Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাশগুচ্ছে মৃদু হাওয়ায় এলো শরৎ


১৬ আগস্ট ২০১৮ ১৫:৫৫

।।এসএম মুন্না ।।

শ্রাবণ ফুরিয়ে গেলো। আজ বৃহস্পতিবার ভাদ্রের পয়লা তারিখ। শরৎ ঋতুর সূচনা দিন। পঞ্জিকার হিসাবমতে বর্ষা চলে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে বাস্তবে। পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। কোথাও কোথাও এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টি আরও কয়েক দিন থাকবে এমনটাই আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে আবহাওয়া যেমনটাই হোক না কেনো ঋতুচক্রে বিচিত্র সব অনুভূতি-জাগানিয়া ‘শরৎ’ এখন বিদ্যমান। প্রিয় ঋতু শরতের রঙ গায়ে মেখেছে প্রকৃতি।

বিজ্ঞাপন

নদীর কিনার ঘেঁষে কাশগুচ্ছে মৃদু হাওয়ার দোলা। মাথার ওপর নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ কিংবা শিউলিতলায় ফুলের গন্ধমাখা স্নিগ্ধ ভোর ইট-কংক্রিটের নাগরিক জীবনে শরতের এ রূপ দেখা এখন কল্পনায়ও আসে না। তারপরও প্রকৃতির নিয়মে ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা জানিয়ে দেয় শরৎ এসেছে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রিয় শরৎকে স্বাগত জানিয়ে  লিখেছিলেন, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা/নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে…’।

শরৎ শুধু প্রকৃতিতেই পরিবর্তন আনে না; বদলে দেয় মানুষের মনও। সেই পরিবর্তনের কথা যেমন কবিগুরুর কাব্যে রয়েছে তেমনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই…’।

শরৎ যেমন বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে প্রবলভাবে বিস্তার করে আছে তেমনি সাহিত্যেও আছে শরতের শত শত গুনগান। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা ঋতু-প্রকৃতি বর্ণনায় মুখর থেকেছেন সর্বদাই। তবে এর মধ্য থেকে শরৎ বাদ যায়নি বরং বেশ গুরুত্বই দিয়েছেন। শারদ সম্ভার নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। চর্যাপদের পদকর্তা থেকে শুরু করে আজকের তরুণতম কবির রচনায়ও শরৎকাল ধরা দিয়েছে সাহিত্যকর্মের নান্দনিক ব্যঞ্জনায়।

বিজ্ঞাপন

মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। এ কাব্যে তিনি মেঘের খামে পুরে প্রিয়ার কাছে চিঠি পাঠানোর কথা বলেছেন। উচ্চারণ করেছেন যক্ষের যন্ত্রণাদগ্ধ কথামালা। তবে শুধু মেঘ-ই নয়, মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায়ও ছিলেন অগ্রবর্তী। তিনি বলেন- ‘প্রিয়তম আমার/ ঐ চেয়ে দেখ/ নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ কবি  তার ‘ঋতুসংহার’ কবিতায় বলেন- ‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালিধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।’

মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস লিখেছেন, ‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি আন্ধকারে/ শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।/তাত না দেখিবোঁ যঁবে কাহ্নাঁঞির মুখ/ চিনিতে মোর ফুট জায়িবে বুক।’ তবে রবীন্দ্রনাথের হাতেই শরৎকালীন প্রকৃতির অমেয় রূপ কাব্য-সাহিত্যে চিরন্তন হয়ে আছে। শরৎ নিয়ে তিনি লিখেছেন প্রচুর কবিতা-গান। এর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি।/ শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে-/ বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’ শরতের ময়ূরকণ্ঠী নীল নির্মল আকাশে শিমুল তুলার মতো শুভ্র মেঘেদের দলবেঁধে ছুটে বেড়ানো দেখে লিখেছিলেন- ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া…’। কবিগুরুর শরৎ পঙ্ক্তির মধ্যে রয়েছে- ‘ওগো শেফালি বনের মনের কামনা’, ‘সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা’, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ’, ‘শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে’, ‘শরৎ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে’, ‘হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা’, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা’ ইত্যাদি।

শরৎ বন্দনা করেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও। লিখেছেন অসংখ্য গান ও কবিতা। তার ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’/ ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’’ সহ অনেক গানই শরৎ-প্রকৃতির লাবণ্যময় রূপ নিয়ে হাজির রয়েছে।

জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় রূপসী বাংলার কবি, নির্জনতার কবি। বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবিও বলা হয় তাকে। তার কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে বাংলার প্রকৃতি, যেখানে শরতের সার্থক উপস্থিতি লক্ষণীয়। যেমন ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যে তিনি বলেন- ‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা-রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;/ আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ’। কবি জসীমউদদীন শরতকে দেখেছেন ‘বিরহী নারী’ মননে। তিনি লিখেছেন-‘গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,/ বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস’। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন-‘‘সে কী বিস্ময়! কী যে বিস্ময়! কী করে ভুলি!/আকাশের নীল ঘন শাদা মেঘ, কবেকার গ্রামপথে ডুলি!’’ কবি রফিক আজাদ ‘আমার শরৎ’ কবিতায় বলেন-‘শরৎ’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্র আমার চোখের সামনে/অর্থাৎ দৃষ্টিসীমার মধ্যে শারদ-আকাশ কিংবা/কাশফুল এসে দাঁড়ায় না-/বরং শরৎচন্দ্র মূর্তিমান হন;/না, শরৎচন্দ্র, নীলাকাশে সমুজ্জ্বল কোনো চাঁদ নয়-/মহামতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং’।

ভাদ্র মাসের নানা বৈশিষ্ট্য। তালপাকা গরম পড়ে এ মাসে। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যায় জনজীবন। অল্পবিস্তর বৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু দুঃসহ গরম থেকে যায়। বাড়ে দুর্ভোগ। গ্রামগঞ্জের কাজের বেশ অভাব থাকে এ সময়। দিনমজুর, সাধারণ মেহনতি মানুষকে তাই যথেষ্ট ভুগতে হয়।  শরৎবন্দনা করতে গিয়ে কিছুটা আক্ষেপও করেছেন গীতিকবি বিদ্যাপতি ঠাকুর। তিনি বলেছেন,  ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শুন্য মন্দির মোর ’।

শরতের আভাস স্পষ্ট করে পেতে অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী মাস আশ্বিন পর্যন্ত। নিত্যদিনের জীবনযাপনের ক্লান্তি ও বেঁচের তথাকার লড়াই, তার ফাঁকে কখন ভাদ্র এলো বা না এলো, তার খবর রাখার ফুসরত অনেকেরই নেই। বাংলা সন-তারিখের কদর ও চর্চা মূলত গ্রামগঞ্জেই বহাল আছে। চাষীরা বলে দিতে পারেন বাংলা মাসের কত তারিখ আজ। নিরক্ষর ও শিক্ষাবঞ্চিত হলেও এটা তারা সহজেই মনে রাখতে পারেন। এই দেশের কৃষিব্যবস্থা বাংলা মাসের সঙ্গে প্রত্যভাবে যুক্ত বলে এই তাদের মনে রাখতেই হয়।

ভাদ্র-আশ্বিন মাস নিয়ে শরৎকালের রাজত্বকাল। বর্ষার বিদায়ে প্রকৃতি এ সময় মহাকবি কালিদাসের ভাষায়, ‘নববধূর’ সাজে সজ্জিত হয়ে উঠে। পৃথিবীর বুকে এক অনাবিল আনন্দের ঝর্ণাধারা ছড়িয়ে দেয় এই ঋতু। শরতের নিজস্বতা মিশে রয়েছে কাশফুলের সঙ্গে।  শরৎ মানেই নদীর তীরে তীরে কাশফুলের সাদা হাসির প্লাবন। নদীর তীরে কাশফুলের কমল-ধবল রূপে জ্যোসনা-প্লাবিত রাতে জাগে স্বপ্নের শিহরণ। অনুপম রূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত শরৎ ঋতু শারদ লক্ষী নামেও পরিচিত। শরৎকাল বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পর্শ মেলে। শরতের প্রকৃতি দর্শনে অন্তরে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য লাভের বাসনা জাগায়। প্রিয়জনের হাত ধরে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে মন চায়। কবিগুরু তাই যথার্থই লিখেছেন- ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়/লুকোচুরির খেলা।/নীল আকাশে কে ভাসালে/সাদা মেঘের ভেলা।’

আজকাল শস্য বুননের সময়-পদ্ধতি-কার্যক্রম আর সনাতনী নেই। তারপরও বাংলা মাসের কার্যকারিতা রয়ে গেছে। শহরের মানুষ বাংলা সন-তারিখের ধার ধারেন না। কখন কোন মাস চলছে, সে খবরও তারা বিশেষ একটা রাখেন না। এই যে নীরব উপেক্ষা-অবহেলা তা সত্ত্বেও প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলতে থাকে। ঋতু বদল হতে থাকে চুপিসারে, নগরজীবনে অতিমাত্রায় ব্যস্ত মানুষের চোখের আড়ালে অলক্ষ্যে। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি তার রূপ-সৌন্দর্যও কম-বেশি বদলায়। আকাশের চেহারা পাল্টে যায়, ফল-ফুলে প্রকৃতি একেক ঋতুর বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। সেটা সাধারণত বোদ্ধা, রসিকজনের চোখেই ধরা পড়ে।

প্রকৃতির রূপবদলে সবসময়ই ফুলের ভূমিকা অনেকখানি। এই শরতে নানা রকম ফুলের বর্ণিল উচ্ছাস, প্রস্ফূটন আর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সচাচর বর্ষার ফুল ফোটাই অব্যাহত থাকে এই শরতে। প্রকৃতিবিষয়ক সংগঠন তরুপল্লব-এর সাধারণ সম্পাদক ও প্রকৃতিবিষয়ক গবেষক মোকারম হোসেন বলেন, ‘শরতের ফুল মূলত তিনটিÑকাঁশ, শিউলি ও পদ্ম। শরতের শেষ দিকে ফোটে ছাতিম ফুল। খালে বিলে ঝিলে ফোটে সৌন্দর্যবর্ধক লাল শাপলা-শালুক ফোটে। আরও ফোটে কলমি ফুল। পূর্ণিমার রাতে শাপলা-শালুকের এই ফুটন্ত দৃশ্য বড়ই মায়াবি। এই দুর্লভ দৃশ্য শুধু এই শরতে দেখা মেলে। কৃষ্ণচূড়া ফুল এখনও ফুটবে কিছু কিছু। এ সময়ের ফুলের মধ্যে রয়েছে হলুদ রঙা সোনাইল বা বান্দরলাঠি, বিলিতি জারুল, শে^তকাঞ্চন, এলামেন্ডা ইত্যাদি। বর্ষার ফুলের মধ্যে কামিনী তো আছেই। দু’চারটি গন্ধরাজও থাকবে। ফুরুস (চেরি) ও থাকবে এই সময়টায়। ফলের মধ্যে রয়েছে আমলকি ও জলপাই।’

এই শরতে উদযাপিত হয় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গোৎসব। মণ্ডপে মণ্ডপে বাজে ঢাক। সেই ঢাকের সাজ-সজ্জাতে ব্যবহৃত হয় কাঁশফুল। শীতের আগমনী বার্তা শুরু হয় এই শরতেই। শরতের শেষ দিকে ঘাসের ডগায় পরতে থাকে শিশির বিন্দু।

ছবি : এসএম মুন্না

সারাবাংলা/পিএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর