে চিহ্নস্বরূপ টুপু পকেটে সংগ্রহ করা টিয়াপাখির পালক একটি নির্দিষ্ট ব্যবধানে ছড়াতে ছড়াতে গেছে। মামা চিহ্ন ধরে ধরে এগুতে থাকে। শুরু হয় মামার গোয়েন্দা অভিযান। মামা পৌঁছে যায় স্টানলির আঁকড়ায়। সেখানেই মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে গল্পের নাম-নায়ক চিক্কো ও তার সঙ্গী কুশলের। চিক্কো-কুশলকেও স্টানলির লোকজন টুপুর মতো তুলে এনেছে। মামা ও কুশলকে নিয়ে চিক্কো ফন্দি আঁটে টুপুকে ছাড়ানোর। চিক্কো আর কুশলও মুক্তিপাওয়ার জন্য মরিয়াপ্রায়। আসল অ্যাডভেঞ্চারের শুরু এখানেই। বন্দুকসহ ‘গাব্দাগোব্দা’ প্রকৃতির লোকজনের সঙ্গে যুদ্ধে নামে কিশোর চিক্কো ও কুশর। মামাকেও এ যুদ্ধে সামিল করাই তারা। বাহুশক্তি নয়, বুদ্ধিশক্তি দিয়ে স্টানলির ডান হাত ল্যাংসহ আরো দুজন প্রহরীকে কব্জা করে ফেলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মামা নিজেও বন্দুক তুলে নেই। সমস্ত ঘটনাটা ঘটে চিক্কোর পরিকল্পনা-মাফিক। মামা শুধু শিশুর মতো বলিহার চিক্কোর কর্মকাণ্ড দেখে আর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। মামাকে যা করতে হয় তাতে সে নিজেও তাজ্জব বনে যায়। এতবড় একটা দুঃসাহসিক অভিযানে তাকে শুধু বসে বসে গাছের পাতা নড়াতে হয়। মামার ভাষায়: ‘একটা ধাড়ি-গোছের খোকা হাতে গুচ্ছের দড়িদড়া ধরে গর্তের ভেতর কোলকুঁজো হয়ে বসে আছে। কি তার কাজ? কাজ হলো ভয়ঙ্করের মুখে বসে কেবল লেজ নাড়া। লেজ নাড়া নয়তো কি! আস্তে আস্তে—খুব যত্ন করে বলতে গেলে বলতে হয়, মৃদু মৃদু, দড়ির গোড়া ধরে নাড়ছি, ডিউটির মতো ডিউটি একটা!’

শেষ পর্যন্ত ডালনাড়া দেওয়াটা যেন ঠিকমতো করা যায়, এই নিয়েই মামার যত চিন্তা তখন। ওদিকে কাজ যা করার সব করে চিক্কো আর তার সঙ্গী কুশর। শেষপর্যন্ত টুপুকে মুক্ত করে তারা, নিজেরাও মুক্তি পায় জমের বন্দিশালা থেকে। এমন সব সিরিয়াস ঘটনার ভেতর দিয়ে শেষ হয় মামা-ভাগ্নের সখের জঙ্গলযাত্রা।

গল্পের দুই অংশের দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র, টুপু ও চিক্কো, স্বভাবে যেমন সাবধানী তেমন বুদ্ধিমান। দুজনের বুদ্ধিমতো চলে মামা। একদিকে, টুপুর অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা আর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড; অন্যদিকে, চিক্কোর দুঃসাহসিক গোয়েন্দাগিরি। এসব দেখে শিশুদের শিহরিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। টুপু আর চিক্কোর গুণের প্রশংসা করে মামা বলেছে, ‘পালকের নিশানা ধরে এগোতে থাকি।…তবুও ভালো বিপদের মুখে টুপু একেবারে হাল ছেড়ে না দিয়ে কিছুটা বুদ্ধি খরচ করেছে।’ এবং ‘চিক্কোর চোখেমুখে আমি যে উত্তেজনার চিহ্ন দেখেছি, তাতে আর যা কিছুর অভাব থাকুক দৃঢ়তার কোনো ঘাটতি ছিল না।

শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্য করে এই রচনা হলেও মাহমুদুল হকের স্বভাবজাত ইঙ্গিতময় ভাষা এটিকে বড়দের জন্যও সুখপাঠ্য করে তুলেছে। জঙ্গলের সৌন্দর্যে মামা তার কবিভাবের বর্ণনা তুলে ধরে এইভাবে: ‘ভাবের মতো ভাব এক একটা, কোনটা হাতির মতো শুঁড়অলা, কোনটা বা চিতাবাঘের মতো গায়ে টিকে তোলা।…এক একটা ভাব চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে মগজের ভেন্টিলেটরে আসছিল আর খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধছিল। কয়েকটা ভাব পালকের মতো হালকা, কিন্তু শিশির-বিন্দুর মতো স্বচ্ছ।’ একইভাবে টিয়া দেখে টুপু বলে: ‘রঙের এমন শোভা আগে আর কখনো দেখি নি মামা। ওদের গায়ের রঙ আবছা খয়েরি, মাঝে মাঝে শাদা বুটি, বাতাসের ভেতর যেন হাজার হাজার হরিণ খেলছে!’

এমন সব উপমার এখানেই শেষ নয়। টুপুর টানা নিঃশ্বাস সম্পর্কে মামা বলে: ‘ওর নিশ্বাস যেন নবাবপুরের লম্বা রাস্তা, যার দু’পাশে সারি সারি ঝাঁপখোলা দোকান, নানান ধরনের পণ্য, কেনাবেচা।’ পাহাড়ের বর্ণনা শুরু করে মামা এই বলে: ‘পাহাড়গুলো কাঁটা খাড়া করা সজারুর মতো, সারাগায়ে ঠাসাঠাসি গাছ আর গাছ।’

মাহমুদুল হক বাংলাদেশের অন্যতম বলিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। যারা শুধু সাহিত্যপ্রেমীদের মনোরঞ্জনের জন্য লিখে গেছেন তাঁদের দলে তিনি নন। তাঁর সব লেখায় গভীর একটা খাদ থাকে—বেদনা ও বোধ থেকে সেই খাদ খনন করা। শিশু-কিশোরদের জন্য ‘চিক্কোর কাবুক’ শীর্ষক অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসটি লিখলেও আনন্দদানের পাশাপাশি তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের ভাষা ও বোধ তৈরি করা। টুপুর শব্দের ছন্দ দিয়ে রঙ নির্ণয় করার কৌশল। মামার গাছের শিকড় সংগ্রহ করার আজব সখ। সেই সঙ্গে মাহমুদুল হকের শেষঅবধি স্বভাবজাত কাব্যিক ভাষা ও উপমার পাণ্ডিত্য দেখে তাই মনে হয়। পড়তে পড়তে মনে হয়, আমরা পাঠকরাও যেন বাচ্চাদের মতো কাঁধে পানির বোতল ঝুলিয়ে আস্তে আস্তে বইটির ভেতরে প্রবেশ করছি—মাহমুদুল হকের পাঠশালায় পড়তে যাচ্ছি যে!

সারাবাংলা/পিএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর